ওপরে বর্ণিত গোয়েবলসের বক্তব্যটির আবহ বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে বিরাজমান। বিশেষ করে এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকারের বইটি (১৯৭১ : ভেতরে বাইরে) প্রকাশের পর। নির্বাচন ও ভোটারবিহীন সংসদের মনোনীত সংসদ সদস্যরা বইটি লেখার জন্য এ কে খন্দকারের বিরুদ্ধে যেভাবে বিষোদগার করলেন, তাতে ওইসব সংসদ সদস্যের ভাবমর্যাদা বেশ ুণœ হয়েছে। এ ছাড়া ৫ সেপ্টেম্বর ‘আরটিভি’ রাত বারোটার আলোচনায় একজন মেজর জেনারেল, একজন তথ্য উপদেষ্টা, একজন সাবেক সচিব, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আলোচনা দেখার সুযোগ হয়েছিল; মেজর জেনারেলের বক্তব্য শুনে হতাশ হতে হলো। তার বক্তব্যে সামরিক বাস্তবতার প্রতিফলন থাকা উচিত ছিল। কারণ, বইটি মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামের ওপর লিখিত। সংসদ সদস্য ও টিভি আলোচকদের বক্তব্য থেকে বোঝা গেলÑ ০১. এ কে খন্দকার আওয়ামী লীগ থেকে এত সুবিধা পাওয়ার পর কেন আওয়ামী স্বার্থের বিরুদ্ধে এসব কথা বলতে গেলেন? ০২. স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হয়ে গেল ইতঃপূর্বে তিনি এসব ব্যাপারে লেখননি, এখন কেন লিখতে গেলেন? ০৩. মুক্তিযুদ্ধের যদি প্রস্তুতি না থাকত তাহলে মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে পরিচালিত হলো এবং তিনি কিভাবে কলকাতা গিয়ে ডেপুটি প্রধান সেনাপতি হলেন। বর্ণিত প্রশ্নের সাথে আরো অনেক প্রশ্ন সংযুক্ত হয়েছে। এখানে শুধু এ তিনটির উত্তর দিতে চেষ্টা করব।
এ কে খন্দকার একজন ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ, যুদ্ধে সশরীরে প্রথম সারিতে অংশগ্রহণকারী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা ও তখনকার অনুভূতি প্রকাশ করতে বইটি লিখেছেন। তার জ্ঞান, বুদ্ধি, ধীশক্তি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে যুদ্ধের কৌশল, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তার উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাকে সঠিকভাবে প্রকাশ করায় তিনি জাতির কাছ থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকার রাখেন। আমি এ কে খন্দকারকে যত দূর চিনি জানি ও তার সম্বন্ধে শুনেছি, তার সৎসাহস ও সত্যনিষ্ঠা দেখে অবাক হতে হলো। কারণ তার নিরীহ সহজ সরল আচরণ। তাকে ধন্যবাদ।
আমাদের সবার জানা উচিত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যিনি বাঙলার সেই ক্রান্তিকালে যেভাবে জান্তাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। বঙ্গবন্ধু কিন্তু মানুষ ছিলেন; মানুষমাত্রই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়; আর সব মানুষই তার নিজস্ব মেধার সীমাবদ্ধতার বাইরে কৃতিত্ব দেখাতে অপারগ, বঙ্গবন্ধুও কিন্তু এর ঊর্ধ্বে ছিলেন না। সেই ’৭১-এর আগস্টের উত্তাল মুহূর্তে প্রথম থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত তার বহু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অপরাগতা ও ভুলত্রুটি থাকতে পারে। তাকে অতিমানব মনে করা বা তার ত্রুটিবিচ্যুতি সম্বন্ধে আলোচনা করাকে রাষ্ট্রদ্রোহ আখ্যায়িত করা শুধু কিছু অন্ধ সুবিধাভোগী ও স্বার্থান্বেষীদের পক্ষেই সম্ভব।
