Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

‘প্রবাসীরা দেশের উপকার না করুক, অপকার তো করছে না!’

বাংলাদেশে কোনকিছু নিয়েই নাক সিটকানো লোকের অভাব হয় না। কেউ রাজনীতিকে ঘৃণা করে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছে, কেউ চিকিৎসকদের কসাই বলে এহ হাত নিয়ে নিচ্ছে, কারও চোখে ইঞ্জিনিয়ার মানেই ঘুষখোর! আর চব্বিশ ঘণ্টা পত্রিকার খবর, টিভি নিউজ কিংবা অনলাইন পোর্টালে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষটাও সামান্য সুযোগে দুনিয়াশুদ্ধ সাংবাদিকদের চরিত্র উদ্ধার করতে ছাড়েন না। খুঁজলে দেশের প্রায় প্রতিটা শ্রেনী-পেশা নিয়েই অজস্র নেতিবাচক মন্তব্য পাওয়া যাবে। দেশে নেই বলে যে প্রবাসীরা এহেন নোংরা আক্রমণ থেকে বেঁচে যান এমনটা ভাবার  কোন কারন নেই! সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে অপরকে হেয় করার জঘন্য প্রয়াসগুলো যেন দিনকে দিন নতুন মাত্রা পাচ্ছে। পৃথিবীর কোন মানুষই যেমন শতভাগ নিখুঁত নন তেমনি দুনিয়ার তাবত শ্রেনী-পেশাতেই ভালোমন্দের মিশেল আছে। কিন্তু ব্যতিক্রমকে উদাহরণ বানিয়ে যারা গোটা একটা গোষ্ঠীকে অসম্মান করতে সচেষ্ট হন তারা আসলে নিজেদের মানসিক দৈন্যতাকেই বড় প্রকট করে ফুটিয়ে তোলেন বৈকি! তারপরও একটি সুস্থ সমাজের স্বার্থে এসবের প্রতিবাদ হওয়াটা জরুরী। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-সাংবাদিক সব শ্রেনীতেই আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলার, লেখার অনেক মানুষ আছে। কিন্তু প্রবাসীদের পক্ষে কলম-কীবোর্ড ধরার মতো কেউ কি আছেন? সংখ্যাটা শুন্য না হলেও একেবারেই যে বিরল এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রবাসীদের অসম্মান করে সাধারণত যেসব কথা বলা হয় সেসবেরই কিছু জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শুভ কামাল

Image 5

সেই অনেক আগে থেকেই ‘প্রবাসী’ শব্দটা শুনলে মনের মাঝে কোন এক দীন দুঃখী মানুষের চেহারা ভেসে উঠতো, নিজ দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষটার প্রতি করুণা হতো বরাবরই, কালের পরিক্রমায় আমিও আজ তাদের একজন। প্রবাসী শব্দটা শুনলে এখন মনে হয় খুবই আপন কেউ, কেউ এখন প্রবাসী নিয়ে কোন খারাপ কথা বললে কটু কথা বললে সরাসরি বুকে এসে লাগে। আগে থেকেই খেয়াল করেছি কিছু সুশীল ভাইব্রাদারেরা প্রবাসীদের খোঁচা দিয়ে নির্মল আনন্দ নেন, সুশীল থেকে সুশীলতর হয়ে উঠেন, কয়েকদিন ধরে ভাবছি কিছু কথার জবাব দেয়ার দরকার।

ভাইয়ের প্রতি যথাবিহিত সম্মানপূর্বকই বলছি, এক ভাইয়ের স্ট্যাটাস পড়ে মনে হয়েছিলো প্রবাসীরা বুঝি প্রবাসে শুধু হার্ডওয়্যারই ডাউনলোড করেন, প্রবাসীদের সেকেন্ড জেনারেশন এখন কি কি করে সেটা অন্য এক দিন আলোচনা করবো আজ স্ট্যাটাসের পরের অংশে আলোচনা করবো সেটা নিয়ে খোঁচা দেয়াটা কতটুকু যৌক্তিক সে বিষয়ে; আরেক বিখ্যাত ব্লগার ভাই কয়েকদিন আগে যা তা ভাষায় প্রবাসীদের নিয়ে বলেছিলেন যে প্রবাসীরা নাকি কামলা ক্যাটাগরির মানুষ তারা বিদেশে নিজের দেশের লোকদের সম্মান দিতে জানেনা, সেটা নিয়েও আলোচনা আছে; আরেক সম্মানিত বড় ভ্রাতা শ্লেষভরে সকল দেশপ্রেমিক প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার আবেদন জানালেন, আজ কথা হবে সেটা নিয়েও!!

