Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

এশিয়ান হাইওয়ে মানের কোনো সড়ক নেই দেশে

asia highwayএশিয়ান হাইওয়ের তিনটি রুট গেছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। এর মধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক ও একটি আঞ্চলিক। বাংলাদেশ অংশে এ তিন রুটে সড়কের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭৪১ কিলোমিটার, যার প্রায় পুরোটাই নিম্নমানের। এক কিলোমিটারও নেই এশিয়ান হাইওয়ে মানের সড়ক।

ইউএন-এসকাপ তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ‘এশিয়ান হাইওয়ে ডাটাবেজ’-এ এসব তথ্য তুলে ধরেছে। এশিয়ান হাইওয়েভুক্ত দেশগুলোর কাছে প্রতিবেদনটি হস্তান্তরও করেছে তারা। বাংলাদেশের সড়কগুলোর ব্যাপারে ইউএন-এসকাপ বলেছে, গত পাঁচ বছরেও এগুলো উন্নয়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

chardike-ad

আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সহজ করতেই ইউএন-এসকাপের উদ্যোগে সহযোগিতামূলক প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে। ৩২টি দেশের মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তিও সই হয়েছে। বাংলাদেশ চুক্তিতে সই করে ২০০৯ সালে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের যে দুটি আন্তর্জাতিক রুট অতিক্রম করেছে তা হলো, এএইচ-১ ও এএইচ-২। আঞ্চলিক রুটটি হলো এএইচ-৪১। এশিয়ান হাইওয়ে মানের সড়ক মূলত ‘প্রাইমারি বা ধমনি সড়ক’ নামে পরিচিত। এগুলোয় প্রবেশ থাকে সংরক্ষিত। অযান্ত্রিক ও ধীরগতির যানবাহন এতে প্রবেশ করতে পারে না। এগুলোর জন্য পৃথক সার্ভিস সড়কও থাকে। প্রাইমারি সড়কের দুই পাশে থাকে নিরাপত্তামূলক বেষ্টনী বা সীমানা প্রাচীর, ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলতে পারে। ন্যূনতম চার লেনের এসব সড়কে কোনো মোড় থাকার সুযোগ নেই। পাশাপাশি সড়কের দুই পাশে ন্যূনতম ৫০ মিটারের মধ্যে কোনো জনবসতি বা স্থাপনা রাখা যাবে না। সর্বোপরি এক কিলোমিটার অন্তর উল্লেখ থাকবে পরবর্তী জেলার নাম ও দূরত্ব। এসব সড়কের পাশ দিয়ে পথচারী চলাচল বা আড়াআড়ি সড়ক পারাপার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

ইউএন-এসকাপ তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলছে, প্রাইমারি সড়কের শর্ত পূরণ হয়, এমন কোনো সড়ক-মহাসড়ক বাংলাদেশে নেই। মূলত এক্সপ্রেসওয়েগুলো প্রাইমারি সড়ক হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো এক্সপ্রেসওয়ে নেই। এশিয়ান হাইওয়ের রুটভুক্ত ১ হাজার ৭৪১ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ৭২ কিলোমিটার সড়ক চার লেনের। এগুলো প্রথম শ্রেণীর আওতাভুক্ত। ৮৯ শতাংশ বা ১ হাজার ৫৫৩ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর। এসব সড়ক দুই লেনের। তৃতীয় শ্রেণীর সড়ক রয়েছে ৯৪ কিলোমিটার। অবশিষ্ট ২২ কিলোমিটার তৃতীয় শ্রেণীর বা আরো নিম্নমানের।

সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে, এশিয়ান হাইওয়েভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সড়ক উন্নয়নে সবচেয়ে এগিয়ে চীন, জাপান, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া। ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডও সংশ্লিষ্ট সড়কগুলো দ্রুত উন্নয়ন করছে। যদিও বাংলাদেশে চুক্তি সইয়ের পাঁচ বছরেও সড়ক উন্নয়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

ইউএন-এসকাপের প্রতিবেদনের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হতে অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক পরে চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। এ কারণেই কিছুটা পিছিয়ে আছি আমরা। তবে এশিয়ান হাইওয়েভুক্ত সড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাইও সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই কয়েকটি প্রকল্প নেয়া হবে। এগুলো সম্পন্ন হলে এশিয়ান হাইওয়ে বাস্তবায়নে দ্রুত এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।’

