মাঈনুল ইসলাম নাসিম, ১৮ জুন ২০১৪:
এক যুগের ব্যবধানে পোল্যান্ডে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ দূতাবাস। চলতি বছরই ওয়ারশ, ভিয়েনা ও কোপেনহেগেনে আলোর মুখ দেখবে ইউরোপের নতুন ৩টি বাংলাদেশ দূতাবাস, এমন সংবাদ বেশ কয়েকদিন আগে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অস্ট্রিয়া ও ডেনমার্কে প্রথমবারের মতো হলেও পোল্যান্ডে ১২ বছরের ব্যবধানে পুনরায় স্থাপিত হতে চলেছে বাংলাদেশ দূতাবাস।
স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে রাজধানী ওয়ারশতে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর একটানা ৩০ বছর এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু ২০০২ সালে অনেকটা হঠাৎ করেই পোল্যান্ডে বন্ধ করে দেয়া হয় বাংলাদেশ দূতাবাস। এজন্য পর্যবেক্ষক মহল থেকে দায়ী করা হয়ে থাকে সর্বশেষ দায়িত্বপালনকারী রাষ্ট্রদূত ড. এম এ সামাদের অপরিপক্কতা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঐ সময় ঢাকা থেকেও সবকিছু গুটিয়ে চলে আসে পোলিশ দূতাবাস।
ওয়ারশ ও ঢাকায় উভয় দেশের নিজ নিজ দূতাবাস বন্ধ হয়ে যাবার পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কোন অবনতি না ঘটলেও প্রত্যাশিত উন্নতির পথও তেমন আর প্রশস্ত থাকেনি মূলতঃ দূতাবাস না থাকার কারণে। ২০০২ সালের সেই কালো অধ্যায়ের পর থেকে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে অন্য আরো ক’টি দেশের সাথে দেখা হয়ে আসছে পূর্ব ইউরোপের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ পোল্যান্ড।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিগত বছরগুলোতে ইউরোপজুড়ে যেখানে ছিল কম-বেশি দারুন অর্থনৈতিক মন্দা, সেখানে পোল্যান্ডের জিডিপি সবসময় উর্ধ্বমূখী থাকলেও দেশটিতে ছিলো না প্রত্যাশিত বাংলাদেশ দূতাবাস। তবে দূতাবাস না থাকলেও রাজধানী ওয়ারশ থেকে প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার দূরবর্তী কাতোভিচ নগরীর অধিবাসী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ি ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক তাঁর আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও দূরদর্শিতায় নিজ শহর কাতোভিচ ও রাজধানী ওয়ারশ সহ পুরো দেশ জুড়ে মেলে ধরেন বাংলাদেশকে।
‘ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ’ থিমে বছরের পর বছর পোল্যান্ডের মাটিতে আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে অনুপমভাবে তুলে ধরেন তিনি স্থানীয় পোলিশ জনগনের স্বার্থক অংশগ্রহন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পোলিশ নাগরিক ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুককে মূল্যায়ন করতে কার্পন্য করেনি বাংলাদেশ সরকার, ২০১০ সালে তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয় দেশটিতে অনারারি কনসাল জেনারেল হিসেবে। দূতাবাসের অনুপস্থিতির সীমাবদ্ধতা সত্বেও পোল্যান্ড-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্পর্ক উত্তরণে নেদারল্যান্ডসের বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতা নিয়ে ‘খাঁটি দেশপ্রেমিক’ এই মানুষটি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন বিগত বছরগুলোতে।
অনেক দেরিতে হলেও আজ বাংলাদেশ সরকার পোল্যান্ডে পুনরায় বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়ায় তৃপ্তির কথা জানান অনারারি কনসাল জেনারেল ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক। ১৭ জুন মঙ্গলবার এই প্রদিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘‘যদিও পোল্যান্ডে এখন মাত্র ৫শ’ বাংলাদেশির বসবাস তবে দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ-অদক্ষ বৈধ জনশক্তি রফতানির চলমান সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাবে বিশেষভাবে। ২০০২ সালে দূতাবাস বন্ধ হয়ে যাবার সময় পোল্যান্ডে আমাদের বানিজ্য ছিল যেখানে মাত্র ২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার, ২০১৩ সালে তা ১৬ গুণ বেড়ে দাড়ায় প্রায় ৪০০ মিলিয়নে।’’
অনারারি কনসাল ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক আরো জানান, ‘‘বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আরএমজি তথা গার্মেন্টস ছাড়াও যেসব পন্য পোল্যান্ডে আসছে তার মধ্যে রয়েছে চা, প্লাস্টিক সামগ্রী, শপিং ব্যাগ, পাটজাত পন্য ও চামড়া। সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশ মেইড মেডিসিনেরও। অন্যদিকে পোল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে যাচ্ছে গুঁড়োদুধ, কিছু কিছু ফুড আইটেম ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী।’’ উল্লেখ করা যেতে পারে, পোল্যান্ডের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৯৮ শতাংশই আসে কয়লা থেকে এবং এক্ষেত্রে পোলিশ টেকনোলজি বাংলাদেশেও কাজে লাগানো যেতে পারে বলে জানান ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক।
ইংলিশ মিডিয়ামে পোল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থাকা সত্বেও বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশি ‘তথাকথিত’ স্টুডেন্টরা এই সুযোগটিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপব্যবহার করেছে বলে মনে করেন অনারারি কনসাল জেনারেল। তবে দূতাবাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে কঠোর যাচাই-বাছাই ও নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে যদি ‘জেনুইন’ স্টুডেন্ট আসার পথ প্রশস্ত করা যায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর পোল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে বলে জানান তিনি।
সুখকর খবর হচ্ছে, ঐতিহাসিক কাতোভিচ নগরীর সিলেসিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অচিরেই চালু হতে যাচ্ছে বাংলা বিভাগ। এলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে এবং জাঁকজমক অনুষ্ঠানমালায় বাংলাদেশের সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলারদেরকে আমন্ত্রণ জানাবে পোলিশ কর্তৃপক্ষ। বাংলা ভাষার এই স্বীকৃতি তথা বাংলাদেশের এই অর্জনের পেছনে ‘গ্রাউন্ডওয়ার্ক’ যথারীতি ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুকেরই। বায়ান্ন’র ভাষা শহীদদের স্বরণে কাতোভিচ নগরীতে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলছে বলে জানান তিনি।
এদিকে ১২ বছর পর পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতবাস পুনঃপ্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বিবেচনায় এবং দুঃখজনক অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে শুরু থেকেই অভিজ্ঞ কমার্শিয়াল কাউন্সিলর সহ একজন ‘হাই প্রোফাইল এন্ড স্কিল্ড’ ডিপ্লোম্যাটকে ওয়ারশতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে বাংলাদেশ সরকারে তরফ থেকে, এমন প্রত্যাশা বিশ্লেষক মহলের। লেস ওয়ালেসার দেশে আজ আমাদের সামনে সত্যিকার অর্থেই অনেক অনেক চ্যালেঞ্জ, যার সাথে মিলেমিশে একাকার সব প্রত্যাশা।