Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

পায়রা সমুদ্র বন্দর নামেই, বছরে ১ তোলা পণ্যও খালাস হয়নি

pairaপটুয়াখালীর কলাপাড়ায় কুয়াকাটার কাছে পায়রায় স্থাপিত নতুন এই সমুদ্র বন্দরটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর। দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর এটি। এটিকে ইতিমধ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশে আর কোনো গভীর সমুদ্র বন্দর নেই। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন এখনো পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়েছে। সেই হিসেবে পায়রার বন্দরটিই দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর। দেখা যাচ্ছে, বন্দর উদ্বোধন করার পর এরই মধ্যে এক বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু জানা গেছে, এই এক বছরে একটি জাহাজও এই বন্দরে আসেনি। ফলে ১ তোলা পণ্যও এই বন্দর থেকে খালাস হয়নি বা বোঝাই হয়নি।

বরিশাল অঞ্চলের কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি ও অথনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে এখানে সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু, উদ্বোধনের পরও এক বছরে কোনো জাহাজ না আসায়, পণ্য খালাসের সুযোগ না থাকায় এটি শুধুমাত্র কথার ফুলঝুরিতে পরিণত হয়েছে। অথচ ইতিমধ্যে অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে এই বন্দর স্থাপনে বড় অংকের অর্থ খরচ হয়ে গেছে এবং এখনো ব্যাপক খরচের যজ্ঞ চলছে।

chardike-ad

মূল উদ্দেশ্য ‘লুটপাট’

সংশ্লিষ্টদের মতে, মূলত লুটপাটের উদ্দেশ্যেই এখানে বন্দর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কারণ, বন্দর প্রতিষ্ঠার আগে এ বিষয়ে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা হয়নি। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও নিয়মবহির্ভূতভাবে এখানে বন্দর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো শুধুমাত্র লুটপাটের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই। সেই লুটপাটই এখন চলছে। বন্দরের সরঞ্জাম কেনাকাটার টেন্ডারে অনিয়মের কারণে ইতিমধ্যে এক দফায় টেন্ডার বাতিল করতে হয়েছিলো। কেনাকাটার টেন্ডার নিয়ে এখন আবারো বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। কমিটিতে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। কমিটি এই টেন্ডারও বাতিল করে নিয়মকানুন অনুসরণের মাধ্যমে নতুন করে টেন্ডার আহ্বানের সুপারিশ করেছে। কিন্তু, কমিটির সুপারিশ আমলে আনছে না মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।

সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই বন্দর নির্মাণ

অবাক ব্যাপার হলো, এখানে বন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্তের আগে এতো বড় একটি প্রকল্প নিয়ে কোনা ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সমীক্ষা করা হয়নি। কোনো রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশের ৩য় সমুদ্র বন্দরের স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। নিয়ম হলো- নাব্যতা কী পরিমাণে আছে, ড্রেজিং করা যাবে কিনা বা করা হলে নাব্যতা প্রয়োজন অনুযায়ী পাওয়া যাবে কিনা, বিদেশি জাহাজ এখানে আসবে কিনা, সুযোগ-সুবিধা কী রকমের পাওয়া যাবে, যন্ত্রপাতি কী পরিমাণে থাকবে, পশ্চাৎ সুবিধা কতটুকু, জাহাজ ব্যবহারকারীদের মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা প্রভৃতি দেখেই বন্দরের স্থান নির্বাচন করতে হয়। আগাম সমীক্ষার মাধ্যমে যে স্থানটি উপযুক্ত মনে হবে সেখানেই বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যান্য বিদ্যমান বন্দরের সঙ্গে প্রস্তাবিত এ বন্দরটি প্রতিযোগিতামূলক ও আকর্ষণীয় হবে কিনা এসব বিষয়ও সমীক্ষায় থাকার নিয়ম রয়েছে। অথচ এসব না করেই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে পায়রায় সমুদ্র বন্দর স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করে। মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রীর কাছে সার-সংক্ষেপ পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পরপরই দ্রুতগতিতে বন্দর স্থাপনের কাজ শুরু করা হয়।

