Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মেয়র হোক বা নগরপিতা : আবর্জনা সাফ করতেই হবে

hazaribagতিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে দুটি ঢাকায়- উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আর একটি হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কাজেই খবরে, আলাপ-আলোচনায় নির্বাচন, প্রার্থী মনোনয়ন ইত্যাদি চলে এসেছে। জানুয়ারি মাস থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা এখনও শেষ হয়নি। এ আন্দোলনের দাবি হচ্ছে একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের জন্য। সেটার জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা নয়, এরই মধ্যে করতে হবে। কারণ এখন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।

সরকার নির্বাচন এখন না দিলেও অন্তত একটি সংলাপ করার জন্য শুধু ২০ দলীয় জোট নয়, দেশের মধ্যে নানাভাবে সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ, সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে প্রায় সবাই চেয়েছেন। বলা যায়, এখনও সবারই তাই প্রত্যাশা। কূটনৈতিকপাড়া সক্রিয় হয়েছিল, এখনও ক্রমাগতভাবে বলেই যাচ্ছেন তারা। জাতিসংঘ বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। কিন্তু সরকার কিছুতেই শোনেনি, শুনবে বলে কোনো আভাসও পাচ্ছি না। সবারই ধারণা জন্মেছে, নির্বাচন যদি সত্যিকার অর্থে হয় তাহলে ক্ষমতাসীন দলের হারার ভয় আছে। কাজেই পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন সেটাকেই বৈধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এটাই সরকারের অঙ্গীকার। আর বিএনপি, যার নতুন নাম দেয়া হয়েছে ‘মাঠের বিরোধী দল’ তারা নির্বাচন না করে ভুল করেছেন- এ কথাও বারবার বলতে হবে, তাহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আরও বৈধতা পায়। এটা কেউ বলে না যে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন তো আসলে শুধু প্রার্থীবিহীন ছিল না, সেটা ভোটারবিহীনও ছিল। কাজেই বিরোধী দল ট্রেন ফেল করেছে বলে তাদের খেসারত দেয়ার যে কথা বলা হয় তা হাস্যকর লাগে। খেসারত সরকারকেও দিতে হচ্ছে! আর পিষ্ট হচ্ছে জনগণ।

chardike-ad

কিন্তু এর মধ্যে কী এমন হলো যে, হঠাৎ সরকারের নির্বাচনভীতি কেটে গেল? নির্বাচন কমিশন, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে কিনা জানি না; কিন্তু সরকারের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু হয়ে গেছে ধুমধাম। একজন পুলিশ কর্মকর্তার কথায় নির্বাচনের তারিখও নির্ধারিত হয়ে গেছে এপ্রিলের শেষের দিকে। শিক্ষামন্ত্রী আগেভাগেই ঘোষণাও দিয়েছেন, সেই তারিখগুলোতে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা থাকবে না। এত প্রস্তুতি? মনোনয়নপত্র জমা দেয়া শেষ হয়েছে ২৯ মার্চ। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমর্থিত প্রার্থীরা। যদিও এটা দলীয় নির্বাচন হওয়ার কথা নয়। মেয়র পদে ঢাকা উত্তরে ২১ জন, ঢাকা দক্ষিণে ২৬ জন ও চট্টগ্রাম সিটিতে ১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে সব মিলিয়ে ঢাকা উত্তরে ৬৫০, ঢাকা দক্ষিণে ৮১১ ও চট্টগ্রামে ৩৭২ জন প্রার্থী হয়েছেন। (যুগান্তর, ৩০ মার্চ, ২০১৫)। যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন আজকাল তাদেরই টকশোতে দেখা যায়। তারা দলীয় রঙ লুকিয়ে রেখে ‘নিরপেক্ষ’ বিশ্লেষণ দিয়ে চলেছেন। টকশো দেখার আগ্রহ আজকাল অনেকেরই আর নেই। আর বিএনপি যেন নির্বাচনে আসে এবং এসে যেন ভালো মতো হেরে যায় তার জন্য মন্ত্রী ও আওয়ামী নেতাদের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা তারা নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করে যাচ্ছেন। ধন্যবাদ।