তবে ইউএন-এসকাপের প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. শামছুল হক। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানের মহাসড়কের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো প্রবেশ সংরক্ষিত রাখা। দুই পাশে বেষ্টনী থাকায় কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই এসব সড়কে সর্বোচ্চ গতিতে যানবাহন চলাচল করে। ধীরগতির যানবাহনের জন্যও থাকে পৃথক সড়ক। আন্তর্জাতিক মানের সড়কে কোনো ধরনের মোড় (জাংশান) থাকা চলবে না। যেখানে মোড় আসবে, সেখানে ওভারপাস বা ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করতে হবে, যাতে যানবাহন বাধা ছাড়াই মোড় অতিক্রম করতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানের সড়কে পথচারী চলাচল বা আড়াআড়ি পারাপার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো মহাসড়কেই এসব বৈশিষ্ট্য নেই। তাই এগুলো কখনো এশিয়ান হাইওয়ে মানের হতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক করিডোরে যুক্ত হওয়ার জন্য দ্রুত মহাসড়কগুলো উন্নত করছে। পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান এমনকি মিয়ানমারও অ্যাকসেস কন্ট্রোলড (প্রবেশ সংরক্ষিত) সড়ক নির্মাণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন একটি সড়কও নেই। চার লেনের কিছু সড়ক থাকলেও সেগুলোয় দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে রিকশা, ভ্যান, বাইসাইকেল, নসিমন, করিমন চলছে। এশিয়ান হাইওয়ের রুটভুক্ত প্রতিটি মহাসড়কেরই একই অবস্থা। এগুলোর উন্নয়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয়নি। প্রবেশ সংরক্ষিত না করে চার লেন কেন, আট লেন করলেও গুণগত মানের উন্নয়ন হবে না।

ইউএন-এসকাপের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এএইচ-১-এর অন্তর্ভুক্ত এশিয়ান হাইওয়ের সড়ক রয়েছে ৪৮৪ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার। রুটটি বেনাপোল সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে যশোর, নড়াইল, কালনা ফেরি ঘাট, ভাটিয়াপাড়া, ভাঙ্গা, চরজানাজাত, মাওয়া, ঢাকা, কাচপুর, নরসিংদী, সরাইল, মিরপুর, শেরপুর, সিলেট হয়ে তামাবিল সীমান্ত পর্যন্ত যাবে। এর মধ্যে পদ্মার প্রায় ছয় কিলোমিটার ও কালনা নদীর প্রায় এক কিলোমিটার মিসিং লিংক হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া ভাটিয়াপাড়া থেকে কালনা ফেরিঘাট হয়ে নড়াইল ও মাওয়া থেকে চরজানাজাত অংশ তৃতীয় শ্রেণী বা তার নিচে। বাকি সড়কগুলো দ্বিতীয় শ্রেণীর।

আন্তর্জাতিক আরেক রুট এএইচ-২ বাংলাবান্ধা সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে পঞ্চগড়, বেলডাঙ্গা, রংপুর, গোবিন্দগঞ্জ, বগুড়া, হাটিকুমরুল, এলেঙ্গা, কালিয়াকৈর, জয়দেবপুর, ঢাকা হয়ে কাঁচপুর দিয়ে এএইচ-১ রুটে তামাবিল সীমান্ত পর্যন্ত যাবে। এ রুটের দৈর্ঘ্য ৮০৫ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার। তবে ২৯১ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার এএইচ-১-এর অন্তর্ভুক্ত। ওই অংশটি কমন রুট হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এএইচ-২-এর দৈর্ঘ্য ধরা হয় ৫১৪ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। এ রুটের জয়দেবপুর থেকে ঢাকা হয়ে কাঁচপুর পর্যন্ত প্রায় ৪২ কিলোমিটার প্রথম শ্রেণীর সড়ক রয়েছে। তবে পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা সীমান্ত পর্যন্ত অংশটি তৃতীয় শ্রেণী বা তারও নিচে। বাকি অংশ দ্বিতীয় শ্রেণীর।

উপ-আঞ্চলিক রুট হিসেবে চিহ্নিত এএইচ-৪১ মংলা বন্দর থেকে শুরু হয়ে খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, পাকশী, দাসুরিয়া, বনপাড়া, হাটিকুমরুল থেকে এএইচ-২ হয়ে কাঁচপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লার ময়নামতি, ফেনী, চট্টগ্রাম, কেরানীরহাট, কক্সবাজার, টেকনাফ দিয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত যাবে। রুটটির দৈর্ঘ্য ৭৪৪ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। এ রুটের কাঁচপুর থেকে দাউদকান্দি অংশ প্রথম শ্রেণীর সড়ক। বাকি অংশ দ্বিতীয় শ্রেণীর।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের চার লেনের মহাসড়কগুলোও ভারত এমনকি মিয়ানমারের চেয়ে তুলনামূলক কম প্রশস্ত। এজন্য বিভিন্ন মহাসড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে নিয়মিত ও অন্যতম দৃশ্য হলো যানজট। এক্সেল লোড অনেক কম হওয়ায় অধিকাংশ মহাসড়কই আধুনিক ও ভারী যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী। এছাড়া সেতুগুলোও খুব দুর্বল।

সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) প্রধান প্রকৌশলী এম ফিরোজ ইকবাল বলেন, বাংলাদেশের মহাসড়কের গুণগত মানোন্নয়নে চেষ্টা করা হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত বেশকিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলো চার লেন করার উদ্যোগ নেয়া হয়ছে। পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে ছোট-বড় বেশকিছু সেতু। এছাড়া ২০ বছর মেয়াদি রোড মাস্টারপ্ল্যানে আরো কিছু প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো সম্পন্ন হলে মহাসড়কের চিত্র অনেক উন্নত হবে। বণিকবার্তা।