Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

এক অনাথ শিশুর জীবনবৃত্তান্ত

[১৮৬০ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে ব্রিটেন থেকে প্রায় এক লাখ এতিম বা দুস্থ বালক-বালিকাকে চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে কানাডায় পাঠানো হয়। তারা কেউ খামারে, কেউবা ঘরের কাজ করত। তাদের সাথে কোনো কোনো নিয়োগকর্তা ভালো আচরণ করত, কেউ কেউ খারাপ। চুক্তির মেয়াদ শেষে যাদের কেউ কেউ পরিবারের কাছে ফিরে আসত, কেউ সে দেশেই পরিবার গড়ে থেকে যেত। তেমনি এক শিশু চার্লির জীবন সংগ্রামের রোমাঞ্চকর কাহিনী লিখেছেন তারই কন্যা বেরিল ইয়ং। বিদেশী পত্রিকা থেকে সেই কাহিনী অবলম্বনে লিখেছেন হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী]

চার্লি হারভের পরিবার ছিল গরিব, কিন্তু তাই বলে সুখের অভাব ছিল না তাদের। তার বাবা কাজ করতেন ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন শহরের একটি মিষ্টির দোকানে। সেই দোকানের ওপরতলায় ছিল তাদের বাসা। বাবা-মা ছাড়াও ছিল চার বোন ইভা, হিলডা, ফ্রেডা, এডি ও নেলি। আর ছিল ছোট এক ভাই আর্থার। সব মিলিয়ে নয়জনের সংসার। এত বড় সংসার চালাতে গিয়ে চার্লির বাবার হিমশিম খাওয়ারই কথা। সারা দিন মিষ্টির দোকানে কাজ করে সন্ধ্যায় আরেকটি কাজ করতেন তিনি। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হতো।

chardike-ad

orpan boyচার্লির মা ছেলেমেয়েদের বলতেন, ‘আমরা গরিব মানুষ’। কিন্তু তাদের বাবা তাদের জন্য প্রতিদিন এত ক্যান্ডি আনতেন, তারা বুঝতেই পারত না যে, তারা গরিব। আর কখনো-সখনো বাসার নিচতলায় গেলেও দোকান থেকে এটা-সেটা দিতেন তিনি। সব মিলিয়ে ভালোই কাটছিল চার্লিদের দিন। টাকার অভাব ছিল, কিন্তু হাসিখুশির কমতি ছিল না।

১৯১০ সালের শরৎকালের এক রাতে ঝুম বৃষ্টি হলো। বাড়ি ফেরার পথে ভিজে একসা হয়ে গেলেন চার্লির বাবা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগে গেল তার। তিন দিনের মাথায় ধরা পড়ল নিউমোনিয়া। চার্লির মা মেঝ মেয়ে হিলডাকে পাঠালেন ডাক্তার আনতে। মেয়ে যখন ডাক্তার নিয়ে ফিরেছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের বাবা তখন অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন।

স্বামীর অকস্মাৎ মৃত্যুতে হাসিখুশি পরিবারটিতে অন্ধকার নেমে এলো। চার্লিদের আরো এক বোন, তিন মাস বয়সী নেলি, তখন মায়ের কোলে। ছয় শিশুসন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন তিনি? গির্জার বিধবা তহবিল থেকে এক সপ্তাহ খানাপিনা দেয়া হলো। এরপর? নিরুপায় সারাহ তখন তার বড় ছেলেমেয়েদের পাঠালেন কাজের খোঁজে। ১৬ বছর বয়সী ইভা লন্ডনের এক হোটেলে পরিচারিকার কাজ পেল। মেঝ হিলডা (১৪) স্থানীয় এক ধনাঢ্য জাহাজ মালিকের বাড়িতে কাজ জুটিয়ে নিলো। চার্লি পেল খবরের কাগজ বিক্রির কাজ। বেতন সপ্তাহে মাত্র পাঁচ পেন্স। এত কম পয়সায় তো সংসার চলে না।

 নিয়তির নির্দেশ

চার্লির বাবা মারা যাওয়ার দুই মাস পর এক দিন সব ছেলেমেয়েকে ডাকলেন তাদের মা সারাহ। মা কী বলেন শুনতে সবাই টেবিলের চার পাশে জড়ো হলো। সারা বললেন, ছেলেমেয়েরা শোনো! আমাদের সবার আর একসাথে থাকা হবে না। ফ্রেডা (১০) ও এডিকে (৮) পাঠানো হবে এই শহরের মেয়েদের এক এতিমখানায়। আর্থারকে নেবে এখান থেকে অনেক দূরের আরেক এতিমখানা। কেবল নেলি থাকবে আমার সাথে। আমি ঠিক করেছি, লন্ড্রির কাপড় ধুয়ে যা পাই তা দিয়ে দু’জনে কোনোমতে কাটিয়ে দেবো।

চার্লি বলতে যাচ্ছিল ‘মা, আমি আর্থারের সাথে যাব’, কিন্তু তার আগেই সারাহ তাকে বললেন, তুমি যাবে লন্ডনের ড. বার্নার্ডো হোমে। আমাদের প্রতিবেশী মিস রোকে তোমাকে সেখানে পৌঁছে দেবেন।

চার্লি বলল, ‘কেন, আমি আর্থারের ওই হোমে গেলে কী অসুবিধা?’ মা বললেন, ওরা ১০ বছরের বেশি কাউকে ভর্তি করায় না। তোমাকে নেবে না।

এক দিন ভাইবোন সবাই যখন ঘুমিয়ে, চার্লি তখন মায়ের কাছে গেল। তার চোখ ছলছল করছে। আবেগে বুজে আসছে গলা। বলল, মা, আমি তোমার কাছেই থাকব মা। আমি এখানে একটা শিপইয়ার্ডে কাজ পাব। তুমি যা করতে বলবে, সব আমি করব, মা! আমাকে অন্য কোথাও পাঠিও না।

গভীর আবেগে ছেলের একটা হাত বুকে টেনে নিলেন সারাহ। বললেন, বাপ আমার! তোরা আমার বুকের ধন। তোদের হোমে (এতিমখানা) পাঠাতে আমার যে কী কষ্ট হচ্ছে, তা তোদের দেখাতে পারব না। তোরা বুঝিস না, আমি তোদের কতটা ভালোবাসি! আমি যা করছি তোদের ভালোর জন্যই করছি।

