Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মহানবীর মক্কা বিজয়

মক্কায় যখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছিল, ঠিক তখনই বিধর্মীরা হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তিকে অগ্রাহ্য করে মুসলমানদের মক্কা অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ সৃষ্টি করল। হোদায়বিয়ার সন্ধি অনুসারে খোজা সম্প্রদায় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে এবং বানু বকর সম্প্রদায় কুরাইশদের পক্ষে যোগদান করেছিল। কিন্তু দুই বছর অতিবাহিত হতে না হতেই কুরাইশরা হোদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করল। বানু বকর সম্প্রদায় কুরাইশদের সহযোগিতায় এক রাতে মুসলমানদের আশ্রিত খোজা সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে তাদের কয়েকজনকে হত্যা করল। ক্ষতিগ্রস্ত খোজা গোত্রের চলি্লশজনের একটি প্রতিনিধি দল রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার সাহায্য প্রার্থনা করল। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে তাদের সাহায্য করতে বাধ্য হলেন। তিনি প্রথমে কুরাইশদের কাছে শান্তিদূত পাঠালেন। দূতের মারফত কয়েকটি প্রস্তাবও দেওয়া হলো।

images (1)প্রস্তাবে বলা হলো যে, (১) হয় তোমরা খোজা গোত্রকে উপযুক্ত অর্থ দিয়ে এ অন্যায়ের প্রতিকার কর। (২) না হয়, বানু বকর গোত্রের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন কর। (৩) না হয়, হোদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল হয়েছে বলে ঘোষণা কর। কুরাইশরা শেষোক্ত প্রস্তাবই গ্রহণ করল। দূত ফিরে এসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সব কথা জানাল। তিনি বুঝতে পারলেন যে, কুরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। তিনি অবিলম্বে মক্কা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলেন। আবু সুফিয়ান তার ভুল বুঝতে পেরে সন্ধি বহাল রাখার জন্য হজরতের কাছে দূত পাঠাল। কিন্তু রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃথা কালক্ষেপণ না করে সমরসজ্জার আদেশ দিলেন।

chardike-ad

রমজানুল মোবারকের ১০ তারিখ। আট হিজরি সন। খুব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দিন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২ হাজার নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম সৈন্যসহ মদিনা থেকে মক্কার দিকে রওনা হলেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির মাত্র দুই বছর পরের ঘটনা। মক্কার জালিম সরকার হুদায়বিয়ার সন্ধির বিপরীতে খাজায়ানা গোত্রের মুসলমানদের গভীর রাতে অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে হত্যা করে। এ জঘন্য হামলার সময় মুসলমানরা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছিলেন। আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সংবাদ পেয়ে খুব ব্যথিত হলেন। সাহাবায়ে কিরামের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করলেন। মক্কা আক্রমণ করার অভিপ্রায় তিনি তার সাহাবাদের জ্ঞাত করলেন। কোমল হৃদয় আবু বকর (রা.) তাকে বারণ করলেন। বললেন : তারা আপনার জাতির লোক। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান প্রেরণ করবেন না। উমর (রা.) অভিযান প্রেরণ করার পক্ষে রায় দিলেন। তিনি বললেন, তারা কুফর ও তাগুতের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা আপনাকে জাদুকর ও মিথ্যাবাদী (নাউজুবিল্লাহ) আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহর শপথ, মক্কার লোক অবনত না হওয়া পর্যন্ত সারা আরব অবনত হবে না।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দুজন প্রখ্যাত সাহাবির কথা শুনে বললেন, আবু বকর ইবরাহিম (আ.)-এর ন্যায়, যিনি আল্লাহর ব্যাপারে সাধারণের চেয়েও একটু বেশি কোমল ছিলেন। উমর নূহ (আ.)-এর ন্যায়, যিনি আল্লাহর ব্যাপারে পাথরের চেয়েও শক্ত ছিলেন। বস্তুত উমরের পরামর্শ হলো সঠিক।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তপাত এড়ানোর জন্য তার অভিযানের গোপনীয়তা রক্ষা করার ওপর খুব গুরুত্ব আরোপ করলেন। প্রখ্যাত সাহাবাদের এ মর্মে হেদায়েত করলেন। সাধারণদের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে কিছু বললেন না। তিনি আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন : হে আল্লাহ! হে আমার প্রভু! কাফিরদের চোখে ও কানে পর্দা ঢেলে দিন। আমাদের উপস্থিতি যেন তাদের কাছে অতর্কিত হয় এবং হঠাৎ যেন তারা আমাদের সংবাদ পায়। আল্লাহ সুবহানাহু তার প্রিয় হাবিবের দোয়া কবুল করলেন।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব অতর্কিতে মক্কার শহরতলিতে উপনীত হলেন। সৈন্যরা সেখানে রাত যাপন করলেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সৈন্যকে একটি পৃথক আগুন প্রজ্বলিত করতে হুকুম করলেন। ১২ হাজার মশাল জ্বলে উঠল। সারা উপত্যকা আলোকিত হলো। এ অবস্থা দেখে কাফিররা ভীত-শঙ্কিত হলো। তারা মনে করতে লাগল অসংখ্য ও অগণিত লোক তাদের আক্রমণ করার জন্য জমায়েত হয়েছে। পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কুরাইশরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তিনজন গুপ্তচর প্রেরণ করল। আবু সুফিয়ান মুসলমানদের সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারলেন না। তিনি মুসলিম সৈন্যদের হাতে ধরা পড়লেন। মক্কাবাসী রাতারাতি কোনো রূপ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলো।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০ রমজানুল মোবারক অতি প্রত্যুষে মক্কা শহরে প্রবেশ করতে তার সাথীদের হুকুম করলেন। মক্কার প্রত্যেক রাস্তা দিয়ে আল্লাহর সৈনিকরা প্রবেশ করলেন। চোখ তাদের অবনত, মুখে তাদের আল্লাহু আকবর ধ্বনি। হাতে তাদের অস্ত্র। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশোধ গ্রহণ করতে তাদের নিষেধ করেছেন। রাস্তার দুই পাশে চেনা শত্রুদের বাড়িঘর তারা গম্ভীর ও শান্ত পদক্ষেপে অতিক্রম করলেন। নিজেদের বাড়িঘর শত্রুদের কব্জায় দেখেও তারা বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হলেন না। একমাত্র কাম্য তাদের আল্লাহ সুবহানাহুর সন্তুষ্টি। জিঘাংসা ও প্রতিহিংসামুক্ত সামরিক অভিযান। উল্লাস ও পৈশাচিকতার লেশমাত্র নেই। সাম্য, শান্তি ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের বিজয় মিছিল। মাঝে মাঝে সামরিক এলান : যে অস্ত্র সমর্পণ করবে সে নিরাপদ, যে ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে সে নিরাপদ, যে কাবা শরিফে আশ্রয় গ্রহণ করবে সে নিরাপদ, যে আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করবে সে নিরাপদ। এ এক অদ্ভুত অভিনব দৃশ্য। মানব জাতি কখনো এর আগে এ ধরনের শান্তি, শৃঙ্খলা, ধৈর্য ও বিনম্রতার দৃশ্য দেখেনি।