ইতিপূর্বে দেখা যায়, কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠার জন্য জাপানী সমীক্ষা প্রতিষ্ঠান পিসিআই-কে নিয়োগ করা হয়েছিলো। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছিলো। প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন সমুদ্র এলাকায় ৯টি স্থানে সমীক্ষা চালিয়ে সোনাদিয়াকে গভীর সমুদ্র বন্দর হিসাবে উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্বাচন করেছিলো। অথচ, কোনো রকমের সমীক্ষা ছাড়াই পায়রায় বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যাকে অভিনব উদ্যোগ বলে আখ্যায়িত করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, উদ্বোধনের পরে পায়রা বন্দরে আইডব্লিউএম (ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট) চলতি বছরে প্রাথমিকভাবে একটি ছোট সমীক্ষা চালিয়েছে। এটাও একটি অভিনব ও অত্যন্ত বিতর্কিত পদক্ষেপ। এই সমীক্ষায় সাইট সিলেকশন বা স্থান নির্বাচনের কোনো বিষয় ছিলো না। আইডব্লিউএম নামে প্রতিষ্ঠানটির গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে সমীক্ষা চালানোর মতো কোনো অতীত অভিজ্ঞতাই নেই। প্রতিষ্ঠানটি এ কাজের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিতও নয়। দেখা যাচ্ছে, এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কানেক্টিভিটির ওপর কোনো সমীক্ষা চালানো হয়নি। আন্তর্জাতিক জাহাজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও কোনো আলোচনা করা হয়নি। অথচ সমুদ্র বন্দর স্থাপনের জন্য এগুলো অপরিহার্য ইস্যু।

অবশেষে ‘আইওয়াশ’ সমীক্ষার উদ্যোগ

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অবশেষে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন সমীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এ ধরনের সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন করতে কমপক্ষে দু’বছর সময় লাগবে। দু’বছর পরে সমীক্ষার ফলাফলে যদি বলা হয়, এটি সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত স্থান নয়, তখন কী হবে- এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের। কারণ, ইতিমধ্যে এখানে সরকারের বিপুল অর্থ খরচ হয়ে গেছে এবং এখনো হচ্ছে।

জানা গেছে, সমীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগের এখন যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে সাইট সিলেকশনের কোনো পূর্বশর্ত বা কার্যপরিধি রাখা হয়নি। এর কারণ হলো, প্রকৃত পদ্ধতিতে সমীক্ষা করা হলে পায়রার এ স্থানটি সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে না- এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তখন সরকারি এই বিপুল অর্থ খরচের জবাবদিহিতা সামনে এসে যাবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বস্তুত নৌ মন্ত্রণালয় কোনো রকমের স্টাডি ছাড়াই সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে পায়রায় সমুদ্র বন্দরের স্থান নির্বাচন করেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে অতিরিক্ত দায়িত্বে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। কিন্তু, তিনি স্থান নির্বাচনের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। দায়িত্ব পেয়েই পায়রায় প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। বলা হচ্ছে, এখানে বন্দর নির্মাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। কিন্তু, এভাবে পূর্ব প্রস্তুতি এবং সম্ভাব্যতা নির্ণয় ছাড়া কার্যক্রম গ্রহণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেও ইতিবাচক কোনো ফল বয়ে আনবে না বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল।

যন্ত্রপাতি কেনার টেন্ডারে অনিয়ম

চেয়ারম্যান ছাড়াও পরিচালনা বোর্ডে তিনজন সদস্যসহ জনবলের একটি আলাদা সেটআপ আছে। এই কর্মকর্তারা বস্তুত বড় বড় কেনাকাটা নিয়েই ব্যস্ত, যদিও বন্দরের আসল বিষয় অর্থাৎ জাহাজ বোঝাই বা খালাসের কোনো কাজ নেই। জনবলের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় ছাড়াও জমি অধিগ্রহণ, ভরাট, পন্টুন নির্মাণ প্রভৃতি খাতে ব্যাপকহারে অর্থখরচ চলছে এখন। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৬০ কোটি টাকা ধার করে এনে খরচ করা হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে ৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে পায়রা বন্দরের জন্য। নেভিগেশন যন্ত্রপাতি ক্রয় খাতে এই টাকার একটি বড় অংশ খরচের পরিকল্পনা রয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর ছোট ছোট নৌযান ক্রয় করা হচ্ছে। এসব নৌযান ক্রয়ের জন্য প্রথমে যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিলো নিয়ম অনুসরণ না কারণে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ উঠে। সংসদীয় কমিটিতে এ নিয়ে আলোচনা হয়। অনিয়ম বিবেচিত হওয়ায় সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে দরপত্র বাতিল করতে বলা হয়। ২য় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হলে এক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ উঠে। সংসদীয় কমিটির সভায় এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলা হয়। বলা হয়, যেসব যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য এই টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে তার অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। অথচ এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান না করে স্থানীয় দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ‘অরূপ এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্যই এটি করা হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এ অভিযোগের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ টেন্ডার বাতিল করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করেছে কমিটি। সভার কার্যবিবরণীতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়, আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। এতে অর্থেরও সাশ্রয় হতে পারে।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ সংসদীয় কমিটির এ সুপারিশ আমলে আনেনি। শীর্ষ কাগজের সৌজন্যে।