সারাহ ছেলেকে বোঝালেন, ড. বার্নার্ডোর হোম হবে চার্লির জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা। এতিম ও দুস্থ শিশুদের সাহায্যের জন্য এই হোমটির অনেক সুনাম আছে। ওরা শিশুদের কাজ দিয়ে কানাডা পাঠায়। কানাডা যেতে পারাটা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। আর একটা বছর। আগামী বছর তোর বয়স যখন ১৪ হবে, তখন ওরা তোকে কানাডা পাঠাবে।

মায়ের কথা শুনে বিষম খেয়ে গেল চার্লি। কানাডা তো আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে। মা তাকে এত দূরে পাঠিয়ে দেবে? ছেলেকে আশ্বস্ত করতে তার চুলে বিলি কেটে দেন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসেন। বলেন, বাবা রে, কানাডা একটা নতুন দেশ। ওখানে সব কিছুই নতুন করে শুরু হবে। সেখানে তুই এমন সুযোগ পেয়ে যাবি, যা ইংল্যান্ডে কখনোই মিলবে না। এক সময় দেখবি তোর ছোটভাই আর্থারও সেখানে তোর কাছে চলে গেছে।

মায়ের কথার জবাবে চার্লি কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই মা উঠে গেলেন। একটি ড্রয়ার থেকে একটা ধাতব টেল ওপেনার (বোতলের ছিপি খোলার সরঞ্জাম) নিয়ে এসে ছেলের হাতে দিলেন। ওটা দিয়ে বাবাকে জিনজার বোতল খুলতে দেখেছে চার্লি। সারা বললেন, তোকে দেয়ার মতো আমার আর কিছু নেই। এটা সবসময় কাছে রাখবি। তাহলে তোর মনে পড়বে যে, তুই একেবারে এতিম নোস। তোর একজন মা আছে, যে তোকে খুউব ভালোবাসে।

চার্লি তার মায়ের মুখের দিকে তাকাল। সে মুখে পৃথিবীর সব বেদনা ও ভালোবাসা এসে জমাট বেঁধেছে। সে ওপেনারটি এত জোরে চেপে ধরল যে, এর ধারালো অংশটা তার হাতে ঢুকে গেল।

ড. বার্নার্ডোর হোমে

এক দিন সত্যি সত্যিই লন্ডনের উদ্দেশে ট্রেনে চেপে বসল চার্লি। তাকে নিয়ে যাচ্ছেন মিস রোকে। চার্লি এর আগে কোনো দিন ট্রেনে চড়েনি। প্রথম ট্রেনে চড়া, রাজধানী লন্ডনে যাওয়া কিছুই ভালো লাগছে না চার্লির। তার বারবার বাড়ির সবার কথা মনে পড়তে থাকল।

লন্ডনে ট্রেন থেকে নেমে তারা প্রথমে উঠল একটি দোতলা ট্রামে। বসল ওপরতলায়, যাতে যেতে যেতে লন্ডন শহরটাকে ভালোমতো দেখা যায়। তাদের ট্রাম বাকিংহাম প্যালেসের পাশ দিয়ে গেল। ‘ইস, যদি আর্থার এ সময় থাকত আমার সাথে!’ ভাবে চার্লি।

পূর্ব লন্ডন এসে ট্রাম থেমে গেল। তীব্র অস্বস্তিতে পেটটা কেমন মোচড় দিলো। মিস রোকে তাকে একটা বিশাল ভবনের দিকে নিয়ে গেলেন। ধূসর ভবনের চার দিকে দেয়াল। দেখলেই মনে হয় যেন জেলখানা। সামনের দরজার ওপর একটা সাইনবোর্ড। তাতে লেখা :

লিওপোল্ড হাউজ

ড. বার্নার্ডোস বয়েজ হোম

এখানে ভর্তি হতে এসে কোনো দুস্থ

শিশুকে কখনো ফিরে যেতে হয়নি

ভেতরে ঢুকতেই লম্বাচওড়া এক মেট্রন তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি মিস রোকের হাতে একটি ফরম দিয়ে সেটি পূরণ করতে বললেন। মিস রোকে দ্রুত সেটি পূরণ করলেন। তারপর চার্লির দিকে তাকিয়ে একটু ম্লান হাসলেন। তারপর তাকে একটা বিদায়ী চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মেট্রন এবার চার্লিকে তার সাথে যেতে ইশারা করলেন। বেশ কয়েকটা জনশূন্য হলঘর পেরিয়ে তারা পৌঁছলেন ছোট একটা কামরায়। মেট্রন একটা বেঞ্চ দেখিয়ে চার্লিকে সেখানে বসতে বললেন। চার্লির ছবি তোলা হবে।

চার্লি এর আগে কখনো ক্যামেরা দেখেনি। সে তিন পায়ার ওপর বসানো একটি বড় বাক্সের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। একটু পরই একটা ছেলে এসে ঢুকল। সে চোখ পিটপিট করে একবার চার্লির দিকে তাকাল, তারপর বাক্সের ওপর রাখা কালো কাপড়ের নিচে নিজের মাথাটি ঢুকিয়ে ফেলল। এরপর ফ্যাশ জ্বলল আর ছেলেটি কালো কাপড়ের ভেতর থেকে মাথা বের করল। তার বয়সী একটা ছেলে ছবি তুলতে জানে? চার্লি বেশ মজা পেল।

এরপর চার্লির ওজন নেয়া হলো। ঈষৎ হতাশ গলায় মেট্রন বললেন, ‘৬৬ পাউন্ড’। এরপর তিনি চার্লির হাতে কিছু কাপড়চোপড় দিলেন। ওতে আছে কয়েকটি কালো প্যান্ট, একটি সাদা শার্ট, কালো বুট ও একটি জ্যাকেট। সব নিয়ে চার্লি চলল ওপরতলায়; সেখানেই ডরমিটরি। চার্লিকে তার শয্যা দেখিয়ে দিলেন মেট্রন। বললেন নতুন কাপড়চোপড় পরে হুঁইসেলের জন্য অপেক্ষা করতে। হুঁইসেল বাজলে খাবার ঘরে গিয়ে দুপুরের খানা খেতে হবে।

জানালা দিয়ে দুপুরের রোদ এসে ঢুকেছে ঘরে, বিছানায়। চার্লি গুনে দেখল ২০টি বিছানা। বাড়িতে সে ও আর্থার একটি বড় বিছানায় একসাথে ঘুমাতো। প্রায় সময় এডিও তাদের সাথে ঘুমাতে আসত। এসব ভাবতে ভাবতে আনমনা হলো সে। তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক-দু’জন তার দিকে তাকাল একটু। চার্লির মনে হলো সে এখানে কিছুতেই থাকতে পারবে না।

