Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

জেলেপল্লি থেকে সিঙ্গাপুর

singaporeস্যাঁত স্যাঁতে এলাকা। সেখানে বাস করত জেলে পরিবাররা। দারিদ্র ও হাহাকার ছিল সেখানকার বাসিন্দাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। মালয় উপদ্বীপের ওপরে গড়ে ওঠা এলাকাটির ১২০টি পরিবার মাছ ধরে জীবন চালাতো। ১৯৬০ এর দশকের আগে আজকের আধুনিক সিঙ্গাপুরের অবস্থা ছিল ঠিক এমনই।

কিন্তু দেশটির সেই অবস্থা পাল্টে দেওয়ার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি সদ্য প্রয়াত লি কুয়ান ইউ। সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা ও জনক বলা হয় তাকে। আধুনিক সিঙ্গাপুরের রূপকার। বিশ্বের কাছে তিনি উন্নয়্ন মডেলের জীবন্ত এক কিংবদন্তি। জীবদ্দশায় সিঙ্গাপুর বা বিশ্বের জন্য এমন কিছু করে গেছেন যার কারণে বিশ্ব ইতিহাসে সোনার অক্ষরে আজীবন লেখা থাকবে তার নাম।

chardike-ad

প্রাকৃতিক সম্পদহীন ৭১৮ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট একটি ভূখণ্ডকে তিনি কীভাবে আজকের উন্নত ও আধুনিক সিঙ্গাপুরে পরিণত করলেন তা নিয়ে মানুষকে এখনো বিস্ময় জাগায়। তার পুরো সাফেল্যের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফার্স্ট : দ্য সিঙ্গাপুর স্টোরি বইতে।

১৯৫৪ সালে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের নিয়ে সদ্য বিলেত ফেরত তরুণ আইনজীবী লি কুয়ান গঠন করেন সমাজতন্ত্রী ভাবধারায় পরিচালিত পিপলস অ্যাকশন পার্টি। ১৯৫৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে লি কুয়ান স্বায়ত্তশাসিত সিঙ্গাপুর নগরীর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তখন এটি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত। প্রধানমন্ত্রিত্বের চার বছরের মাথায় সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়ান ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। কিন্তু ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরকে আর নিজেদের সঙ্গে না রাখার সিদ্ধান্ত নিলে ওই বছরের ৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাধীন সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন তিনি।

এরপর কর্দমাক্ত সিঙ্গাপুরকে তিনি ঝাঁ চকচকে করে তৈরি করেছেন। এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো যেখানে দুর্নীতিতে জর্জরিত, সেখানে আক্ষরিক অর্থেই সিঙ্গাপুরে কোনো দুর্নীতির লেশমাত্র নেই।

১৯৬৫ সালে প্রতিবেশি মালয়েশিয়া থেকে আলাদা হওয়ার পর থেকেই মূলত এ দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে একটু একটু করে নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করেন লি কুয়ান। ৯ আগস্ট ১৯৬৫, লি কুয়ান ইউ জনগণের পক্ষ থেকে রিপাবলিক অব সিঙ্গাপুরের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সময়েই ঘোষণা করা হয় সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের মূল নীতি হবে— স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, জনকল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সাম্য।’

১৯৬৫ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উন্মেষের আগে ও পরে বেশি কিছু কঠিক সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। শুধু ১৯৬১ সালেই এ দেশে ১১৬টি ধর্মঘট সংঘটিত হয়েছে। ১৯৬০ থেকে ’৬৭ সালের মধ্যে নেতাদেরকে মোট ৩৮৯ ধরনের বিরোধ সামাল দিতে হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং জনপ্রশাসনের সংস্কারসহ নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে অবস্থার অমূল পবির্তন সাধিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালের পর থেকে এ দেশে আর কোনো ধর্মঘট হয়নি।

