Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

স্মৃতিতে ভাষাসংগ্রামীরা

21-february_1520120412152237ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে আমার স্মৃতিতে প্রথমেই আসে আব্দুুল মতিনের নাম। তার সঙ্গে পরিচয় সেই ১৯৫২ সালে। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ৩১ জানুয়ারি যে সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো ওই সভায়। পরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে খানিকটা, বিশেষভাবে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে গুলি চলার পর। ওই সময় তিনি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সিঁড়িতে বসেছিলেন। কান্নাভেজা চোখ। সেখানে শেষ বিকালে আমাদের চাটগাঁয়ের এক ছাত্রবন্ধু আব্দুস সাত্তারই (মতিন সাহেবের সঙ্গে মোটামুটি সুসম্পর্ক ছিল) প্রথমে বলে, ‘মতিন ভাই, কিছু একটা করা দরকার। অন্তত একটা লিফলেট— আমাদের করণীয় কী এটা নিয়ে।’ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে সাত্তার। আমি তো মানসিকভাবে ভালো অবস্থায় নেই। তুমি গিয়ে লিফলেটের একটা খসড়া করে আনো।’ সাত্তার দ্বিধান্বিত- এখন কোথায় যাবে? সাত্তারের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকায় পরে অবশ্য সে আমার রুমে খসড়া তৈরির জন্য বসে গেল। তখন আমি থাকতাম মেডিকেল হোস্টেলের ২০ নং ব্যারাকের ৬ নম্বর কক্ষে। সেখানে বসে সে একটা খসড়া তৈরি করল। পরে দুজনে মিলে সেটা নিয়ে যাই মতিন সাহেবের কাছে। তিনি বললেন ঠিক আছে, এখন এটা ছাপার ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিন তিনি লিফলেট ছাপার ব্যবস্থা করে অনেকটা নিজ দায়িত্বেই বিতরণ করলেন। মনে পড়ে, ওই লিফলেট বর্তমান কাঁটাবনসহ সংলগ্ন এলাকায় বিতরণ করা হয়েছিল।

ভাষা আন্দোলনে আমার আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমান গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। বলা হয়ে থাকে হাসান ও তার বন্ধু আমির আলীরা মিলে ক্যাপিটাল প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রথম লিফলেট ছাপিয়েছিল। আসলে তথ্যটি সঠিক নয়। মতিন সাহেব যে লিফলেট ছাপিয়েছিলেন, সেটাই একুশের প্রথম লিফলেট। আরো অনেক ভাষাসংগ্রামী ছিলেন। স্মৃতি থেকে একেক করে তাদের কথা বলছি। এদের মধ্যে একজন হলেন মোহাম্মদ সুলতান। তার সঙ্গে আমার মোটামুটি ভালো সম্পর্ক ছিল। পরিচয় বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সময়ে। আমি ঢাকায় এলাম ১৯৪৯ সালে। কাজেই আটচল্লিশের আন্দোলন আমি ঢাকায় করিনি, তখন ছিলাম মুন্সীগঞ্জে। হরগঙ্গা কলেজে এইসএসসির ছাত্র। আটচল্লিশের ১১ মার্চ উপলক্ষে আমরা মুন্সীগঞ্জের একবগ্গা রাস্তা— জাহাজঘাট থেকে শহর পর্যন্ত, মিছিল-সমাবেশ করেছি। এর খেসারতও দিতে হয়েছিল। আমাদের কলেজেরই মুসলিম লীগের এক পাণ্ডা (ডাকনাম মধু) আমাকে মারধর করে থানায় দিয়ে এল। পরে আমার চাচা থানায় এসে আমাকে বের করে নিয়ে যান।

chardike-ad

ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ব্যাপকমাত্রায় সংশ্লিষ্ট থাকায় কাছ থেকে অনেককেই গভীরভাবে দেখেছি। যেমন— মাহবুব জামাল জাহেদী। জাহেদী তার বাবার অগোচরেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তার বাবা মিজানুর রহমান (সিএসপি আমলা) ঘোরতর বাংলা বিরোধী— এটা বললেই যথেষ্ট নয়, উর্দু বর্ণমালায় বাংলা লেখার মূল পরিকল্পনার একজন ছিলেন তিনি। ওই পিতার ছেলে জাহেদী (সাংবাদিক) ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিল, যথেষ্ট কাজ করেছিল। ডক্টরস ব্যারাকে বসবাসরত তার ভগ্নিপতি ডা. আব্দুল মান্নানের বাসায় জাহেদী পাকা আস্তানা গেড়েছিল। তখন ভাষা আন্দোলনের তুঙ্গ পর্যায়। বলা যায়, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আগ পর্যন্ত সে সেখানেই ছিল। এছাড়া আমাদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে এমআর আখতার মুকুল জড়িত ছিল। তার সঙ্গে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, সেদিন বেলা ৩টা ২০ কি সাড়ে ৩টা নাগাদ গুলি চলল। শহীদদের নিয়ে কান্নাকাটি। ভয়ানক আবেগময় পরিস্থিতি। আমরা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ২০ নং ব্যারাকের পশ্চিম মাথায় ১ নং কক্ষে কন্ট্রোল রুম করেছিলাম। তখন  স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা কলেজ ইউনিয়নের মাইক ব্যবহার করে প্রচারণা চালানো হয়েছিল। এ মাইকের প্রচার খুব কাজে লেগেছিল। আমার ধারণা, এজন্য পুরান ঢাকার বাসিন্দারা দলে দলে প্রথমে মেডিকেল প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়।