আধঘণ্টা পরই হুঁইসেল বেজে উঠল। ছেলেরা কলকল করে ছুটতে শুরু করল নিচতলার দিকে। চার্লিও তাদের সাথে গেল ডাইনিং রুমে। রুমটির ছাদ অনেক উঁচুতে। কাঠের টেবিল ও বেঞ্চ পাতা। ধূসর রঙের স্যুট পরা কড়া চেহারার এক মাস্টার সব তদারক করছেন।

প্রত্যেক টেবিলে স্যুপ, রুটি ও চা দেয়া হলো। অন্য বালকদের মতো চার্লিও হুড়োহুড়ি করে সেসব নিলো। খানার সময় কেউ কোনো কথা বলল না, দ্রুত খানা শেষ হলো। এরপর মাস্টার কি যেন একটা বলতেই সবাই ছুটে গেল উঠানে। এখন ছেলেদের খেলার সময়। তারা দলে দলে ভাগ হয়ে ফুটবল বা অন্য কিছু খেলছে। চার্লি খেলবে না। সে সীমানা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। দেখল, নোংরা উঠানে একদল এতিম ছেলে হইচই করছে। সে ভাবল, আমি তো এদের কেউ নই! বাবা মারা যাওয়ায় দুর্ভাগ্য তাকে এখানে টেনে এনেছে। না, মায়ের একেবারেই ঠিক হয়নি তাকে এখানে পাঠানো।

রাত ঠিক ৮টা বাজতেই হুঁইসেল বাজল। এখন শুতে যেতে হবে। চার্লির জীবনে এটাই প্রথম নিজের একা বিছানা। ছোট, শক্ত বিছানা। সে কম্বলের নিচে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার খুব করে মনে পড়তে লাগল ছোটভাই আর্থারের কথা ফেগান এতিমখানায় সে কেমন আছে?

সে রাতে চার্লির ঘুম এলো অনেক পরে।

হুঁইসেলের শব্দবন্দী জীবন

প্রতিদিন ভোর ৬টা বাজতেই লিওপোল্ড হাউজে তীব্র স্বরে হুঁইসেল বেজে ওঠে। তার শব্দে ছেলেরা জেগে ওঠে, হাত-মুখ ধোয় আর বিছানাপত্র গুটিয়ে রাখে। দ্বিতীয় হুঁইসেলটি সকালের নাশতার। ছেলেরা নাশতা খাওয়ার আগে টেবিলের চার পাশে দাঁড়িয়ে ‘গড সেভ দ্য কিং’ গায়। এরপর বাটিভর্তি পরিজ দিয়ে সকালের নাশতা সারে। এরপর আরেকটি হুঁইসেল বাজলেই ছেলেরা দলে দলে ভাগ হয়ে কেউ বাটি ধোয়, কেউ বাথরুম পরিষ্কার করে, কেউ ঘর মোছে।

এসব কাজ শেষ হতেই ফের হুঁইসেল বেজে ওঠে। এবার মাঠে গিয়ে শরীরচর্চা করতে হবে। এর পরও হুঁইসেল আছে। সেটি কাস শুরুর। দুই ঘণ্টা কাস চলবে। এরপর দুপুরের খানা প্রায়ই আলু-গোশত। খানা শেষে আরেকটি হুঁইসেল। এবার যেতে হবে হাতের কাজ শিখতে। ওই ভবনেরই বিভিন্ন রুমে শেখানো হয় জুতা তৈরি, সেলাই, কাঠমিস্ত্রি অথবা ছাপাখানার কাজ। চার্লি কাঠমিস্ত্রির কাজে ঢুকে পড়ল। কিছু দিনের মধ্যেই কাজটি তার ভালো লেগে গেল।

লিওপোল্ড হাউজের দিনগুলো কেটে যেতে লাগল খুব ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে। ফলে খুব বেশি বন্ধুবান্ধব জুটল না তার। যে কয়েকজন বন্ধু হলো তার মধ্যে পিটার তার খুব প্রিয়। পিটার হলো সেই ছেলেটি, যে প্রথম দিন তার ছবি তুলেছিল। এখানে আসার আগে পিটারকে লালন-পালন করত তার দাদী। দাদী মারা যাওয়ার পর ওই বাড়িতে সে একা এক সপ্তাহ ছিল। পরে এক প্রতিবেশী তাকে এই হোমে ভর্তি করিয়ে দেয়। চার্লির আরেক বন্ধু বিল। একেবারে শিশু অবস্থায় কে যেন তাকে এই হোমের দরজায় গোপনে ফেলে রেখে যায়। কারা তার মা-বাবা, কিছুই জানে না বিল। এদের কাহিনী শুনে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করল চার্লি। নাই বা থাকতে পারল সে পরিবারের সাথে, তার মা তো অন্তত আছে!

একদিন হোমের গভর্নরের অফিসে ডেকে পাঠানো হলো চার্লিকে। শুনে ভয়ে পা কাঁপতে থাকল চার্লির সে কি কোনো ভুল করে ফেলেছে?

গভর্নর তার টেবিলে কী যেন পড়ছিলেন। চার্লি ঢুকতেই মুখ তুললেন। বললেন যে, যদিও চার্লির বয়স এখনো ১৪ বছর হয়নি, কিন্তু সে মেডিক্যাল টেস্টে পাস করেছে এবং কানাডা যাওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে এসএস সিসিলিয়ান স্টিমারে করে যে ২১৭ জন বালক কানাডায় কাজ করতে যাবে, চার্লিও তাদের সাথে যেতে পারবে।

শুনে চার্লির বুক কেঁপে উঠল। ঘটনা তাহলে এই? মা তার জন্য যা চেয়েছিলেন তা-ই ঘটতে যাচ্ছে? চার্লির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন গভর্নর : কঠোর পরিশ্রম করো। যেখানে যা কিছু শেখার শিখে নিয়ো। নতুন জায়গায় অনেক সুযোগ অপেক্ষা করছে।

যেসব ছেলে দর্জির কাজ শিখছে, পরবর্তী দুই সপ্তাহ তারা কানাডাযাত্রী প্রত্যেকের জন্য দুই কোর্স করে কালো স্যুট বানাল। দু’টির মধ্যে যেটি ভালো সেটি কাঠের বাক্সে ভরে নিলো তারা। বাক্সে আরো ভরল দু’টি শার্ট, উলের মোজা, জুতার ব্রাশ, মোজা ছিঁড়ে গেলে সেলাই করার জন্য সুঁই ও উল, কাজের পোশাক এবং একটি বাইবেল। চার্লি তার ভালো স্যুটটির পকেটে যত্ন করে গুঁজে নিলো তার বাবার সেই বটল ওপেনারটি।

এ সময় একটি কথা শুনে চার্লি একেবারে ভেঙে পড়ল কানাডা যাওয়ার আগে তাকে পরিবারের কারো সাথে দেখা করতে দেয়া হবে না। চার্লির মন আর মানে না। সে একবার মাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না, আর্থারকে বলতে পারবে না কিভাবে এত তাড়াতাড়ি সে যেতে পারছে!

