Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিশ্বজুড়ে বাড়ছে বিষণ্নতা

সিউল, ৩১ মার্চ ২০১৪:

বর্তমান বিশ্বে আশঙ্কাজনক হারে মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নানা অস্বাভাবিক প্রবণতা, বাড়ছে আত্মহত্যার সংখ্যাও। আত্মহত্যাপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে জাপান উল্লেখযোগ্য। ভারতেও বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে…সম্প্র্রতি তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাইয়ে দেখা গেছে, সেখানকার সমাজে বিষণ্নতা ও আত্মহত্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি সামান্য বিষয়ে পিতামাতার সঙ্গে ঝগড়া করে আত্মহত্যা করার জন্য ওষুধ খেতে দেখা গেছে অনেক কিশোর-কিশোরীকে। এমনো দেখা গেছে, অনেকে বলছেন সৃষ্টিকর্তাই তাদের আত্মহত্যা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সাধারণত সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মানুষদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে থাকে। কখনো কখনো গভীর বিষণ্নতা থেকে সিজোফ্রেনিয়া রোগের উত্পত্তি ঘটে।

chardike-ad

다운로드 (4)মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও সিজোফ্রেনিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পরিচালক রাঙাস্বামী তারা বলেন, কেউ পরীক্ষায় ফেল করলে আত্মহত্যা করে, আবার কাউকে পিতামাতা শাসন করলেও আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। ভারতের চেন্নাইয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার অধিবাসীরা আগের যেকোনো সময়ের চাইতে ইদানীং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের ওপর ব্যাপক হারে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন, যা ১০ বছর আগেও ভাবা যেত না। রাঙাস্বামী বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে এটা ঘটতে পারে। এছাড়া বর্তমানে মানসিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখা হয়। ফলে মানুষ অনেক সচেতন হয়ে উঠেছে। তার পরও বলা যায়, বর্তমানে মানুষ অনেক বেশি হতাশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত ৫০ বছরে বিশ্বে আত্মহত্যার হার শতকরা ৬০ ভাগ বেড়ে গেছে। অবশ্য এসবের বেশির ভাগই ঘটছে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের স্বাস্থ্যবিষয়ক দ্বিতীয় সমস্যা হিসেবে আত্মহত্যাকেই বিবেচনা করতে হবে। গত ডিসেম্বরে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখানো হয়, ১৯৯০ সালের তুলনায় বর্তমানে সারা বিশ্বে মানসিক রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। যদিও গবেষকরা বলছেন জনসংখ্যা, সংকট ও মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে এটা ঘটছে। ২০১১ সালে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থার একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮৮ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে বিষণ্নতা প্রতিরোধে ব্যবহূত ওষুধ ৪০০ শতাংশ বেড়েছে।

জাপানের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। মনে করা হয়, জাতিগতভাবে জাপানিরা কাজপাগল। কাজ নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকার কারণে তাদের মধ্যে তীব্র মানসিক অবসাদ তৈরি হয়, যা থেকেই বিষণ্নতার সৃষ্টি। নৃবিজ্ঞানী জুনকো কিতানাকা তার গবেষণাধর্মী বই ‘ডিপ্রেশন ইন জাপান’-এ এসব বিষয়ে ব্যাপকভাবে আলোকপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ওষুধ শিল্পের আগ্রাসী বিজ্ঞাপন জাপানিদের অবসাদগ্রস্ত করে তুলতে ভূমিকা রাখছে। ফলে জাপানে বিষণ্নতার কারণে চিকিৎসা নেয়া মানুষের সংখ্যা ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। উল্লেখ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, জাপানে আত্মহত্যার হার লাখে ২১ জন, যুক্তরাষ্ট্রে এ হার ১২। তবে আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, গত বছর ভারতের তামিলনাড়ুতে আত্মহত্যার হার বেড়ে হয়েছে লাখে ২৫ জন।

দ্রুত নগরায়ণের ফলে বিশ্বজুড়ে মানসিক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ শহরে বাস শুরু করে ২০১০ সালে। মানুষ মনে করে শহরে সবকিছু সহজলভ্য। কিন্তু শহরের জীবন ভেঙে দেয় মানুষের ঐতিহ্য ও প্রথা। এখানে একক পরিবারের সংখ্যা বেশি। এসব পরিবারে ভাঙনও বেশি দেখা যায়। এতে সৃষ্টি হয় একাকিত্ব, যা থেকে তৈরি হয় বিষণ্নতা। এ থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে দারিদ্র্য ও দ্রুত নগরায়ণ এ সমস্যা তৈরি করছে।

বিষণ্নতা সৃষ্টির পেছনে ফেসবুকেরও ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন রাঙাস্বামী তারা। যতই বলা হোক না কেন সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ফেসবুক অনন্য ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এ সাইটের কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। ব্যবহারকারীদের অনেকেই তাদের বর্তমান জীবনে সন্তুষ্ট নন। প্রায় সাড়ে ৮ কোটি ভারতীয় ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকে বন্ধুদের সুখী, বিত্তশালী অবস্থা দেখে তারা আরো অসুখী হয়ে যান। রাঙাস্বামী বলেন, অবশ্য ক্রমবর্ধমান মানসিক রোগের জন্য সরাসরি ফেসবুককে দায়ী করা যায় না।

এছাড়া সামাজিক অবস্থানের কারণেও মানুষ বিষণ্নতায় ভোগে। বিগত কয়েক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে ধনী শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু যে জীবনে সফল হতে পারেনি, সে আক্রান্ত হচ্ছে বিষণ্নতায়। আমরা যখন টিভি দেখি, ইন্টারনেটে সার্চ করি, তখন দেখি বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জমকালো ইভেন্ট হচ্ছে, যেখানে আমরা উপস্থিত থাকতে পারছি না, যা আমাদের আরো অসুখী করে তুলছে।

ইলেকট্রনিকস শিল্পের বিকাশের ফলে কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করে বিভিন্ন ধরনের গ্যাজেট যেমন: স্মার্টফোন, স্মার্ট ওয়াচ ইত্যাদি বাজারে ছাড়ছে। তরুণ প্রজন্মও উন্মুখ হয়ে থাকে এগুলো সংগ্রহের জন্য। কিন্তু যখন প্রত্যাশা পূরণ হয় না তখন তারা হতাশ হয়ে যায়। জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এ বিশাল সামাজিক পরিসরে আমরা নিজেদের পিঁপড়ার মতো তুচ্ছ মনে করতে থাকি। এ ভাবনা সত্যিই খুব গুরুতর বিষণ্নতার সৃষ্টি করে।

তানিয়া ম্যারি লারম্যানের ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধ অবলম্বনে। সূত্রঃ বণিকবার্তা।