এর পর তারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমানে যে ১ নং গেট আছে, সেখানে সবাই ভিড় করেছে। দোতলায় সিঁড়ির একপাশে জাহেদী, আরেকপাশে মুকুল দাঁড়িয়েছিল। আমি জাহেদীর পাশে দাঁড়িয়ে লোকদের বুঝিয়েছিলাম হাসপাতালের ভেতরে তারা যেন প্রবেশ না করে। কেননা হাসপাতালে ভিড় করলে রোগীদের অসুবিধা হবে, চিকিত্সাসেবা বিঘ্নিত হবে। এ রকম ছোটখাটো অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো হূদয়স্পর্শী। যেমন— আব্দুল জব্বার। জব্বারের গুলি লেগেছিল আমাদের ২০ নং ব্যারাকের ঠিক সামনে। ওই ব্যারাকেরই ৮ নং কক্ষে গফরগাঁয়ের আমার সহপাঠী হুরমত থাকত। জব্বারও গফরগাঁয়ের ছেলে। আমার ধারণা, হুরমত আলীর সঙ্গে দেখা করতেই জব্বার সেখানে এসেছিলেন। বেরিয়ে এসে যখন তিনি গুলিবিদ্ধ হলেন তখন আমার দুই সহপাঠী ফজলে রাব্বী ও সিরাজুল হকসহ আমি মিলে ধরাধরি করে তাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে তাকে মৃত ঘোষণা করা হলো। তখন মেডিকেল কলেজে ভালো ব্লাড ব্যাংক না থাকায় তিনি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান।

আরেকটি জিনিস আমার কাছে অসঙ্গত লেগেছে। গুলি চলল সাড়ে ৩টায়; কিন্তু বরকতকে ওটিতে নিতে ৪টা বাজল কেন? রিপোর্টে দেখা যায়, আবুল বরকতকে সন্ধ্যার আগে ওটিতে নিয়ে এলিনসন সাহেব অপারেশন করলেন। ব্যাপক রক্তক্ষরণের পর অপারেশন করলে কেউ কি বেঁচে থাকে? বরকতকে আমি গুলিবিদ্ধ হতে দেখেনি। পরে শোনা গেল, ১২ নং ব্যারাকের সামনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। আসলে তিনি ওই ব্যারাকে আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আর রফিকউদ্দিনকে আমি গুলি লেগে পড়ে যেতে দেখলাম। ১৫-১৬ নং ব্যারাকের মধ্যে সামনের যে রাস্তা ছিল, সেখানে পড়ে থাকতে দেখলাম। আমার কয়েকজন সহপাঠী তাকে স্ট্রেচারে করে প্রথমে জরুরি বিভাগ, পরে মর্গে নিয়ে যায়। ওর ছবি আমাদের এক বন্ধু তুলেছিল। আরেকটি ভুল ধারণা প্রচলিত, আমানুল হকই একমাত্র, যিনি রফিকউদ্দিনের ছবি তুলেছিলেন। আমাদের বন্ধুর তোলা ছবির প্রিন্ট আমার কাছে ছিল। তা ছাপাও হয়েছে।

ভাষাসংগ্রামী বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছে, বেশ কয়েকজন বিদেশে আছে— আমরা সবাই সাধারণ কর্মী হয়ে প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