অবশেষে শেষের সে দিন এসে গেল। তার চুল ছোট করে ছেঁটে দেয়া হলো। নতুন স্যুট পরে বিদায়ী ছবি তোলার জন্য পাঠানো হলো পিটারের কাছে। পিটার এ সময় তার কালো পোশাক নিয়ে রসিকতা করল, তাকে হাসানোর অনেক চেষ্টা করল। চার্লির মন আরো খারাপ হয়ে গেল এই বন্ধুটিকে সে সত্যিই মিস করবে। বাবার মৃত্যুর পর থেকে তার জীবনে বিদায়ের পাট যেন চুকছেই না।

 সোনালি সেতুবন্ধন

লিভারপুলগামী ট্রেনে উঠে ছেলেদের উত্তেজনা তুঙ্গে উঠল। তারা যেন ভাবতেই পারছে না যে, সত্যি সত্যিই একটি বিরাট জাহাজে চড়ে তারা আটলান্টিকের ওপারে যাবে। উত্তেজনায় তারা কল কল করছে। একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছে। ডকে এসে তাদের সাথে যোগ হলো ১১৩ জন মেয়ে। তারাও বার্নার্ডো হোমের এবং অচেনা দেশে যাত্রার আনন্দে বিভোর।

লিওপোল্ড হাউজের গভর্নর এ সময় যাত্রীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন। বললেন, ড. বার্নার্ডো একদা আটলান্টিক পাড়ি দেয়াকে সোনালি সেতুর সাথে তুলনা করেছিলেন, যার এক প্রান্তে আছে অন্ধকারাচ্ছন্ন ইংল্যান্ডের বিষাদ আর অপর প্রান্তে রয়েছে বিশাল কলোনিয়াল সাম্রাজ্যের অন্তহীন সম্ভাবনা।

চলন্ত জাহাজের ডেকে বসে চার্লি তাকিয়ে দেখল, ইংল্যান্ডের উপকূল ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। তার নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল। মা, ভাই আর্থার এবং বোনদের দূরে ফেলে সে কোথায় চলেছে! তাদের সাথে কি আর কখনো দেখা হবে!

একজন বয়স্ক লোক এসে সবাইকে জাহাজের নিচতলার কম্পার্টমেন্টে নিয়ে গেলেন। ঠাসাঠাসি চার স্তরের বাল্ক, ৬০ জন থাকার মতো। চার্লি নিচের দিকে একটা বাল্ক দখল করল।

জাহাজ যতই গভীর পানির দিকে যেতে থাকল, আটলান্টিকের প্রবল ঢেউয়ের ধাক্কায় ততই এপাশ-ওপাশ দুলতে লাগল। জাহাজের ক্রমাগত দুলুনিতে অনেকে বমি করতে লাগল, অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তবে ডেকে চলে গিয়ে চার্লি অনেকটা ভালো ছিল। সেখানে খোলা বাতাস থাকায় অসুস্থতার আক্রমণ অনেকটা হালকা ছিল। বার্নার্ড হোমের মেয়েরাও ছিল ডেকে। চার্লি দেখে, প্রবল বাতাসে মেয়েদের লম্বা চুলগুলো ঠিক রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়ছে। সে আরো দেখে, ফার্স্ট কাসের যাত্রীদের এসব কিছুই স্পর্শ করছে না। তারা প্রাতঃভ্রমণ করছে। পশুর লোমের কোট পরা নারী ও পুরুষ যাত্রীরা হাসাহাসি করছে। তাদের মনে হচ্ছে ধনী ও উষ্ণ। ওখান থেকে সঙ্গীতের সুরধ্বনি ভেসে আসছে নিচে, ডেকে।

সমুদ্রে সপ্তম রাত। ভয়াল এক ঝড়ের কবলে পড়ল এসএস সিসিলিয়ান। সমুদ্রপীড়া আবার ফিরে এলো এবং ভয়ালতর চেহারা নিয়ে। নিচের কেবিনের বাল্কে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা ছেলেরা ‘মা, মা’ বলে কাঁদতে থাকল।

ঝড় দু’দিন ধরে চলল। এবার ডেকে উঠে এলো চার্লি। দেখল, জাহাজটিকে ঘিরে রেখেছে ঘন কুয়াশা। চার দিকে সুচিভেদ্য নীরবতা। এর মধ্যেই জাহাজ ভেসে চলেছে। মনে হচ্ছে একে বুঝি আর কোনো দিনই দেখা যাবে না। যেন সবই স্বপ্নে ঘটছে, শুধু সে জেগে আছে।

১০ মার্চ তাদের জাহাজ এসএস সিসিলিয়ান হেলিফক্স এসে পৌঁছল। ১৩ দিন সমুদ্রে কাটিয়ে কানাডার পথে ‘সোনালি সেতু’ পাড়ি দিলো চার্লি।

এরপর সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো ট্রেন স্টেশনে। ট্রেন যাবে টরেন্টো। সময় লাগবে দুই দিন। ট্রেন যখন কুইবেক ও ওন্টারিও হয়ে টরন্টোর দিকে যাচ্ছিল, চার্লি দেখল দুই পাশে বিশাল বনভূমি; এর যেন শেষ নেই। লন্ডন আসার পথে যে গ্রামাঞ্চল দেখেছিল, তার সাথে এই রেলপথের দুই ধারের কোনো মিল নেই।

