Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আধুনিক কোরিয়ান পরিবারে ‘ছুসক’

কোরিয়ানদের সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয় ‘ছুসক’কে। তবে দিনবদলের সাথে সাথে বদলাচ্ছে ছুসকের গুরুত্ব, তাৎপর্য। পুরনো মূল্যবোধ, ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আধুনিক কোরিয়ান সমাজে ‘ছুসক’ আসছে পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে। সে পরিবর্তনটা ঠিক কেমন? ‘কোরিয়া হেরাল্ড’ অবলম্বনে জানার চেষ্টা করেছেন মহিবুল্লাহ ত্বকি

নিজেদের সবচেয়ে বড় উৎসবটিকে সামনে রেখে বাড়ির মেয়েদের দিনরাত এক করে খাবার তৈরির ব্যস্ততা, উৎসবের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে মৃত পূর্বপুরুষদের উৎসর্গ করে বিশেষ বেদীতে খাবার সাজানো, ঐতিহ্যবাহী পোশাক হানবকে কৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নেয়া, এরপর সবাই মিলে সকালের খাবার খাওয়া ও দলবেধে স্বজনদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ‘সংপিয়ন’ নামের অর্ধচন্দ্রাকৃতির চালের পিঠা বানানো…ছুসকের এসব চিরাচরিত দৃশ্য আজকের কোরিয়াতে আর দেখা যায় না বললেই চলে।

chardike-ad
বাড়ির সবাই মিলে ছুসকের ঐতিহ্যবাহী চালের পিঠা সংপিয়ং বানানোয় ব্যস্ত একটি কোরিয়ান পরিবার
বাড়ির সবাই মিলে ছুসকের ঐতিহ্যবাহী চালের পিঠা ‘সংপিয়ন’ বানানোয় ব্যস্ত একটি কোরিয়ান পরিবার

যুগকাল আগের এসব রীতি হয়তো অদূর ভবিষ্যতে রূপকথায় ঠাই নেবে। আধুনিক কোরিয়ানরা ছুসকের লম্বা ছুটিতে বাইরে ঘুরতে যেতেই বেশী পছন্দ করে। শহর থেকে গ্রামে গিয়ে পরিবারের সাথে ছুটি কাটানোর চলটাও কমে আসছে। আজকাল বরং বাবা-মায়েরাই গ্রাম থেকে শহরে ছেলেমেয়েদের দেখতে যান।

দুয়ো নামের একটি ম্যাচমেকিং এজেন্সীর সাম্প্রতিক জরিপে অংশ নেয়া ১৪২টি দম্পতির ৭৮ শতাংশই জানিয়েছে তাঁরা এবারের ছুসকে বাবা-মার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশী ৩১ শতাংশ কারন হিসেবে বলেছে তাঁদের বাবা-মায়েরা অতো দূরের পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি যেতে জোর করেন না; ২৯.৭ শতাংশের অন্য কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে; ১৪.৪ শতাংশ ঘরে বসে বিশ্রাম নিতে চান আর ১০.৮ শতাংশ ছুটিতে বাড়িমুখী জনস্রোত ঠেলে কোথাও যাওয়ার আগ্রহ পান না বলে উল্লেখ করেছেন। কুড়ি থেকে চল্লিশ বছর বয়সী বিবাহিত কোরিয়ান দম্পতিদের উপর এ জরিপ চালানো হয়।

বাড়ি না গিয়ে ছুটিতে অন্য কোথাও ঘুরতে যাওয়াদের দলের বাইরে ২৮.৮ শতাংশ বাইরে খাওয়াদাওয়া করবে, ২১. ৬ শতাংশ শুয়েবসে কাটাবেন আর ৯ শতাংশ অন্যান্য সাপ্তাহিক ছুটিতে যা করেন তাই করবেন।

কোরিয়া ইন্সটিটিউট অব হেলথ এন্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ারসের (কেআইএইচএএসএ) একজন গবেষক কিম ইয়ু খিয়ং বলছিলেন, “মানুষের মাঝে পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা কমে আসছে। ঐতিহ্য অনুসরণের চেয়ে এখন সবাই ছুটিটা নিজেদের মতো উপভোগ করতেই বেশী পছন্দ করে।”

কিম মনে করেন কোরিয়ান পরিবারগুলো দিনকে দিন গণতান্ত্রিক হয়ে উঠছে। পিতামাতাকেন্দ্রিক পরিবারের ধারা লুপ্ত হয়ে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক বেশী স্বাধীনতা দিচ্ছেন। ফলে দুই প্রজন্মের উৎসব উদযাপনের ধরণেও ভিন্নতা চলে আসছে।

কোরিয়ান সমাজে আধুনিকীকরণের অংশ হিসেবে অনেক সংস্কারেই পরিবর্তন আসছে। কোন একটা কাজ বিশেষ কাউকেই করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা থেকে কোরিয়ানরা বের হচ্ছে। আধুনিক সমাজ এমনটাকে এক ধরনের দ্বাসত্ব হিসেবেই মনে করে। বর্তমান পরিবারগুলো তাই কারও উপরই কোনকিছু চাপিয়ে দেয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উৎসব উপলক্ষে রান্নাবান্নার কাজটা বাড়ির মেয়েদেরই করতে হবে এমন ধ্যানধারণা বদলাচ্ছে।

কোরিয়ার নতুন মায়েদের অনলাইন কমিউনিটি জিনহেমম-এ একজন সম্প্রতি লিখেছেন, “আমার শাশুড়ি চাইছিলেন ছুসকের এক সপ্তাহ আগেই যেন আমরা সবাই একটু একত্র হই। ছুসকে রান্নাবান্না করতে হলে আমার উপর অনেক চাপ পড়ে যেত। কিন্তু খাওয়াদাওয়ার পর্বটা আমরা বাইরে সেরে নেয়ায় অনেক বড় একটা ঝক্কি থেকে বেঁচে গেলাম। আগামী বছর আমি কোথাও ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা করছি।”

তবে এতো আধুনিকতা আর পরিবর্তনের হাওয়ার মাঝেও কোরিয়ায় ছুসক ও নববর্ষের মতো বড় উৎসবগুলোতে রকমারি রান্নাবান্নার কাজটা এখনও অনেক পরিবারেই বাড়ির মেয়েদেরই করতে হয়। আর এসব করতে গিয়ে তাঁরা ভুগছেন নানাবিধ শারীরিক সমস্যায়ও। এহোয়া ওমেন্স ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের ভাষ্যমতে, উৎসবের সময়গুলোতে গৃহিণীদের অসুস্থতাঁর বিষয়টা দিনদিন এতোই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে যে ‘ট্র্যাডিশনাল হলিডে সিন্ড্রোম’ নামে আলাদা একটি চিকিৎসাশাস্ত্রীয় শব্দই চালু হয়ে গেছে! এসব সময়ে নারীদের সবচেয়ে ‘কমন’ অসুস্থতাগুলোর মধ্যে রয়েছে কব্জির ব্যাথা, বদহজম, রজঃবৃত্তীয় সমস্যা ইত্যাদি।

মেডিক্যাল সেন্টারটির ফ্যামিলি মেডিসিনের অধ্যাপক জন হে জিন জানান উৎসবের সময়গুলোতেই এসব উপসর্গ সবচেয়ে বেশী দেখা যাচ্ছে। এগুলো অল্প ক’দিনেই সেরে যায় বলে কেউ তেমন গা করে না। তবে তাঁর আশংকা এসব ছোটখাটো সমস্যা থেকেই আচমকা বড় কোন রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।

গবেষক কিম ইয়ু খিয়ংয়ের বিশ্বাস, সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বাড়ির মহিলাদের রন্ধনশালার বন্দীজীবন ফুরিয়ে এলো বলে! “কোরিয়ান সমাজব্যবস্থা এখনও একটি পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আছে। আজকের তরুণ প্রজন্ম যেদিন সমাজের নীতিনির্ধারকের আসনে বসবে সেদিন ছুসকের তাৎপর্য ইতিবাচকভাবে বদলে যাবে।”