স্বাধীনতার সময় এখানকার মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫১১ মার্কিন ডলার। এখন ২০১৩’র হিসাব অনুযায়ী মাথাপিছু আয় (পিপিপি) ৬১, ৫৬৭ মার্কিন ডলার। ২০১০ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৫ শতাংশ। জীবনযাত্রার গুণগত মান বিবেচনায় এ দেশের অবস্থান এখন এশিয়ায় প্রথম এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ১১তম। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্বে এ দেশের অবস্থান যথাক্রমে ১৫ এবং ১৪তম স্থানে। একই সময়কালে এদের ভাণ্ডারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যা ছিল, তা বিশ্বের নবম সর্বোচ্চ রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। অন্যদিকে এ দেশের বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক শূন্য।

পরিকল্পিত উন্নয়নের জোয়ারে জীবনযাপনে এসেছে অভাবিত পরিবর্তন, সে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে মনোজগত। দেশটিতে শিক্ষিতের হার ৯৬ শতাংশ, মানুষের গড় আয়ু ৮০.৬ বছর, আবাসন সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিক ৯০.১ শতাংশ এবং প্রতি ১০০০ জনে ১০৭ জন ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক। অভিবাসীদের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল শ্রমঘন সেক্টরে। কৃষিকাজ তেমন একটা হতো না; এখন তো একেবারেই নেই। এক কেজি চাল, এক লিটার দুধ কিংবা একটি ফল কোথাও উৎপাদন করা হয় না। শুধু সীমিত পরিসরে মাছ-মুরগি উৎপাদন করা হয়।

পুরো নগররাষ্ট্রটি কঠোর নিয়ম-নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। আইনের প্রশ্নে এখানে কারো জন্য কোনো ছাড় নেই। সবার জন্য আইন সমভাবে প্রযোজ্য। এ একবিংশ শতাব্দীতেও এ রাষ্ট্রে বেত্রাঘাতসহ মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠিন শাস্তি বহাল আছে। এ দেশে কোনো করপোরেট ক্রাইম নেই, কোনো গ্যাংস্টার নেই, চাঁদাবাজ নেই, মাফিয়া চক্র নেই, মাদক সম্রাট নেই। উপরন্ত মানুষ এবং সম্পদ রাষ্ট্র কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত। পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা শতভাগ নিষ্কলুষ এবং গণমুখী।

উন্নতির জন্য চায় সুশাসন ও সুযোগ্য নেতৃত্ব যেটা সিঙ্গাপুর গঠনের ক্ষেত্রে লি কুয়ান করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু ও পরে জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর সে রকম কোনো নেতা আমাদের মাঝে আসেনি। ফলে পরে যারা ক্ষমতায় এসেছেন বা আছেন সোনার বাংলা গঠনে তাদের কাজে ন্যায়-নিষ্ঠা ও একান্ত আনুগত্যতা আমাদের তেমন চোখে পড়েনি। তাই স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পার হয়ে গেলেও সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সক্ষম হননি আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কিন্তু মাত্র এক দশকেই লি কুয়ান সিঙ্গপুরের ক্ষেত্রে ‘অসম্ভব’ সেই উন্নতি করিয়ে দেখিয়েছেন।

সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতেও ব্যর্থ হয়েছেন পরের প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতারা। ফলে সংঘাত বেড়েছে। একে অন্যের মাঝে রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যেটা এখনো আমাদের দেশে চলছে। আইএমএফ সতর্ক করেছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলতে থাকলে প্রবৃদ্ধি ৬ বা এর চেয়ে নিচে নেমে যেতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল এবং সুশাসনের অভাবে দেশের অর্থনীতি বেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছে, রাজনৈতিক অবস্থা এরকম অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো থাকায় এখন কিছু মনে না হলে ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে পারে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সুশাসন, দুর্নীতিরোধ, সুযোগ্য নেতৃত্ব, আধুনিক অর্থনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে লি কুয়ান জেলেপল্লি থেকে আধুনিক সিঙ্গাপুর বানাতে পেরেছিলেন। আর এগুলোর অভাবেই আমরা বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে পরিনি। ফলে আমরা সেদেশে গিয়ে কাজ খুঁজি আর তারা আমাদের কাজ ও রুটিরুজির ব্যবস্থা করে।

লেখকঃ এস এম কামরুজ্জামান (সাংবাদিক ও গবেষক), সৌজন্যেঃ রাইজিংবিডি