দু’দিনের ট্রেনজার্নির ধকলে কান্ত ছেলেরা অবশেষে কানাডা পৌঁছল। ঘোড়ায় টানা একটি ওয়াগনে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হলো কানাডিয়ান ডিস্ট্রিবিউটিং সেন্টারে। হোমের সুপারিনটেনডেন্ট মানুষটা ভালো। তিনি ছেলেদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, তোমরা সবাই তো খুব কান্ত। নতুন হোমে যাওয়ার আগে এখানে ক’টা দিন একটু জিরিয়ে নাও।

তিন দিন পর চার্লিকে বলা হলো তাকে যেতে হবে ইনকারম্যান এলাকায়। ওটি অটোয়া উপত্যকার একটি ছোট শহর। সেখানে এক কৃষকের খামারে কাজ করতে হবে তাকে। ওই কৃষকের নাম এন স্লিঙ্গার। এরপর তাকে একটি চুক্তিনামা দেয়া হলো সই করার জন্য। চুক্তি অনুযায়ী চার্লি ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ওই কৃষকের কাজ করতে বাধ্য। এর বিনিময়ে সে থাকা, খাওয়া, পোশাক ও অন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাবে। এ ছাড়া নিয়োগকর্তা তাকে মাসে এক ডলার বেতন এবং বার্ষিক ১৫ ডলার ফি দেবেন। তবে এই টাকা তার হাতে দেয়া হবে না, পাঠানো হবে ডিস্ট্রিবিউটিং সেন্টারে। তারা চার্লির নামে কানাডিয়ান ব্যাংক অব কমার্সে সেগুলো জমা রাখবেন। বয়স ২১ বছর হলে সে ওই টাকা তুলে নিতে পারবে।

১৩ বছর বয়সী চার্লি চুক্তিতে সই করল।

কানাডায় নতুন জীবন

পরদিন বেলা ২টায় চার্লিকে ইনকারম্যানগামী ট্রেনে তুলে দেয়া হলো। পাঁচ ঘণ্টার পথ। যেতে যেতে জানালা দিয়ে দেখল মাইলের পর মাইল অচেনা দেশ ঠাণ্ডা, সমতল ও বৃক্ষহীন। এটাই তার নতুন বসতভূমি।

কন্ডাক্টর যখন ট্রেন ইনকারম্যান আসার ঘোষণা দিলো, তখন চার দিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। ট্রেন থেকে চার্লির ট্রাঙ্ক নামিয়ে দিলো, তাকে শুভেচ্ছা জানাল কনডাক্টর। জনশূন্য স্টেশনের অন্ধকার প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে চালিয়ে চার্লি দেখতে পেল, রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে হালকা ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে ট্রেনটি ছুটে চলেছে। ভয়ে ও শীতে কাঁপতে কাঁপতে নিজের চার পাশে একবার তাকাল সে। নাহ, প্লাটফর্মে কেউ নেই, আছে শুধু জমাট আঁধার। এবার সে প্লাটফর্মের একমাত্র টিমটিমে আলোটির নিচে ধপ করে বসে পড়ল। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ভাবল, এই রাতটা যেভাবে হোক, এখানেই কাটাতে হবে, যা করার কাল সকালে।

খুব ভোরে কে যেন কর্কশ গলায় তার নাম ধরে ডাকতেই ঘুম ছুটে গেল চার্লির। সে চোখ মেলে দেখল, সামনে একটি ঘোড়া, একটি ওয়াগন এবং ঢ্যাঙামতো এক লোক দাঁড়িয়ে। তার মাথার টুপি সামনের দিকে প্রায় চোখ পর্যন্ত নেমে এসেছে। লোকটি দ্রুত চার্লির ট্রাঙ্ক ওয়াগনে তুলে নিলো। এই লোকটিই চার্লির নতুন বস মি. স্লিঙ্গার।

ঘোড়ায় টানা ওয়াগনটি ছুটে চলল। চার্লি বসেছে স্লিঙ্গারের পাশে। স্টেশন থেকে স্লিঙ্গারের খামারবাড়ি আধ ঘণ্টার পথ। এতটা পথ পর্যন্ত লোকটি চার্লির সাথে একটি কথাও বলল না।

অবশেষে স্লিঙ্গারের খামারবাড়িতে পৌঁছল তারা। চাষি বৌটি একটি ড্রেসিং গাউন পরে ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিল। রুক্ষ, মায়াহীন চেহারা। সে চার্লিকে হাত ইশারায় বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা অগোছালো রুমে একটি ছোট খাট দেখিয়ে দিলো। চার্লির শরীর তখন কান্তিতে ভেঙে আসছে। সে তার জিনিসপত্র খোলারও অপেক্ষা করল না, সোজা লম্বা হয়ে খাটে শুয়ে পড়ল। কম্বলটা টেনে গায়ে জড়িয়ে নিলো। ম্যাট্রেস থেকে স্যাঁতস্যাঁতে খড়ের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। সে শুয়ে শুয়ে পাশের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা চাষিদম্পতির কথা শুনতে পেল। তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। স্লিঙ্গার বলছে, ‘এইটা তো এক্কেবারে বাচ্চা ছেলে। একে দিয়ে তো ভারি কোনো কাজই করানো যাবে না।’

দেয়ালের বোর্ডের ফাঁকফোকর দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে। কম্বলের ভেতরও চার্লির খুব শীত লাগতে লাগল আর নিজেকে মনে হলো ভীষণ নিঃসঙ্গ। তার ভাবতে কষ্ট হলো, মা কি তাকে এই জায়গায় দেখতে চেয়েছিলেন, এই কৃষিখামারে, যেখানে চার পাশে একটাও দয়ালু মানুষ নেই! চার্লি তার দুই চোখ বন্ধ করে ফেলল, কিন্তু বন্ধ চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ঈষদুষ্ণ পানি। কিছুক্ষণ পর জামার হাতা দিয়ে দুই চোখ মুছে ফেলল সে। এবার নিজেই নিজেকে বলতে লাগল, ভালো লাগুক আর না-ই লাগুক, এটাই তোমার নতুন জীবন। এটা এভাবেই চলবে। তুমি তো ওর এখানে কাজ করবে বলে কাগজে সই দিয়েছ। শোন, স্লিঙ্গারকে দেখিয়ে দাও যে তুমিও অন্য সবার মতো কঠোর পরিশ্রম করতে পারো।

লিওপোল্ড হাউজের গভর্নরের সেই কথাটি মনে পড়ল তার : কঠোর পরিশ্রম করো। যেখানে যা কিছু শেখার, শিখে নিয়ো। নতুন দেশে বিরাট সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে।

