Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

তুর্কমেনিস্তান ও তুর্কমেনদের পিতার গল্প

turkeminডাচ সাইক্লিস্ট বার্নাদেতা স্পিত। ৩৮ বছরের অভিযাত্রায় এরই মধ্যে ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের ৫২টি দেশ। সিল্করুটের পাঠকদের তিনি তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতার অংশী করতে চান। প্রাচীন বাণিজ্যপথটির অনুগামী হয়ে তার ভ্রমণের গল্প থেকে আমরা দেখতে চেয়েছি, ঐতিহাসিক সেসব জনপদের হালনাগাদ কৃষ্টি ধর্ম শিল্প প্রযুক্তি ও জীবনাচার

‘ভালোবাসার শহর আশগাবাদ, যেখানে অনেক সুদর্শনের সাক্ষাৎ পাবেন’

chardike-ad

সবার প্রথম এ বাক্যটাই শুনলাম, তাও একজন সুদর্শন তরুণের মুখে। তুর্কমেনিস্তানে প্রবেশ করেছি আমি। রুখু মরুভূমির মধ্যে সবুজ পাহাড়। ইরান থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সেই পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোচ্ছি। মার্বেল পাথরের বিরাট ফটক পেরিয়ে পা রাখলাম আশগাবাদে, যার আভিধানিক অর্থ ‘ভালোবাসার শহর’। কিন্তু ভালোবাসার মতো কিছু চোখে পড়ছে না। একেবারে নিষ্প্রাণ শহর। শুভ্র মার্বেলের উঁচু ভবন, হোটেল, মনুমেন্টের সারি, তার মধ্যে সোনালি গম্বুজবিশিষ্ট জাদুঘর— সবই মনে হয় ফাঁকা পড়ে আছে। তেল ও গ্যাস বিক্রির আয় থেকে নির্মিত এ ভবনগুলো প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত মর্যাদার স্বার্থেই নির্মিত। চওড়া রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ নিঃশব্দে ছুটে যায় চকমকে সব গাড়ি। বড় বড় কিছু রাস্তায় দিকনির্দেশক চিহ্ন থাকলেও পথের প্রান্তে দেখা যায় ধু-ধু মরুভূমি। পুরো ব্যাপারটিই কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠেকে।

ঝকঝকে তকতকে ইমারতের সারির ফাঁকে ফাঁকে সবুজ পার্ক, ক্ষীণ সরোবর আর উঁচু ঝর্ণা। কিন্তু চকিতে চোখে পড়া ঝাড়ুদার ছাড়া কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই। সবার আগে যা করলাম তা হলো, সরোবরের পাশে সাইকেল রেখে একটি বেঞ্চিতে বসলাম। পরে জেনেছি, এসব পার্কে যাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বরাত ভালো যে ধরা পড়ে জরিমানা দিতে হয়নি। আরো জেনেছি, শ্বেতহস্তীর মতো এ ভবনগুলো নির্মাণের কারণে অনেক লোককে ঘরছাড়া হতে হয়েছে। ১৯৪৮ সালে এক ভূমিকম্পে আশগাবাদ শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। পরে রুশীয় কায়দায় ছোট ছোট অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে অনেকগুলো ভবন নির্মিত হয়। এখন সেসব ভবন প্রেসিডেন্ট নিয়াজভের জৌলুসপ্রীতির কারণে কোণঠাসা হচ্ছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তুর্কমেনিস্তান স্বাধীন হয়।

একসময় পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল তুর্কমেনিস্তান। সে সময় দেশটির অধিকাংশ অধিবাসী জরাথ্রুস্টবাদ অথবা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিল। এর পর আরব মুসলিম ও তুর্কিরা এ দেশ দখল করলে এখানকার ভাষা ও ধর্ম পাল্টে যায়। তুর্কমেনিস্তানের মার্ভ শহর ছিল সিল্করুটের অন্যতম প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র। সে সময় বিশ্বের অন্যতম বড় শহর ছিল মার্ভ। ত্রয়োদশ শতকে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা মধ্য এশিয়া দখল করে। ইতিহাসের অন্যতম বড় ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয় তখন। মার্ভ শহরের বিরাট ক্ষতিসাধন করে মঙ্গোলরা। প্রাচীন শহরটি এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার অংশ।

