মাত্রই অল্প কদিন হলো বিয়ে করেছেন। এর মধ্যে এসে গেল সিউল এশিয়ান গেমস। দক্ষিণ কোরিয়া যাত্রার আগে নতুন বউকে বললেন, ‘তোমার জন্য একটা উপহার আনব।’ তা উপহার একটা এনেছিলেন মোশারফ হোসেন। শুধু বউকেই নয়, গোটা দেশকে এশিয়ান গেমসের ব্রোঞ্জ উপহার দিয়েছিলেন রাজশাহীর বক্সার।
১৯৮৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে হয়েছিল দশম এশিয়ান গেমস। ক্যারিয়ারের সোনালি স্মৃতি সারা জীবন বয়ে বেড়াতে দেশে ফিরে স্ত্রীর কাছে করেন অন্য রকম একটা আবদার, ‘আমাদের যদি ছেলে হয়, তাহলে ওর নাম রাখব সিউল। আর মেয়ে হলে সিউলি।’ পরের বছর ১৮ জুলাই স্ত্রী হনুফা হোসেনের কোলজুড়ে আসে ছেলে। নাম সিউল! মোশারফ স্বপ্ন দেখতেন, বড় হয়ে সিউলও বাবার মতো বক্সার হবে। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে এখন চলাফেরা করতে হয় হুইলচেয়ারে। কিন্তু ছেলেকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য তাঁর নেই।
১৯৭৮ সালে এশিয়াডে অভিষিক্ত বাংলাদেশের নাম প্রথম পদক তালিকায় তোলেন বক্সার মোশারফ। এর পর থেকে এশিয়ান গেমসে পদক মানেই কাবাডি। তবে এখন পর্যন্ত সেরা সাফল্য ক্রিকেটে। গুয়াংজুতে গত এশিয়ান গেমসে সোনা জেতে পুরুষ দল, রুপা জেতে নারী দল। এবারও ক্রিকেট থেকেই এসেছে মেয়েদের রুপা ও ছেলেদের ব্রোঞ্জ। আর যথারীতি মেয়েদের কাবাডিতে ব্রোঞ্জ।
মোশারফের পর এশিয়ান গেমসে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিগত পদক জিততে পারেননি কেউ। সেই দক্ষিণ কোরিয়াতেই এবার হয়ে গেল এশিয়ান গেমসের ১৭তম আসর। ইনচনেও বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় পদকমঞ্চে একা ওঠেননি। এসব প্রসঙ্গ তুলতেই কাল স্মৃতির ডানায় ভর করে ২৮ বছর আগে ফিরে গেলেন মোশারফ, ‘সেটাও ছিল অক্টোবর মাস। নেপালের এক বক্সারকে মাত্র ৩৮ সেকেন্ডে নকআউট করে সেদিন রেকর্ড গড়েছিলাম। এরপর ব্রোঞ্জ জিতলে শেফ দ্য মিশন মেজর হাফিজউদ্দিন ৫০ ডলার পুরস্কার দিয়েছিলেন। আমরা ৭২ জন বাংলাদেশি খেলোয়াড় অনেক রাত পর্যন্ত আনন্দ করেছিলাম। কোরিয়ার এক পত্রিকায় পরদিন আমার ছবিসহ বড় একটা রিপোর্ট হয়েছিল।’
বক্সার মোশারফ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৭৬ সালে। স্কুলে তাঁর ইভেন্ট ছিল শটপুট আর চাকতিনিক্ষেপ। কিন্তু ৬ ফুট দীর্ঘ মোশারফ পরে ঘুষাঘুষির খেলাটাকেই বেছে নেন। সাফল্যও আসছিল ধারাবাহিকভাবে। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত টানা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। মাঝে ১৯৮৫ সালে এসএ গেমসে জেতেন সোনা।
১৯৯০ সালে খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর নতুন কোনো ‘মোশারফ’ তৈরি হয়নি। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলক দেখিয়ে আর কেউ এশিয়ান গেমস থেকে আনতে পারেননি অন্তত একটা পদক। এসব দেখে খুব আফসোস হয় মোশারফের, ‘আমাদের দেশে ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলায় তেমন ভবিষ্যৎ নেই। তাই কেউ বক্সিংয়ে আসতে চায় না। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে বক্সারদের মাথায় তুলে রাখে।’
এখনো টেলিভিশনে বক্সিং দেখলে বুকের মধ্যে তোলপাড় হয় মোশারফের। তাঁর অবসর কাটে রাজশাহীর তালাইমারি ইয়ংমেন্স স্পোর্টিং ক্লাবে। ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদক মোশারফ জাতীয় বক্সিংয়ে রেফারির দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ফেডারেশন যে সম্মানী দেয় তাতে যাতায়াত ভাড়াই হয় না।
তাঁর উপলব্ধি, খেলাধুলা করে প্রাপ্য সম্মান জোটেনি। মাঝেমধ্যেই আন্তর্জাতিক গেমস থেকে পাওয়া পদক আর সার্টিফিকেটগুলো নেড়েচেড়ে দেখেন। এসব দেখে দীর্ঘশ্বাস ঝরে তাঁর দুই মেয়ের। বাবার মতো খেলোয়াড় হতে কখনোই আগ্রহ দেখাননি মাহমুদা হোসেন ও মাহফুজা হোসেন। তাঁরা ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে।
বক্সিং নিয়ে এখনো অনেক স্বপ্ন দেখা শেষ হয়নি মোশারফের। আন্তর্জাতিক বক্সিং ফেডারেশনের রেফারি হতে সহযোগিতা চান ফেডারেশনের। দীর্ঘদিনের ইচ্ছা, একটা বক্সিং একাডেমি গড়বেন। কিন্তু আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে যাচ্ছে।
২৮ বছর আগে বক্সিং থেকে এশিয়াডে একটা পদক এসেছিল মোশারফের হাত ধরে। আরেকটা পদক আসতে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? সূত্রঃ প্রথম আলো।