প্রথম দিন সকালে চাষি তাকে নিয়ে গেল মাঠে। সেখানে দু’টি ঘোড়া অবিশ্রাম লাফালাফি করছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। চাষি বলল, ‘এই ঘোড়া দুটো লাঙ্গলে জুড়ে এই জমিটা চাষ দেয়া শিখতে হবে তোমাকে।’ কিন্তু ঘোড়াগুলোকে যত দেখে ততই ভয়ে বুক জমে যায় তার। সে অনেক কষ্টে জোয়ালটা নিজের কাঁধে তুলে নিলো, কিন্তু কিছুতেই সেটা ঘোড়ার ওপর ঠিকমতো ছুড়ে ফেলতে পারল না। কারণ, কাজটা করার জন্য আরো লম্বা হওয়া দরকার। সে বারবার চেষ্টা করতে লাগল। এবার ক্ষেপে গিয়ে নিজেই এগিয়ে এলো স্লিঙ্গার। ভারী জোয়ালটা জোরে ছুড়ে মারল। ঘোড়াটি লাফ দিলো। ভয় পেয়ে এক লাফে পেছনে সরে এলো চার্লি। এতে আরো ক্ষেপে গেল চাষি। সে চার্লির পিঠে দুম দুম করে ক’টা কিল বসিয়ে দিলো।

অবশেষে সব কাজ শেষ হলো। চাষি দু-এক চক্কর দিয়েই চার্লিকে ধরিয়ে দিলো লাঙ্গল। বলল, সোজাভাবে চালাবে, আঁকাবাঁকা না হয় যেন। চার্লি চাষ শুরু করল, কিন্তু কিছুতেই সোজা চলে না। এভাবে দিনভর চলল। দিনশেষে কান্তশ্রান্ত হয়ে খামারে ফিরেই ঠাণ্ডা বিছানাটিতে শুয়ে পড়ল।

পরদিন আবার। তার পরদিনও। এভাবে এক সময় দুটো জমিই ফসল বোনার জন্য তৈরি হয়ে গেল। চার্লি ভাবল, চাষি এবার তাকে বলবে, ‘বেশ ভালো করেছ তো ছেলে!’ কিন্তু না, সে প্রশংসা কোনো দিনই আসেনি। বরং চাষি বলল, ‘আগামীকাল ভালো করে মই দিতে হবে কিন্তু!’

মই দেয়া কি, চার্লি জানতই না। দেখল পর দিন সকালে। পর দিন পুরো জমি সমান না হওয়া পর্যন্ত মই চালাল। এই পুরো দিন চাষি একটা কথাও বলল না চার্লির সাথে। জমি তৈরি হয়ে গেলে তারা সারি বানালো। যবের বীজ বুনল।

মাঠের কাজ শেষ। এবার চার্লিকে প্রতিদিন দুটো কাজ করতে হয়। একটা হলো জ্বালানির জন্য কাঠ চেরাই করা আর দ্বিতীয়টা খামারের ৩২টি গাভীর দুধ দোয়ানো। দিনে দু’বার দুধ দোয়াতে হয়। প্রথমবার খুব ভোরে। আর সারা দিন কাঠ চেরাই করে শরীরে যখন এক ফোঁটা বলও থাকে না, তখন অর্থাৎ রাতে আবার। এ কাজ করতে করতে ুধায়, পরিশ্রমে অনেক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ত। চাষি দেখতে পেলে তাকে ‘নির্বোধ এতিমের বাচ্চা’ বলে গাল দিত। শুনে চার্লি ভাবত যে সে তো এতিম নয়। তার তো মা আছে। সে নির্বোধও নয়। স্লিঙ্গাররা তো কখনো তার কাছে তার বাড়ির কথা জানতে চায়নি!

মায়ের চিঠি

প্রতি মাসেই মায়ের চিঠি আসত চার্লির কাছে। চার্লিও মাকে লিখত। কিন্তু কখনো খারাপ কিছু জানাত না। কারণ, তাহলে মা যে চিন্তায় পড়ে যাবেন। সে লিখত প্রতি রোববার সকালে স্লিঙ্গাররা তাকে গির্জায় নিয়ে যায়। সে অক্টোবরের শুরুতে প্রথম তুষারপাতের কথা লিখত। বলত, বরফের নিচে সব মাঠ ঢাকা পড়ে গেছে। গাছগুলোকে মনে হচ্ছে যেন একেকটি ক্রিসমাস কার্ড। চার্লি তুষার দিয়ে বল বানিয়েছে আর মজা করে সেগুলো ছুড়ে দিয়েছে কাকদের দিকে।

শীতকাল এলো। চার্লি থাকে বারান্দার শেষ প্রান্তের সেই ভাঙা ঘরে। তার কাঠের বেড়ার ফাঁক দিয়ে হু হু করে শীতের হাওয়া ঢোকে। চার্লি তার সব কাপড়জামা গায়ে জড়ায়, তবুও শীত মানে না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তার কফ ও কাশি শুরু হয়। এত কষ্টের মধ্যেও সে একটা জিনিস হাতছাড়া করে না সেটা তার বাবার বটল ওপেনার।

চার্লির এই খামারে আসার বছরখানেক তখন হয়ে গেছে। মার্চ মাসের এক দিনে চার্লি মাঠ থেকে ফিরে দেখে, চাষি ও তার বৌয়ের সাথে কথা বলছেন শহুরে এক ভদ্রলোক। তিনি নিজের নাম বললেন আর্মস্ট্রং। টরন্টোর বার্নার্ডো সেন্টারের ইন্সপেক্টর তিনি। চার্লি অন্য ছেলেদের কাছে আগেই শুনেছিল যে, তাদের দেখতে হোম থেকে কেউ একজন যাবেন। সেই কেউ একজন এসেছেন। চার্লি ভাবল, তাকে যে পেটভরে খেতে দেয় না, ঠাণ্ডায় থাকতে হয়, সব বলে দেবে সে। কিন্তু এরপরই তার মনে হলো, এসব কথা বলে দিলে ইন্সপেক্টর চলে যাওয়ার পর তার অবস্থা তো আরো খারাপ হবে। কাজেই ইন্সপেক্টর যখন তার কাছে জানতে চাইলেন যে, সে কেমন আছে, চার্লি বলল : ‘আমি ভালো আছি।’ কিন্তু চার্লির মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বুঝি বিশ্বাস হলো না মি. আর্মস্ট্রংয়ের। এবার জানতে চাইলেন খামারের কাজকর্ম কেমন লাগছে তার। চার্লি জবাব দিতে গিয়ে আর কথা শুরুই করতে পারল না। অনবরত কাশতেই থাকল। কাশি আর থামেই না।