তথাকথিত বঙ্গবন্ধুপ্রেমিকদের প্রথম প্রশ্নটির উত্তর ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে। এ কে খন্দকার সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে বিবেকের তাড়নায় জীবনের শেষ মুহূর্তে তার জানা ও বিবেচনার সত্য প্রকাশ করে তিনি আমাদের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। কারণ, তিনিও এর জন্ম ইতিহাসের নায়ক এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন প্রথম সারির নেতা। তার অভিজ্ঞতা ও সত্য উপলব্ধি প্রকাশ একটি সাহসী ভূমিকা। তিনি একজন নির্মোহ সত্যবাদী হিসেবে এ দেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভাজন হয়ে থাকবেন।
তাদের দ্বিতীয় প্রশ্নÑ ৪৩ বছর পর এখন তিনি কেন বইটি লিখলেন? উত্তর অতি সহজ। আওয়ামী সংসদ সদস্য ও বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞানগরিমা, লেখাপড়া জানার অপরিপক্বতাই এর কারণ। আশি-নব্বইয়ের দশকে এ কে খন্দকারের লেখাগুলোর একটি প্রবন্ধ আমি দৈনিক ভোরের কাগজে পড়েছি (তা আমার কাছে আছে)। প্রবন্ধটিতে তিনি সেই দিনগুলোতে তার কিছু কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন সে সময় তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখতে সচেতন ছিলেন। বিভিন্ন সময় বেশ কিছু সংসদ সদস্যের মাধ্যমে শীর্ষ নেতাদের জান্তার সামরিক কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে অবহিত করার প্রচেষ্টা নিয়েছি। কিভাবে জান্তা ঢাকায় তাদের সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে তা-ও জানানো হয়েছে। তাকে আরো জানানো হয়েছে, ঢাকা বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে বেশির ভাগ বিমানসেনা বাঙালি। যেকোনো অঘটন ঘটানো সম্ভব। তিনি তখন এখানে সর্বোচ্চ পদের অধিকারী বাঙালি অফিসার এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভাগেও পদস্থ। এমনকি পঁচিশে মার্চ ’৭১ ইয়াহিয়া খান যখন ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন তার প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদ আওয়ামী নেতৃত্বের শীর্ষস্থানে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো প্রতি উত্তর পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে জনাব রেহমান সোবহানের বইয়ে খন্দকার সাহেবের এক দিনের শেখ সাহেবের নিকট খবর পাঠানোর উল্লেখ পাওয়া যায়। (বাংলাদেশের অভ্যুদয়, প: ৯৫)।
এ ছাড়া ইতঃপূর্বে এ. কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মির্জার কথোপকথনের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র প্রকাশিত বইটি ২০০৯ সালে মুদ্রিত ও প্রকাশ করা হয় এবং ২০১৪ সালে ষষ্ঠবার মুদ্রিত হয়। তার (১৯৭১ : ভেতরে বাইরে) বইটি ওই প্রবন্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপথন বইটিতে সন্নিবেশিত তথ্য বইটিতে বর্ণিত হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষক ও মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুতিহীনতা সম্বন্ধে লেখা হয়েছে। (পৃ: ১১) অর্বাচীনের মতো বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রিয় পাত্র হওয়ার প্রচেষ্টায় এসব জ্ঞানান্ধ ব্যক্তিরা ইতিহাস বিকৃতির প্রয়াস পাচ্ছে, ইতিহাসে আবেগের স্থান নেই। জ্ঞান দিয়ে সঠিক তথ্যের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস চর্চা করতে হবে। শুধু গালি দিয়ে কাজ হবে না।
