ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিগত সাড়ে পাঁচ বছরে শিক্ষক নিয়োগে চরম দুর্নীতির পর এবার অবসরের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে অহরহ দুর্নীতি হলেও অবসরের ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবারই প্রথম। দলীয় পরিচয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও এবার একই পরিচয়ে অবসরের মেয়াদও বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদাদলের শিক্ষকরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেও কোনো কূল-কিনারা পাননি। সম্প্রতি নিয়োগ ছাড়াও অবসরের ক্ষেত্রেও দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তথ্যের আড়ালে সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে এই দুর্নীতি হচ্ছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সনদ ছাড়াই ঢাবি ক্যাম্পাসে পাঁচ শিক্ষক-কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। চাকরির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হলেও ভুয়া এই তথ্য দিয়ে অবসরের সময়সীমা আরো দুই বছর বাড়ানো হয়েছে ওই পাঁচ শিক্ষক-কর্মকর্তার। এক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত কোনো সনদপত্রও তারা জমা দেননি বলে জানা গেছে। সরকার দলীয় মনোভাব হওয়ার কারণে শুধুমাত্র সনদপত্র জমা দেওয়ার শর্তে তাদের এ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
অথচ মেয়াদ বাড়ানো হলেও এখনো পর্যন্ত ওই শিক্ষক-কর্মকর্তারা কোনো সনদ জমা দেননি। এমনকি কবে নাগাদ সনদপত্র জমা দিতে হবে তা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে বলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে।
রেজিস্ট্রারের দফতর ও সিন্ডিকেট সদস্যদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদনকারী ও পাঁচ শিক্ষক-কর্মকর্তারা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমাদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন মোল্লা, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আজিজুর রহমান, চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবুল বারক আলভী, আইবিএ’র পরিচালক অধ্যাপক ড. ইকবাল আহমদ ও কর্মকর্তা সুলতানা রাজিয়া।
এর মধ্যে ড. নাসরিন আহমদের চাকরির বয়স থাকায় তাকে এখনো চাকরির বয়স বৃদ্ধির চিঠি দেওয়া হয়নি। তারা সবাই সরকার সমর্থিত নীলদলের সমর্থক বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা কোনো সরকারি চাকরিতে কর্মরত কেউ যদি চাকরির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা ভোগ করতে চান তাহলে তাকে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখাতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এই নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও সনদ ছাড়াই তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে সিন্ডিকেট সভায় একাধিক সদস্য নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে এর প্রতিবাদ জানালে তাতেও কোনো সাড়া দেননি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের অবসর গ্রহণের সময় হওয়ার কয়েকদিন আগে তারা এ সুবিধার আবেদন করেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত ২২ জুন অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় এ সংক্রান্ত বিষয়াদি আলোচনা হয়। সেখানে আবেদনকারীদের কোনো কাগজপত্র না থাকায় সুবিধা দেওয়ার প্রতিবাদ করে সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য নোট অব ডিসেন্ট দেন। এমনকি এতদিন পর কিভাবে এ আবেদন করা হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, চাকরির শুরুতে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা এবং প্রয়োজনীয় সনদ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা দেওয়া যাবে না। চলতি বছরের চার আগস্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব গোলাম রহমান মিঞার স্বাক্ষর রয়েছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়, ইতোমধ্যে কোনো দফতর, সংস্থা, করপোরেশন কিংবা কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেওয়া নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে তাদের অধীনে কর্মরত কোনো গণকর্মচারীকে এ ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকলে দ্রুত সে আদেশ বাতিল করা যেতে পারে।
চিঠিতে বলা হয়, চাকরিতে প্রবেশের সময় মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণাকারী অথবা যাদের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল অথবা যারা প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরযুক্ত সনদ গ্রহণ করেছেন তাদেরই মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
২০১১ সালের ৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স বৃদ্ধির বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো হয়। সেখানে উল্লে¬খ ছিল, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা সংক্রান্ত নির্দেশনা বজায় থাকবে তবে ঘোষণা সংক্রান্ত প্রমাণাদি যাচাই করে নিতে হবে। ২০১০ সালের ৭ নভেম্বরের পাঠানো চিঠির প্রেক্ষিতে এ নির্দেশনা জারি হয়।
জানা যায়, অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান বর্তমান পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মুক্তিযোদ্ধা সুবিধার আওতায় তিনি আরো দুই বছর অর্থাৎ ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত উভয় দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু তিনি কোনো সনদ দেখাননি। চলতি বছরের জুন মাসে তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।
সে অনুযায়ী বিভাগের আরেক সিনিয়র অধ্যাপক ড. নাসিমা ফেরদৌসকে গত ৩ জুন পরবর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে একটি চিঠিও দেওয়া হয়। কিন্তু এরই মধ্যে ড. আজিজুর রহমান নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে তার চাকরির বয়সসীমা আরো দুই বছর বৃদ্ধির আবেদন করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর।
গত ২৫ জুন রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তাকে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ জমা দেবেন এ শর্তে চাকরির সময়সীমা দুই বছর বর্ধিত করা হয়েছে বলে জানানো হয়। কিন্তু সেখানে সনদ জমা দেওয়ার কোনো সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি।
অপরদিকে অধ্যাপক নাসিমা ফেরদৌসকেও একই দিন অর্থাৎ ২৫ জুন রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেওয়া হয়। যেখানে গত ৩ জুন পাঠানো চিঠি কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে প্রত্যাহার করা হলো বলে উল্লে¬খ করা হয়। যেটিকে অনৈতিক ও অপমানজনক হিসেবেই অভিহিত করছেন বিভাগের একাধিক শিক্ষক।
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে। যদিও তারা এখনো মুক্তিযোদ্ধা সনদ জমা দেননি। আর সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তেই তাদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আবেদনকারীদের কাছে মন্ত্রণালয়ের একটি প্রত্যয়নপত্র আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ঢাবি ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সনদ জমা দেওয়ার শর্তেই তাদের মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, পারলে বিষয়টি ভেবে দেখা হবে।
তবে তিনি শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির কথা অস্বীকার করে বলেন, যারা নিয়োগ পায় এবং যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তারা সবাই তাদের নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ পায়। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো দলীয়করণ করা হয় না। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নেই। সংবাদ শীর্ষনিউজ।