মি. আর্মস্ট্রং এবার চার্লি কোথায় থাকে দেখতে চাইলেন। তার ছোট খাটটির ওপর বসে তিনি চার্লির চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘বাবু, কী হয়েছে বল তো আমাকে!’ চার্লির মনে হলো এই মানুষটাকে বিশ্বাস করা যায়, তাকে সব বলা যায়। মি. আর্মস্ট্রং সব শুনলেন, তারপর আদর করে চার্লির পিঠ চাপড়ে দিলেন এবং স্লিঙ্গার ও তার বৌয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

আট দিন পর খামারে অচেনা আরেক লোক এলেন। বললেন যে, তাকে পাঠিয়েছে টরন্টোর ডিস্ট্রিবিউটিং সেন্টার। তিনি চার্লিকে নিতে এসেছেন। চার্লিকে এবার পাঠানো হবে আরেক চাষির খামারে। তার নাম মি. করবিন। জায়গাটা ওখান থেকে ৫০ মাইল দূরে।

ভালো মানুষের কাছে

মি. করবিনের খামারে পৌঁছে চার্লির তাক লেগে গেল। এখানে সব কিছু স্লিঙ্গারদের উল্টো। মিসেস করবিনকে দেখে মায়ের মতোই মনে হলো চার্লির। শুধু তার মা হালকা-পাতলা, আর মিসেস করবিন মোটাসোটা। মি. করবিন মানুষটিও ভারী দয়ালু। সর্বক্ষণ তার মুখে হাসি লেগেই আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই দম্পতির আছে ছয় বছর বয়সী দুই কন্যা মিলি ও ইউনিস। তারা যখন খামারে ছোটাছুটি করে বেড়ায়, চার্লির তখন তার নিজের বোনদের কথা খুব করে মনে পড়তে থাকে।

মি. করবিনের তিন একর জমি। ওতে তিনি শাকসবজি ও ফলমূল আবাদ করেন। জমির চার দিক ফলের গাছ দিয়ে ঘেরা। চার্লিকে থাকতে দেয়া হয়েছে চিলেকোঠার একটি ঘরে। রুমটি বেশ আরামের। স্লিঙ্গার ও মি. করবিনের খামারের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি হলো, এখানে হাসিখুশির কোনো অভাব নেই।

শীতের পর এলো বসন্ত। চার্লি জমিতে গাজর, মসুর, শালগম ও ভুট্টা লাগাল। সে ইতোমধ্যে শিখে ফেলেছে আলুক্ষেত ও শিম লতার পরিচর্যা কিভাবে করতে হয়। প্রতিদিন যমজ দুই বোনকে সাথে নিয়ে চার্লি মুরগিকে দানাপানি খাওয়ায়। খোঁয়াড় থেকে তাদের ডিম কুড়িয়ে নেয়। খামারে একটিমাত্র গাভী আছে, সেটির দুধ দোহায়। এসব করেও অনেক সময় হাতে থেকে যায় চার্লির। সে তখন ছোট মেয়ে দু’টির সাথে খেলায় মেতে ওঠে। তাদের সাথে লুকোচুরি খেলে। তাদের কাগজের নৌকা বানাতে শেখায়। নইলে শুধু শুধু দৌড়াদৌড়ি করে ওদের সাথে। কোনো সময় মি. করবিন মাছ ধরতে যাওয়ার সময় চার্লিকে সাথে নেন। দেখা যায়, তারা বড়সড় একটা ট্রাউট মাছ নিয়ে ফিরেছেন। মিসেস করবিন খুশিমনে মাছ কুটতে বসে যান। রান্নাবান্নায় তার খুব আনন্দ। চার্লির ১৫তম জন্মদিন পালন করে তাকে চমকে দেয় করবিন পরিবার। এ উপলক্ষে তারা একটি কেক কাটে। তাকে অনেক উপহারও দেয়।

এভাবে দুই বছর কেটে যায়। ইংল্যান্ড থেকে মায়ের চিঠি আসে। চিঠি এলেই মিসেস করবিন ও তার দুই মেয়ে চার্লির বাড়ির গল্প শুনতে চান। এর মধ্যে আর্থারের বয়স ৯ বছর হয়ে গেছে। সে বড় ভাইকে চিঠিতে জানায়, সেও কানাডা আসার অপেক্ষায় আছে। বোন ফ্রেডা ও এডি এতিমখানা ছেড়ে স্থানীয় হোটেলে কাজ নিয়েছে। সবচেয়ে ছোট যে বোনটি, নেলি, তার বয়সও এখন চার। তারও স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে এলো বলে! তাদের সবার কথা খুব মনে পড়তে থাকে চার্লির। কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে তার মনে হয়, সে এখন ‘ঠিক জায়গাতেই’ আছে।

শরৎকাল এলে মি. করবিন ও চার্লি দু’জনই শীতকালের জন্য বেশ ক’দিন জ্বালানি কাঠ কাটল। এ সময় চার্লি নিজেও বুঝতে পারল যে, সে আর ছোটটি নেই, মি. করবিনের মতো শক্তসামর্থ্য জোয়ান হয়ে উঠেছে। কাজ করতে আগের মতো কষ্ট হচ্ছে না তার। লম্বাও হয়েছে অনেক।

এ সময় এক দিন খামারে এলেন মি. আর্মস্ট্রং সেই ইন্সপেক্টর। মি. করবিন তাকে বললেন, ‘ইন্সপেক্টর, এই ছেলেকে না পেলে আমি যে কিভাবে চলতাম, ভেবেই পাই না’। এবার চার্লিকে জিজ্ঞেস করলেন ইন্সপেক্টর এখানে তার কেমন কাটছে। চার্লি ছোট মেয়ে দুটোকে কাছে টেনে নিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে বলল, ‘এই বাঁদরগুলো না থাকলে আরো ভালো হতো।’

সে রাতে ঘুমুতে গিয়ে নিজেকে খুব সুখী মনে হলো চার্লির। মনে হলো সে এখানে নিজেরই আরেকটি বাড়িতে আছে।

 মহাযুদ্ধের দামামা

১৯১৪ সালের বেজে উঠল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। বার্নার্ডো হোমের ছয় হাজারেরও বেশি বালক যুদ্ধে অংশ নিলো। তাদের মতো চার্লিও চাইল দেশের জন্য যুদ্ধ করবে। সে যোগ দিলো কানাডিয়ান আর্মিতে। ১৯১৬ সালের গ্রীষ্মকালে তার পোস্টিং হলো ইংল্যান্ডে। নিজের দেশে ফিরে সে উদগ্রীব হয়ে রইল কখন মা ভাই ও বোনদের দেখা পাবে। কিন্তু না, হলো না। তার ব্যাটালিয়ন যুদ্ধে অংশ নিতে ফ্রান্স চলল।

১৭ নভেম্বরের এক ভোরবেলায়, যুদ্ধ চলছে, সামনে অগ্রসর হতে গিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল চার্লি। সে ঘুরে পড়ে গেল কাদায়। রাইফেল দূরে ছিটকে পড়ল। তার ডান হাতে গুলি লেগেছে।

চার্লিকে আবার ইংল্যান্ড ফেরত পাঠানো হলো। অবাক কাণ্ড হচ্ছে, হাসপাতালটি তার নিজের শহর সাউদাম্পটনে। চার্লির আর মন মানে না। ছয় বছর আগে সে এই শহর ছেড়েছে। এত দিন পরে মা ভাই বোন সবাইকে দেখতে পাবে! উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে চার্লি। দেখা পায়ও। তবে চোখের পানিতে ভেজা পুনর্মিলনটি হয় খুবই সংক্ষিপ্ত।

এ দিকে হাসপাতাল থেকে বলা হয়, চার্লি রাইফেল চালাতে অক্ষম। এরপর তাকে যুদ্ধের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং কানাডায় ফেরত পাঠানো হয়। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর যুদ্ধ যখন শেষ হয় চার্লি তখন কিংসটনে মিলিটারি পুলিশে কাজ করছিলেন। ওই ডিসেম্বরে ‘সম্মানসূচক অবসর’ দেয়া হয়।

পুলিশের চাকরি থেকে ছাড়া পেয়ে চার্লির তখন একটাই গন্তব্য : মি. করবিনের খামারবাড়ি। চার্লিকে পেয়েই ছুটে এলো যমজ দুই বোন। তারাও তখন বড় হয়েছে, কিন্তু এত বড় নয় যে, চার্লি তাদের কোলে ওঠাতে পারবে না। তারা তার কোল থেকে নামতেই চায় না।

চার্লির ফেরার খবর চাউর হতে দেরি হয় না। বীর সৈনিক হিসেবে টাউন হলে তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়, তার সম্মানে আয়োজন করা হয় ভোজসভার। চার্লি সবচেয়ে অবাক হয় যখন সন্ধ্যায় তাকে এক তোড়া টাকা উপহার দেয়া হয়।

পুলিশের কাজটা ভালোই লেগে গিয়েছিল চার্লির। এবার সে যোগ দেয় নর্থ-ওয়েস্ট মাউন্টেড পুলিশে। বছরখানেক পর বোন ফ্রেডার একটি চিঠি পায় চার্লি। ফ্রেডা লিখেছে : ‘মায়ের নিউমোনিয়া হয়েছে’। চার্লির বুক কেঁপে ওঠে। এই রোগেই তো তার বাবা মারা গিয়েছিল। সে অনুভব করে তার এখন পরিবারের সাথে থাকা উচিত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুলিশের চাকরিটা ছেড়ে দেয় সে, আর সাউদাম্পটনের উদ্দেশে জাহাজে চড়ে বসে।

বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে বসে চার্লি। সবচেয়ে ছোট বোনটি, নেলি, মায়ের সাথেই থাকে। চার্লি একটা মালির কাজ খুঁজে নেয়। এ দিকে মা-ও ভালো হয়ে উঠছেন। চার্লি ভাবে, বাবা বেঁচে থাকলে এই কাজটাই (মা ও বোনের ভরণপোষণ) তো করতেন। বাবার কাজটাই আমি করছি।

এ দিকে ছোটভাই আর্থারের কানাডায় অভিবাসী হওয়ার স্বপ্নও পূরণ হলো। আলবার্টায় একটি পশুখামারের কাজ নিয়ে ১৯২৩ সালের গ্রীষ্মকালে সে কানাডা যাত্রা করল। তাকে বিদায় জানাতে ডকে গেল চার্লি। বাড়ি ফিরে নিজের ভবিষ্যৎ ভাবতে বসল এবার সে সে কি বাকি জীবনটা ইংল্যান্ডে কাটাবে, নাকি কানাডা ফিরে যাবে?

ছেলের মনের টানাপড়েন বুঝতে দেরি হলো না মায়ের। এক দিন তিনি ছেলেকে ডেকে কাছে বসালেন। বললেন, ‘আমার সোনার টুকরো ছেলে, তুমি আমাদের সাহায্য করার জন্য ইংল্যান্ড থেকে যেতে চাচ্ছ, সেটা আমি জানি।’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, ‘কিন্তু বাপ আমার, তুমি কোথায় থাকতে চাও, সেটা তোমার নিজেকেই ঠিক করতে হবে।’

চার্লি জানত তার ভবিষ্যৎ দিনগুলো কোথায় কাটবে। এবার তাকে বিদায় দিতে ডকে এলেন তার মা। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে থাকলেন অনেক, অনেকক্ষণ। মুখে কিছু না বললেও দু’জনেরই মনে মনে জানা হয়ে গেল, এ জীবনে আর কোনো দিন তাদের দেখা হবে না।

 পাদটিকা : কানাডা ফিরে আবার মাউন্টেড পুলিশে যোগ দেন চার্লি। সেখানে তার অনেক পদোন্নতিও হয়। ১৯৩৩ সালে ফ্রান্সিস নামে এক তরুণীর সাথে পরিচয় ও পরিণয় হয় চার্লির। এক বছর পর জন্ম হয় তাদের প্রথম সন্তান বেরিলের, যিনি এই কাহিনীর লেখিকা। বেরিল লিখেছেন, আমি যখন এই কাহিনী লিখছি, তখনো টেবিলে আমার সামনেই আছে একটি ধাতব বটল-ওপেনার। পুরনো ও নিতান্ত তুচ্ছ একটি জিনিস। কিন্তু আমার কাছে এটি এক বিশাল ঐশ্বর্য। এ যে আমার প্রিয় বাবার স্মৃতি! অন্যদিগন্ত থেকে নেওয়া।