প্রথমত, বিদেশে কেউ সাধে যায়না, ঠেকায় পড়েই যায় দেশে তেমন কিছু করতে না পারলে, যেমন আমার কথা বলি আমার মত অপদার্থ একজন মানুষ দেশের কোন উপকার করা দূরে থাক দেশের বোঝা ই ছিলো, দেশ থেকে চলে এসে আমি একজন বেকার কমিয়েছি, দেশে জনসংখ্যার চাপ কমিয়েছি, দেশে থাকলে হয়তো হতাশা থেকে দূর্নীতিবাজ হতাম মানুষের টাকা মেরে খেতাম সেই সম্ভাবনা কমিয়েছি, এতে কি দেশের কোন অপকার হয়েছে নাকি উপকার হয়েছে? আমার মনে হয় এটা কেবল উন্নাসিক বাঙ্গালিদেরই সমস্যা, সমুদ্র পাড়ি দিলে জাত যাবে এমন কোন সংস্কার এখনো তাদের মাঝে কাজ করে কিনা আমি ঠিক নিশ্চিত না, তবে ইতিহাস কিন্তু বহু মাইগ্রেশনের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হয়েছে- সেই কোথা থেকে মোঘলরা এই উপমহাদেশে এসেছে, পৃথিবীর জাতিগত মানচিত্র পরিবর্তিত হয়েছে সময়ের সাথে সাথে; নতুন এলাকা খুঁজে বের করার জন্য অভিযাত্রীদের কিন্তু সরকারীভাবে পুরস্কৃতই করা হয়েছে, আমি ভাস্কো-দা-গামা কিংবা কলম্বাসের কথা বলছি, তাদের পুরস্কৃতই করা হয়েছিলো, কেউ বলেনি তারা পরবাসে যাওয়ার পথ আবিষ্কার করেছে তারা দেশদ্রোহী, আর হ্যাঁ তারাই ইউরোপের বর্তমান সমৃদ্ধিরও নায়ক!! (বিদ্রঃ আমি ব্রেনড্রেইনের পক্ষে সাফাই গাইছি না, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সেইসব মেধাবীরা যারা সরকারী টাকায় বুয়েট/মেডিক্যালে পড়েছেন তাদের অবশ্যই সেই ঋণশোধ করা উচিত, আমি আমার মত আবর্জনার কথা বলছি।)

Image 6এবার আসি হার্ডওয়্যার ডাউনলোডের কথায়, কামলা দেয়ার কথায়। এই একটা টপিক নিয়ে তারা যখন খোঁচা দেন তখন জাতি হিসেবে আমাদের বাঙালিদের এই দীনতা হীনতার কারণ আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে, আর সেই কারণ হচ্ছে কাজের প্রতি এই সম্মানহীনতা টা; আমাদের এই বাঙালি জাতি ভিক্ষা করে খেতে লজ্জ্বাবোধ করেনা, দূর্নীতি করতে লজ্জ্বা পায়না, অনলাইনে নানা কৌশলে অর্থ উপার্জনে লজ্জ্বা পায়না, তাদের লজ্জ্বা কাজে। আহারে লাজুকলতা আমার!!! এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার, যে ভাই প্রবাসীদের কামলা বলেছিলেন আমি যতদূর জানি তার সেলফোনটা কোন এক প্রবাসীর দেয়া! আম্রিকায় এসে যা দেখলাম এই দেশে চাইলে বসে বসে খাওয়া যায়, সরকার খাওয়ায়, এই ভাতাকে স্থানীয়রা বলে ‘ফুডস্টাম্প’, এই ফুডস্টাম্পের আওতায় সন্তানকেও আঠারো বছর বয়েস পর্যন্ত সরকার পালে, অথচ এই দেশে এই ফুডস্টাম্পকে লোকজন ভয়াবহ হীন দৃষ্টিতে দেখে, যারা ফুডস্টাম্প তোলে তাদেরকে সমাজ খুব নিকৃষ্ট ভাবে; এই দেশে বসে বসে খাওয়া লজ্জ্বার, কিন্তু কেউ যদি ঝাড়ু দিয়ে কিংবা হার্ডওয়্যার ডাউনলোড করে ট্যাক্স দেয় তবে সে এইদেশের সম্মানিত নাগরিক, তাহলে বলুন উন্নতি কাদের করা উচিত? তাদের নাকি আমাদের বাঙালিদের??? এই দেশে প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষ এইসব অড জব করে পড়াশোনা করে, একদিকে ইঞ্জিনিয়ার হতে থাকে অন্যদিকে পিতজা বানায় কিংবা ট্যাক্সি চালায়; আর আমাদের বাংলাদেশে কোন কলেজ ছাত্র রিকশা চালাচ্ছে খবর পাওয়া গেলে তাকে নিয়ে পত্রিকায় আর অনলাইনে মারহাবা সাবাশ বলে হাহাকার পড়ে যায়, উন্নত দেশের মানুষ ছোট কাজ করতে করতে বড় হয় বলেই তাদের জীবনবোধ স্পষ্ট, তারা যখন আগাতে থাকে তখন সবকিছু পেছনে ফেলে তেড়েফুঁড়ে আগায়, আপনিই বলুন উন্নতিটা কাদের করা উচিত???

Image 7যে ভাই প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার কথা বলেছিলেন তাকেও আরেকটু ভাবতে অনুরোধ করছি; বিভিন্ন দেশে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ প্রবাসী আছেন, অর্থাৎ প্রায় অর্ধকোটি, তারা সবাই দেশে ফিরে আসলে দেশের জনসংখ্যা কত হবে? তাদের চাকরি বাকরির ব্যবস্থা কে করবে?? নাকি তাদের খাওয়া পড়ার ব্যবস্থা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার করবে? বিহারীক্যাম্পের মত কোন শরণার্থী ক্যাম্প বানাবেন এমন কিছু ভেবে রেখেছেন নাকি??

একেবারে শেষ কথা, যদি প্রবাসীদের দেশপ্রেমের কথা বলেন তাহলে যা বলতেই হয়… প্রবাসীরা দেশের কোন উপকার একেবারে না ই করুক তবু তারা বুক মাথা উঁচু করে বলতে পারে তারা এতদূর থেকে দেশের অন্তত কোন “অপকার” করছে না, তারা ঘুষ-দূর্নীতি করে দেশকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে না, অন্যায় নৈরাজ্যের পেছনে তাদের কোন হাত নেই… আপনারা দেশের লোকজন যদি এত দেশপ্রেমিকই হবেন তাহলে দেশের আজ এই অবস্থা কেন,? প্রবাসীরা এসে তো আপনাদের যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছেনা… বলতে পারেন আপনি নিজে সৎ দেশপ্রেমিক অর্থাৎ আপনি নিজে কোন দূর্নীতি করেন না, তাহলে আমরা আরো বলতে পারি আপনি এত দেশপ্রেমিক হয়ে দেশে থাকলেন তাহলে অন্যায় প্রতিরোধ কেন করেন না…???

পুনশ্চঃ যারা এম্বেসী থেকে ভিসা রিফিউজড হয়ে এসে ‘দেশই ভাল, বিদেশে যায় কামলারা’ টাইপের স্ট্যাটাস দেন তাদের বিষয়ে এই স্ট্যাটাসে কোন আলোচনা করা হয় নাই।

নির্বাচিত মন্তব্য

chardike-ad

Image 8এই বছরের প্রথম দিকে সরকারী হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের ১৫৯ দেশে কর্মরত বাংলাদেশীর সংখ্যা ৮৭ লাখ ১৭ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৪০ জন এবং নারী কর্মীর সংখ্যা দুই লাখ ৭৬ হাজার ২৬২! বেসরকারী হিসেব বাদ দিলাম (যারা অন্য উপায়ে বিদেশে কর্মরত আছেন) ধরে নেই সব মিলিয়ে ১ কোটি। 

যেখানে দেশে বেকারত্বের শেষে নাই সেখানে এই ১ কোটি বাংলাদেশী দেশে ফেরত গেলে তখন দেশের কি অবস্থা হবে সেটা কি ওই ভাই একটু ভেবে দেখেছে? তাছাড়া যে দেশ বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স, গার্মেন্টস শিল্প এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে চলে, সেই দেশের জনগণের পক্ষ থেকে সেই ব্লগার ভাইয়ের একটু কি মাথায় আসে নাই, এইসব? 

আমি বিদেশে কর্মরত একজন কামলা। আমি নিজের গায়ের ঘাম মাটিতে ফেলে টাকা রোজগার করে দেশে পাঠাই আর সেই টাকা সরকারকে কিছুটা হলেও দেশ চালাতে সহায়তা করে। আমি দেশে বসে দেশের পাইন মারি না। আমি দেশে বসে দেশ ও জাতির পেটে লাথি দিয়ে নিজের পকেট ভরি না। এইটা কি আমার কম সৌভাগ্য?