আল্লাহর সৈনিকরা কাবা প্রাঙ্গণে জমায়েত হলেন। দেবদেবীর নগ্ন ও উলঙ্গ ছবিগুলো মুছে ফেলা হলো। মূর্তিগুলো ভেঙে দেওয়া হলো। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহ সুবহানাহুর হাম্দ ও সানা পাঠ করে সমবেত জনতার প্রতি যে ভাষণ প্রদান করেন তা মানবতার ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

এক আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তার কোনো শরিক নেই। তিনি তার ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং তার গোলামকে তিনি সাহায্য করেছেন। তিনি দলসমূহকে পরাজিত করেছেন।

সাবধান! তামাম অহংকার, রক্তের প্রতিশোধ এবং দাবি-দাওয়া আমার এ দু’পায়ের নিচে। অবশ্য কাবার রক্ষণাবেক্ষণ এবং হাজিদের পানি পান করানো তার ব্যতিক্রম।

হে কুরায়শগণ! আজ আল্লাহ তোমাদের জাহিলিয়াতের গর্ব এবং বংশগৌরবের অহংকার মিটিয়ে দিয়েছেন। (সত্য হচ্ছে) সব মানুষ আদমের সন্তান এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্ট।

অতঃপর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআন থেকে তেলাওয়াত করলেন। আল্লাহতা’আলা বলেন : হে মানুষ, আমি তোমাদের এক নারী ও এক পুরুষ থেকে পয়দা করেছি এবং পরিচয়ের জন্য গোত্র ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেছি। আল্লাহর কাছে সে অধিক সম্মানিত, যে অধিক আল্লাহ ভীরু।

ভাষণ সমাপ্ত করে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভীতসন্ত্রস্ত আরব নেতাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। জঘন্য অপরাধে তারা অপরাধী। মুসলমানদের তারা মক্কার নগররাষ্ট্রের চতুঃসীমায় বসবাস করতে দেয়নি। তারা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করেছে, বাস্তুভিটা থেকে নিষ্ঠুরভাবে উৎখাত করেছে, বাড়িঘর, বিষয়-সম্পত্তি জবরদখল করেছে, আল্লাহ্র নবীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে, তাকে হত্যা করার জঘন্য ষড়যন্ত্র করেছে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। যে কোনো একটি অপরাধের জন্য তাদের প্রাণদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। দুনিয়ার আলো-বাতাস থেকে তাদের বঞ্চিত করা যেতে পারে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যার যোগ্য অপরাধীদের জিজ্ঞাসা করলেন, হে কুরায়শগণ! তোমরা কি মনে কর? আমি তোমাদের সঙ্গে কি আচরণ করব? তারা একবাক্যে বলল : আপনি আমাদের দয়ালু ভাই এবং দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। লোমহর্ষ নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি মানসপটে ভাসমান থাকা সত্ত্বেও দয়ার সমুদ্র রহমাতুল্লীল আলামিন তাদের ক্ষমা করে দিলেন। বললেন : যাও, আজ তোমরা স্বাধীন। তোমাদের বিরুদ্ধে আজ কোনো অভিযোগ নেই।

লেখক : ইসলামী গবেষক। সৌজন্যঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন।