Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সম্প্রচার নীতিমালার মূল লক্ষ্য টকশো

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে সমুন্নত রাখার কথা বলা হয়েছে। তো বাংলাদেশের গণমাধ্যম কখনই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার দাঁড়িয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার মাহফুজ উল্লাহ।

169_pht_36887 রেডিও তেহরানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট এ সাংবাদিক বলেন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার মধ্যে টকশোর কথা বলা হয়েছে। এই টক-শো এবং আলোচনা সভা নিয়ে সরকারের অবস্থা খানিকটা বেগতিক। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি করার  মূল লক্ষ্য হচ্ছে টকশোকে নিয়ন্ত্রণ করা।

chardike-ad

১৯৭৫ সালে যে মানসিকতা থেকে কেবলমাত্র ৪ টি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। যে মানসিকতা থেকে সরকারের একজন মন্ত্রী সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করার কথা বলেছেন। সেই একই মানসিকতার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি এই জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার মধ্যে।

বাংলা টেলিগ্রাফের পাঠকদের জন্য রেডিও তেহরান থেকে  পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো

রেডিও তেহরান: সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা’ অনুমোদন করা হয়েছে এবং গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এরপরই জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিক, সুশীলসমাজ এবং পর্যবেক্ষক মহলে। এই নীতিমালা অনুমোদনের পর গণমাধ্যমের ওপর খড়গ নেমে আসার আশঙ্কা করেছেন অনেকে। একে বিপজ্জনক অস্ত্র বলেও মন্তব্য করা হয়েছে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ। কেন এ নীতিমালাকে বিপজ্জনক বলা হচ্ছে? এর সমস্যার দিকটি কি?

মাহফুজ উল্লাহ: জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাকে যারা বিপজ্জনক মনে করছেন তারা সঠিকভাবেই এটি মনে করছেন। যারা মনে করছেন এই নীতিমালার মাধ্যমে সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করা হবে তারাও সঠিকভাবেই সেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। তবে যেহেতু জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাটি বেশ দীর্ঘ কাজেই এ দীর্ঘ নীতিমালার প্রতিটি ধারা ধরে আলোচনা করা স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব নয়। তবে এখানে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সত্য অসত্যের কথা বলা হয়েছে এই নীতিমালর মধ্যে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই সত্য-অসত্য কে নির্ধারণ করবেন! কোনটি সঠিক আর কোনটি বেঠিক মত সেটিও কে নির্ধারণ করবেন! এতে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কোনটি শ্লীল এবং কোনটি অশ্লীল বিষয়টির কথা বলা হয়েছে- কিন্তু সেটি নির্ধারণ করবে কে? এখানে ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কোনো সম্প্রচার মাধ্যম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলেছে? আমার জানামতে এমনটি হয় নি। দু একটি দুর্ঘটনা হয়তো ঘটেছে তবে তা উল্লেখ করার মতো কোনো বিষয় নয়।

সম্প্রচার নীতিমালায় বলা হচ্ছে জাতীয় নেতাদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। তবে জাতীয় নেতারা কারা সেকথাটা কিন্তু বলা হয় নি। জাতীয় নেতা হিসেবে শুধু একজনের কথা বলা হয়েছে আর কারো কথা এখানে বলা হয় নি। বলা হয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি কোনো দুষ্কর্ম করে সে সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। তো আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবো না কারণ পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সেখানে বিধান দিয়ে  দেয়া হয়েছে।

এছাড়া বলা হয়েছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে সমুন্নত রাখতে হবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম কখনই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে- গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা। এর কোনোটাই বর্তমান সরকার গ্রহণ করছে না বা বাস্তবায়িত করছে না।

তারপর আলোচনা সভার কথা বলা হয়েছে। পুরো নীতিমালায় যেটি আসলে আক্রমণের মূল কেন্দ্র সেটি হচ্ছে- টেলিভিশনের যেসব টকশো এবং আলোচনা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় সেখানে বর্তমান সরকার সম্পর্কে অনেক কিছুই প্রচারিত হয় যা সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার পথে  তারা অনেক বেশি প্রতিকূল করছেন। অন্যান্য বিষয়ের অনেক কিছুই গৎবাধা তবে এই টকশো এবং আলোচনা সভা নিয়ে সরকারের অবস্থা খানিকটা বেগতিক।