মেডিকেল হোস্টেলের রাজনীতিমনস্ক ছাত্ররা মিলে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের শ্রমে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করি। বলা যায়, মেডিকেল কলেজের প্রায় সব রাজনীতিমনস্ক ছাত্রই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর মতিন, মুকুল, ইমাদুল্লাহ, জাহেদী— এরা তো ছিলেনই। আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ভাষাসংগ্রামী ছিলেন— অলি আহাদ। উগ্র মেজাজের জন্য তার সঙ্গে আমার কোনোদিন বনেনি। তিনি ছিলেন যুবলীগ নেতা। তিনি ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। আরেকটি বিষয় বলা দরকার, ‘জাতীয় রাজনীতি’ নামে অলি আহাদের বইটিতে প্রচুর তথ্যগত ভুল আছে। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তর ভুল। যেমন— রফিকউদ্দিনের মাথায় গুলি লেগেছে। কী কারণে যেন আজাদ পত্রিকায় তা সালাহ উদ্দিন নামে ছাপা হলো। পরবর্তী সময়ে এই নামে কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ তিনি ওই নামটিই তার বইয়ে উল্লেখ করলেন। এ রকম তথ্যগত বহু ভুল করেছেন। আরেকটি উদাহরণ দিই— অলি আহাদ লিখলেন, ‘শহীদ মিনার তৈরির জন্য সুলতানরা আমার কাছে এল। আমি তাতে সানন্দে সম্মতি দিলাম।’ শহীদ মিনারের পরিকল্পনা আমাদের, ইট-বালি-সিমেন্ট এবং রাজমিস্ত্রির ব্যবস্থা করলাম আমরা। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কাজ করলাম। অথচ তিনি ভুল করে লিখলেন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ হোস্টেলের সব ছাত্রই শহীদ মিনার তৈরির কাজে যুক্ত হয়েছিল। আসলে সমর্থন থাকলেও রাজনীতিমনস্ক বাদে পড়ুয়া ছাত্ররা তাতে অংশগ্রহণ করেনি। তবে এটা স্বীকার করব, রাজনীতিমনস্ক ডান-বাম-মধ্য সব ছাত্রই ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। যেমন— আবুল হাশিম মধ্যপন্থী ছিলেন। আবার শহীদ মিনারের নকশাকার বদরুল আলম একটু ডানপন্থী থাকলেও ভাষা আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। এটা যেহেতু ভাষার ব্যাপার ছিল, সেহেতু এখানে ডান-বাম-মধ্যপন্থীদের সঙ্গে কোনো ফারাক ছিল না।

প্রসঙ্গত ঢাকা হল ও ফজলুল হক মুসলিম হলের আরো কয়েকজন বন্ধুর ভূমিকা স্বীকার করতেই হয়। এর মধ্যে আনয়ারুল হক খান অন্যতম। সে ফজলুল হক মুসলিম হল সংসদের তত্কালীন জিএস ছিল। আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পশ্চিমবঙ্গে বাড়ি। বামপন্থী রাজনীতি করা ছেলে। ওদের হলে আমি ২০ তারিখ সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম। ১৪৪ ধারা জারি করলে আমাদের মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা তাত্ক্ষণিকভাবে স্লোগান তুলেছে, তারা ১৪৪ ধারা মানে না। সেক্ষেত্রে ১৪৪ ধারা জারি সম্পর্কে হলের ছাত্রদের মতামত জানতে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। দেখা গেল তারাও একযোগে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষপাতী। ওখানে বেশ কয়েকজন ছিল— গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান, মোশাররফ, মৃণাল দস্তিদার, সাইদ আতিকুল্লাহ, দেবপ্রিয় বড়ুয়া (এখনো জীবিত) প্রমুখ। এরা সবাই জটলা পাকিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। আমি সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম। সন্ধ্যার পরপরই রুমে ফিরে এসে দেখি শহীদুল্লাহ কায়সার অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। যেহেতু সামনে নির্বাচন তাই আওয়ামী লীগ, গণআজাদী দলসহ ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ১৪৪ ধারা ভাঙতে চাইছিল না; সেক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্রদের মতামত জানতে চেয়েছিল। আমি তাকে মেডিকেল হোস্টেলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হল ও এফ এইচ মুসলিম হলের ছাত্রদের মতামত যাচাইয়ের কথা বলে বললাম, সাধারণ ছাত্রদের সিদ্ধান্ত, তারা যে কোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভাঙবে।

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, মূলত ভাষা আন্দোলন ছিল সাধারণ ছাত্রদেরই আন্দোলন। তাদের দৃঢ় সিদ্ধান্তের কারণেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত বাতিল হলো। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আমতলায় যে মিটিং হলো, যেখানে মতিন সাহেব ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তাব করেছিলেন, সেখানে আমিও ছিলাম। সেদিন আমরা সেখানে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে হই হই করে উঠেছিলাম। এ ঘটনাগুলো স্পষ্টই প্রমাণ করে, তখন সাধারণ ছাত্ররাই ছিল আন্দোলনের মূল নায়ক।

লক্ষণীয়, ভাষা আন্দোলনে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলেও এটি ছিল বাম রাজনীতির আখড়া। ফলে মোটামুটি সবাই রাজনীতিমনস্ক ছিল। আর মূল আন্দোলনটা এখান থেকে পরিচালিত হয়েছে বিধায় সবাই এখানে এসেছে। মতিন সাহেব, সুলতান, জাহেদী, অলি আহাদসহ ভাষা আন্দোলনের মূল সংগঠকরা কেউ কেউ এখানে থেকেছেন, কেউ কেউ আসা-যাওয়া করেছেন। এভাবে ছাত্র-যুবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভাষা আন্দোলন সফল হয়েছিল ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হওয়ার কারণে।

শ্রুতিলিখন: হুমায়ুন কবির