এবার আসা যাক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অপ্রস্তুতি প্রসঙ্গে খন্দকারের বক্তব্য ও ওইসব আওয়ামী মোজাহেদদের বিষোদগার। একে খন্দকারের বক্তব্য খণ্ডনে সঠিক তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন না করে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয়া হলো। কিন্তু সত্য গোপন থাকবে না। পাকিস্তানি জান্তা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে লারকানা বৈঠকের পর ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্য আনা শুরু করে। এ জন্য তারা করাচির বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে বেস স্টেশন স্থাপন করে। প্রতিদিন সাতটি পিআইয়ে ফাইট ও বিমানবাহিনীর সি ১৩০-এর ফাইটগুলোর মাধ্যমে সৈন্য পরিবহন করা হয়। তারা এখানে কেন সৈন্য আনা শুরু করল? কারণ ব্যালেন্স অব পাওয়ার তখন পর্যন্ত বাঙালি সৈনিকদের হাতে ছিল। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে চার-পাঁচ ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি সৈন্য ছিল আর পাঁচ ব্যাটালিয়ন বাঙালি যোদ্ধা ছিল। তার সাথে ছিল বিমানবাহিনীর বেশির ভাগ বিমানসেনা, ইপিআর, পুলিশ, এমওডিসি ও আনসার। আমাদের নেতা এসব জানা সত্ত্বে¡ও শত্রুর শক্তি বাড়ানোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলেন না। এমনকি তার ৭ মার্চের বক্তৃতায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে তিনি জান্তার যুদ্ধপ্রস্তুতির বিরুদ্ধে কথা বললেন না। তিনি তার বক্তৃতায় পাকিস্তানি পতাকার নিচে থেকে চার দফা বাস্তবায়নের দাবি তুললেন। অন্যসব বক্তব্য ছিল রেটরিক (Rhetoric), বাগ্মিতা বা বাগাড়ম্বর।
কোনো স্বল্প বুদ্ধির মানুষও বিশ্বাস করবে না, ৭ মার্চের বক্তৃতায় স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল। তাই তার বক্তৃতায় জয় পাকিস্তান বলা অসম্ভ^ব ছিল না। তার পরবর্তীকালে ১৫ ডিসেম্বর এর পর বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার আলোচনাও তার প্রমাণ। এমনকি তাজউদ্দীন লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর দিতে তার অপারগতা এবং তা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার দলিল হিসেবে ব্যবহারের আশঙ্কা প্রকাশ তার সংগ্রামে বিজয়ী হওয়া সম্বন্ধে আস্থাহীনতার প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু যদি ৭ মার্চ সাহস করে তার চার দাবির সাথে বলতেন, সৈন্য আসা বন্ধ করো, নইলে বিমানবন্দর ঘেরাও করে বন্ধ করে দেয়া হবে।’ তা হলে সৈন্য আনা বন্ধ হয়ে যেত। হয়তো হঠকারী হলে কিছু মানুষ মারা যেত। তা কিন্তু ত্রিশ লাখ হতো না, হাজারে সীমিত থাকত। জয়দেবপুর ও কুমিল্লায় অবস্থানরত আমাদের দু’টি ব্যাটালিয়ন প্রতিবন্ধক বা ডেটারেন্ট হিসেবে কাজ করত। মেজর সিদ্দিক সালেক তার লিখিত বইতে এদিকে ইঙ্গিত করেছেন।
এ ছাড়া তখন ব্রিগেডিয়ার মজুমদার চট্টগ্রামে জিওসি হিসেবে কর্মরত। তিনি ১০ বেঙ্গল ও রেজিমেন্টাল সেন্টারের সৈনিক এবং রিক্রুট ও ইপিআর সদস্য নিয়ে ফেনী নদীর শুভপুরের ব্রিজ দখলে নিয়ে নিলে বিনা রক্তক্ষয়ে বিজয় অর্জিত হতো। বর্তমানে যারা গণযুদ্ধ হিসেবে মু্িক্তযুদ্ধকে আখ্যায়িত করে সামরিক বাহিনীর অবদানকে খাটো করতে চায় তারা বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী। মুক্তিযুদ্ধের মেরুদণ্ড ছিল সামরিক বাহিনী। অন্য সবাই ছিল তাদের নেতৃত্বে। জনগণ ছিল সহায়ক শক্তি। মেজর জেনারেল সুবেদ আলী তার বই ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে’ তার কুমিরা অপারেশনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা-ও প্রমাণ করে, ৭ মার্চের পর বিমানবন্দর বন্ধ করে দিলে জান্তার যেকোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে তাদের দিকে ফিরে যেত। তারা তা সামলাতে পারত না। কারণ তাদের শক্তি তখন কম ছিল এবং আমাদের শক্তি ছিল পূর্ণোদ্যমে অটুট। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের ফুয়েল ড্যাম্প ছিল সম্পূর্ণ ভালনারেবল। যেকোনো মুহূর্তে তা অচল করে দেয়া যেত। নয়া দিগন্ত।