১৯৭৫ সালে যে মানসিকতা থেকে কেবলমাত্র ৪ টি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল। যে মানসিকতা থেকে সরকারের একজন মন্ত্রী সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করার কথা বলেছেন। সেই একই মানসিকতার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি এই জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার মধ্যে।

দেখুন, সরকার যে নির্বাচন করেছে তার গ্রহণযোগ্যতা নেই। কাজেই সেই নির্বাচন সম্পর্কে যখন সমালোচনা ওঠে তখন সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার যে সম্ভাবনা সেটি অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর গণতন্ত্র এবং ফ্যাসীবাদের মধ্যে পার্থক্যটা আমার অনেক সময় বুঝতে পারি না।

গণতন্ত্র হচ্ছে সেই মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা যে মতামতকে যদি ঘৃণাও করা হয় তাহলেও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদ হচ্ছে কোনো মতামতকে প্রদর্শন করতে দেয়া হবে না। তো যেভাবে জাতীয় সম্প্রচার নীতিামালার পুরো বিষয়টি এগিয়ে যাচ্ছে তাতে মতামত প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে। তারমানে সংগতভাবেই দেশ এগিয়ে যাবে ফ্যাসিবাদের দিকে। এই ফ্যাসিবাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার এবং সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য নির্যাতনমূলক বা বিবর্তনমূলক যেসব সংস্থা আছে তারা জনগণের বিরুদ্ধে একধরণের যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গত কয়েক মাসে আমরা তার বহিঃপ্রকাশ খুব ভালোভাবে দেখেছি। এ কারণে সবকিছু মিলিয়ে সরকার একধরণের অস্বস্তিকর এবং অসহায় অবস্থার মধ্যে আছে। আর সে কারণেই আন্দোলন, সমাবেশ বিক্ষোভ এসবের কোনো কিছুই  সরকারের বিরুদ্ধে দেখানো যাবে না। তো সমাজে এসব জিনিষ ঘটবে অথচ গণমাধ্যম তা দেখাতে পারবে না সেটা কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক অবস্থান হতে পারে না।

আরেকটি বিষয় এখানে বলা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যে সম্প্রসারণ ঘটেছে অর্থাৎ টুইটার, ফেসবুক ব্লগসহ সামগ্রিক বিষয়গুলোকে দেখি, তাহলে এসব বিষয়কে বন্ধ করবেন কিভাবে! হ্যাঁ দেশের মধ্যে হয়তো এগুলোকে বন্ধ করে দিতে পারবেন। কিন্তু দেশের বাইরের দুনিয়ায় তো এসবই প্রচারিত হবে। তো এ অবস্থার মধ্যে সরকার কি করে নিজের মান-ইজ্জত রক্ষা করবেন- তা আমরা বুঝতে পারি না।

এই নীতিমালার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ যেসব নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে সেসব নিয়ন্ত্রণ এমনিতেই সব সম্প্রচার মাধ্যম তাদের নিজেদের অবস্থান থেকে মেনে চলে। সম্প্রচার মাধ্যমে যেসব টক-শো প্রচারিত হয় তাতে কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হয় না; সেখানে করা হয় সমালোচনা। বরং ক্ষমতাসীন দল  সব বিরোধী দল সম্পর্কে অশ্লীল ভাষায় সংসদে এবং সংসদের বাইরেও কথা বলে। তাহলে কি সেগুলোও প্রচার করা যাবে না। এখানে টেরিসটোরিয়াল মাধ্যমের কথা বলা হয়েছে। তারমানে হচ্ছে বিটিভি অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু বিটিভিকে তারা কি সংশোধন করবেন। বিটিভিকে কি তারা নিরপেক্ষ করবেন! আমার ধারণা হচ্ছে সেটা হবে না। বরং অন্যান্য যেসব চ্যানেল আছে সেগুলোকে বিটিভির শাখায় পরিণত করা?

রেডিও তেহরান: আচ্ছা এই নীতিমালার বিরুদ্ধে তো বেশ প্রতিবাদ সমালোচনা চলছে। তবে এর কি কোনো ইতিবাচক দিক নেই? থাকলে কি সেটা

মাহফুজ উল্লাহ: দেখুন জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার যেসব ইতিবাচক দিক আছে সেগুলো নতুন করে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন আমি ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। দেখুন ধর্মীয় মূল্যবোধটাকে আমি খুব বড় করে দেখি। আপনারা কি বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেলে বিকিনি পরিহিত কোনো বাংলাদেশি মহিলার ছবি দেখাতে পারবেন! কোনো বাঙালী মুসলমান শুকরের মাংশ খাচ্ছে এমনটি দেখাতে পারবেন! ভারতীয় কোনো টিভি চ্যানেলে আপনারা দেখাতে পারবেন না যে  কোনো হিন্দু গরুর মাংশ খাচ্ছে। ধর্মীয় এসব মূল্যবোধ সব টিভি চ্যানেল মেনেই আসছে। এখানে তো কোনো জাতীয় নেতার প্রতি অশ্রদ্ধা করা হয় না, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অশ্রদ্ধা করা হয় না, আইনের শাসনের প্রতি অশ্রদ্ধা করা হয় না। এসব বিষয় এসমাজে আছে তা লিখিত হোক বা অলিখিত হোক। দেশের প্রচলিত যেসব আইন আছে সেসব আইনে এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে।

এরই মধ্যে সরকার দিগন্ত এবং ইসলামি টিভিকে বন্ধ করে দিয়েছে- এগুলো কিসের বলে সরকার বন্ধ করেছে। তখন তো সম্প্রচার নীতিমালা ছিল না। কাজেই যেসব প্রচলিত আইন আছে তা দিয়েই এসব নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সম্প্রচার নীতিমালার মধ্যে কমিশনের কথা বলা হয়েছে। স্বাধীন কমিশন হবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে কি ধরণের কমিশন হয় সে অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে কমিশন যদি কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে পারে, বা যেসব জিনিষ বিতর্কিত মনে করবে বা এই আইনে বলা নেই সেগুলো তথ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তাহলে এটি তখন হয়ে যাবে তথ্যমন্ত্রণালয়ের একটি শাখা।

রেডিও তেহরান: সম্প্রচার নীতিমালা বাস্তবায়নের আগে আপনারা টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর পক্ষ থেকে আগে কমিশন চাইছেন? কেন সেটা চাইছেন, আগে পরে কি এমন পার্থক্য আছে? তাছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য কমিশন নিয়ে কিন্তু নানা কথা আছে!

মাহফুজ উল্লাহ: দেখুন ওইসব কমিশন যে স্বাধীন নয় সেকথা সবাই জানে। এখানে যে কমিশনটা গঠন করা হবে সে ব্যাপারে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকরা তার বিপদটা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছেন না। কারণ একটা পর্যায়ে যখন নিয়ন্ত্রণটা খুব মারাত্মকভাবে আরোপিত হবে তখন তাদের টিআরপি বা জনপ্রিয়তার মাপকাঠি কমে যাবে দর্শক সংখ্যাও কমে যাবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে কমিশন গঠনের পর- আসলে সেটি কখন গঠন করা হবে সেটি বলা হয় নি। তার আগ পর্যন্ত তথ্যমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে। কমিশন অনেক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে না, যেগুলো তথ্যমন্ত্রণালয় নেবে। তার মানে হচ্ছে একজন সহকারী সচিব স্বাক্ষরিত হয়ে একটা নির্দেশ দিয়ে দেবেন যে আদিষ্ট হয়ে জানাচ্ছি। বাস পুরো বিষয়টি ওই জায়গায় চলে যাবে। এখন সরকারের যেসব আমলা আছেন তাদের জ্ঞান-মেধা ও বুদ্ধি বাইরের পৃথিবীতে যারা আছেন তাদের চেয়ে বেশি এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

রেডিও তেহরান: সর্বশেষ আপনার কাছে জানতে চাইছি- মিডিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা না হয় তাদের স্বার্থের দিক থেকে এ নীতিমালার সমালোচনা করছেন কিন্তু দেশের প্রায় বিরোধী সব রাজনৈতিক দলও বিরোধিতা করছে। তাদের আশংকা ও বিরোধিতার কারণ কি?

মাহফুজ উল্লাহ: আপনি ঠিকই বলেছেন মিডিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেটা করছেন সেটা তাদের পেশাগত বাধ্যবাধকতা থেকে। আর বিরোধীদলগুলো করছেন এই জন্যে যে, যেহেতু তাদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যাবে। তাদের কোনো বক্তব্যই আর মিডিয়াতে আসবে না। তারা যেসব কথা বলবে তার সবকথার ওপর নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আর সেকারণেই তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।