বিশ শতকের শেষদিকে তুর্কমেনিস্তান স্বাধীন হলে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নিয়াজভ নিজেকে আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে তুর্কমেনবাসী বা তুর্কমেনদের জাতির পিতা উপাধি ধারণ করেন। তিনি পুরোপুরি কর্তৃত্ববাদী একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে দিন ও মাসের নামকরণ করেন। তার মূর্তি ও ছবি সারা দেশে, এমনকি নাগরিকদের শয়নকক্ষেও স্থান নেয়। জনসমাগম হতে পারে, এমন সব জায়গায় নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারত না। ২০০৬ সালে নিয়াজভের মৃত্যুর পর বারদিমুহামেদু প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। প্রথমদিকে তিনি নিয়াজভের প্রবর্তিত অনেকগুলো অদ্ভূত ও নিপীড়নমূলক আইন বাতিল করেন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে প্রয়াসী হন। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনিও একটি প্রভাববলয় গড়ে তোলেন। একনায়কত্বও বহাল আছে।

তুর্কমেনিস্তানের ভেতর দিয়ে উজবেকিস্তানের উদ্দেশ্যে আমি সাড়ে ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ যে রাস্তা ধরে এগোচ্ছি, সেটা প্রাচীন সিল্করুটেরও অন্যতম পথ। অধিকাংশ জায়গা মরুময়। দিনের বেলা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর তাপমাত্রা থাকে। কাজেই পথচলার একমাত্র উপায় হলো সকাল ৬টায় সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে রোদ গড়ার আগেই যত দূর সম্ভব এগোনো; পথেই কোনো নাহারহানায় ভোজনপর্ব সেরে নেয়া অথবা চায়েখানায় কাপ হাতে সামান্য জিরিয়ে নেয়া। সকালের নাশতায় তুর্কমেনরা খায় পেলমেন; মাখা ময়দার তালের ভেতর মাংস পুরে সিদ্ধ করে তৈরি হয় এ পেলমেন। দুপুরে তারা খায় খাসির মাংস ও গ্রেশকা। এটা হচ্ছে সিদ্ধ বজরা ও ডালের মিশ্রণ; পরিবেশিত হয় পার্সলে পাতা ও দইয়ের সঙ্গে, গরম গরম। তুর্কমেনিস্তানের খাবার যাযাবর জীবনধারায় প্রভাবিত। বেশির ভাগ পদ সাদামাটা, উপকরণের প্রাপ্তির ওপর নির্ভরশীল। সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে পিলাউ; চাল, ভেড়ার মাংস ও পেঁয়াজ দিয়ে রান্না হয়। এছাড়া আলু ও টমেটো দিয়ে রান্না খাসির মাংসের ঝোল ‘সুরপা’ খায় তুর্কমেনরা। তন্দুরে সেঁকা চোরেক নামের রুটিও জনপ্রিয়। তুর্কমেন সংস্কৃতিতে রুটির প্রতীকীর গুরুত্ব অনেক; রুটি সেঁকার তন্দুরকে ঘরের সবচেয়ে পবিত্র অংশ ভাবা হয়। গোলাকার রুটির উপরিভাগকে উল্টে রাখা ভীষণ অশোভন মনে করা হয়। সব রকম খাবারের পরই চীনামাটির ছোট পাত্রে সবুজ চা পরিবেশন করা হয়।

মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো তুর্কমেনিস্তানেও জাজিমে ঢাকা কাঠের বিছানা বা ‘তখতা’র প্রচলন রয়েছে। দুপুরে কোনো তখতায় বিশ্রাম করি, রাতে সোভিয়েত কায়দার হোটেলে ঘুমাই। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির কোনো দাম নেয়া হয় না, তবে কোনো নিশ্চয়তাও নেই। এক রাতে মরুভূমিতে বিপদে পড়েছিলাম। তাঁবু খাটানোর মতো কোনো জায়গা পাচ্ছি না। তুর্কমেনরা বন্ধুবৎসল; তারা আগন্তুককে সাহায্য করতে আগ্রহী হলেও সরকারি গুপ্তচরদের নজরদারির কারণে অপারগ। তাই আগ্রহী সাহায্যকারীর পরামর্শেই অপেক্ষা করতে থাকলাম। সন্ধ্যার পর উঁচু-নিচু রাস্তায় তার গাড়িকে অনুসরণ করতে থাকলাম। একসময় তার বাড়ির প্রধান ফটক পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম। প্রাগৈতিহাসিক কালের সামোভার থেকে বালতিতে গরম জল ঢেলে স্নান করলাম। রাতগুলো ভীষণ ঠাণ্ডা। আশ্রয়দাতা পরিবারের দরদি মানুষগুলোর সঙ্গে গল্প শেষে একসময় গৃহকর্ত্রীর শোয়ার ঘরে গেলাম। মেঝেতে কম্বলের পুরু আস্তরণ রেখে শুয়ে পড়লাম। দেয়ালে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে নিয়াজভের ছবি। সূর্য ওঠার আগেই নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম ছেড়ে। আমার অবস্থানের খবর কেউ টের পেলে আশ্রয়দাতার ক্ষতি হতে পারে!

মারি শহরের বাজারে হাট দেখতে গেছি। কেরাইত বা কালো তাতারদের মতে, যিশুখ্রিস্টের মা মেরি এখানেই সমাহিত হয়েছেন। শহরটি এখন তুলা, শস্য, চামড়া ও পশমের বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। যে কোনো স্থানের কৃষ্টি, রীতি ও রান্নাবান্না সম্পর্কে ধারণা পেতে বাজারে ঘোরার বিকল্প নেই। মারিতে রোববার হাটবার। খোলা ময়দানে জমে ওঠা এ বাজারে লোকজ জীবনে প্রয়োজনীয় হেন পণ্য নেই, যার জোগান আসে না। সদ্য সেঁকা রুটি থেকে আরম্ভ করে বন, পিঠা, ক্যান্ডি, মধু, পনির, তরমুজ, শস্য, ডাল, পাস্তা, ভোদকা, লেমনেড, মেয়াদ অতিক্রান্ত ওষুধ, ঝাড়ু, ইঁদুর মারার কল, চায়ের পাত্র, ঘোড়ার লাগাম, কৃষিযন্ত্র, জামা, গলাবন্ধ, টুপি, ভেড়ার ছালের কোট, অলঙ্কার, ফ্রিজের যন্ত্রাংশ, চুলা ও বাইসাইকেল— সবই মেলে মারিতে। হাটের এক কোণে কার্পেটের বাজার; সেখানে গোপনে ডলার পাল্টে কেনা যায় স্থানীয় মুদ্রা ‘মানত’।

তুর্কমেন নারীরা ভীষণ সুন্দর ও রাজসিক। তারা সরু পাজামা ও নানা রকম কারুকাজ করা লম্বা জামা পরে। মাথায় পরে বর্ণিল ওড়না। হাটে আসা নারীদের ক’জন দেখি সোনার দাঁত পরেছে। আমাকে দেখে ওরা এগিয়ে এল, ইশারায় হাসি-ঠাট্টা করল। এ অঞ্চলে পর্যটকের দেখা পাওয়া দুর্লভ ব্যাপার।

উটের সঙ্গে রাস্তা ভাগাভাগি করে পথ চলছি। গরম ও ধূলিময় হাওয়া এসে মুখে লাগছে। একে একে পার হচ্ছি বিভিন্ন দালান ও পুরনো কারখানা। দেয়ালে নিয়াজভের ছবি খোদাই করা, নিচে লেখা: হালক, ওয়াতান, বায়িক তুর্কমেনবাসী, যার অর্থ ‘জনগণ, মাতৃভূমি ও তুর্কমেনদের মহান পিতা’। চলতি পথে হঠাৎ থেমে কোনো বাড়ির দরজায় অপেক্ষমাণ বালিকার কাছে চেয়ে জলপান করি। অবশেষে একপর্যায়ে উজবেকিস্তানের সীমান্তে এসে পৌঁছলাম। যাত্রা এখনো বাকি।

(চলবে)