এ নির্বাচন শেষ পর্যন্ত ঠিকমতো হতে পারবে কিনা, বিএনপির প্রার্থী সমর্থন দেয়া আদৌ ঠিক কিনা সেসব প্রশ্নে আজ আমি যাব না। তিনটি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানী ঢাকা মেয়রবিহীন অবস্থায় দীর্ঘদিন রয়েছে, আমলা দিয়ে যে কাজ হয় না তা তারা সফলভাবেই প্রমাণ করে ছেড়েছে। কাজেই একজন নির্বাচিত মেয়র অবশ্যই দরকার, তবে তা হতে হবে জনগণের স্বার্থরক্ষা করতে পারে এমন মানুষ। আমি মেয়র পদপ্রার্থী কয়েকজন ধনী ও এলিট মানুষকে দেখে একটু চিন্তিত হচ্ছি, কারণ নগরে তো শুধু ধনীরাই থাকেন না, থাকেন মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষ। ট্যাক্স ও সবাই দেন। কিন্তু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও গরিবরা ট্যাক্স দেন; কিন্তু সুযোগ-সুবিধা ঠিকমতো পান না। এ অন্যায় আমরা অনেক দিন ধরে দেখে আসছি। ধনী প্রার্থীরা মেয়র হলে কি গরিব নাগরিকদের সেবার কথা মনে রাখবেন, নাকি ধনীদের ড্রইং রুমে তাদের প্রশংসার ঝড় বয়ে যায় এমন ব্যবস্থা করে গরিব নাগরিক উৎখাত করে দেবেন? বস্তিবাসী নাগরিক কিনা সে প্রশ্ন ওঠে নাগরিক সেবা দেয়ার সময়। ওয়াসার লাইন পেতে হলে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি মেলে না, এসব অভিজ্ঞতা অতীতে দেখেছি। তাই প্রথম কথা হচ্ছে, নির্বাচন করুন ঠিক আছে, নাগরিক কিন্তু সবাই। কারও অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তা মেনে নেয়া যাবে না।

অভিধানে ইংরেজিতে মেয়র শব্দের অর্থ নগরাদির প্রধান। একটু ব্যাখ্যা করে বলা হয়-the head of a municipal corporation of a city, পৌর প্রতিষ্ঠানের কর্তা ইত্যাদি। কিন্তু কেন জানি বাংলাদেশে মেয়রকে ‘নগরপিতা’ বলা হয় তা আমার কাছে অজানা। যে কারণই হোক, আমার কাছে এটা অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ও বাজে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার প্রতিফলন মনে হয়। এখানে প্রথম সমস্যাই হচ্ছে, ধরে নেয়া হচ্ছে মেয়র একমাত্র পুরুষরাই হবেন। নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভীকে নগরমাতা বলতে শুনিনি। তিনি নির্বাচিত হয়ে গেছেন, তাকে তাই বলে নগরমাতা বলা হয় না। যদি হয় এটাও হবে পুরুষতান্ত্রিকতা। নগরের সেবা দেয়ার কাজ করতে হলে মাতা-পিতা হওয়ার দরকার পড়ে না। তিনি জনপ্রতিনিধি, জনগণের সেবা নিশ্চিত করাই তার কাজ। এবার ঢাকায়ও একজন নারী মেয়র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি যদি নির্বাচিত হন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই নগরপিতা হবেন না। তাই আগেভাগেই পুরুষ-নারী সবাইকেই বলছি, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জিতে পুরুষতন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে নগরপিতা নয়, বা নগর শাসক নয়, নগর সেবক ঘোষণা করতে পারেন কিনা বিবেচনা করবেন। নিজের প্রার্থিতা প্রচারণায় যেন সে কথা স্পষ্ট হয়।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের একজন করদাতা ও ভোটার হিসেবে আমি জানতে চাই, যিনি মেয়র হবেন তিনি কী অঙ্গীকার করবেন যে, তার প্রথম কাজ হচ্ছে ঢাকা শহরের আবর্জনা সাফ করা? ঢাকা শহরকে বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়ে গেছে আন্তর্জাতিকভাবে। শুধু ট্রাফিক জ্যাম নয়, রাস্তার ধারে ওয়াসা, গ্যাস-বিদ্যুৎ লাইনের কাটাকুটি নয়, ময়লার স্তূপের কারণে ভয়ানক ও অসহ্য দুর্গন্ধময় শহরে পরিণত হয়েছে এ শহর। যত বিল্ডিং হচ্ছে, আবর্জনা তত বাড়ছে। আবাসিক এলাকায় হেঁটে গেলে, রিকশায় গেলে ময়লার গন্ধে নাক বন্ধ করলেও কাজ হয় না, গাড়িতে গেলে জানালার কাচ তুলে দিলেও ভেদ করে চলে আসে। আর সবচেয়ে বিড়ম্বনা হয় ট্রাফিক জ্যামে দিনে-দুপুরে ঠিক সামনে একটি ময়লার ট্রাক থেমে থাকলে। এ সময় মনে হয় আসলেই আমলারা অফিস টাইমের বাইরে কাজের পরিকল্পনা করতে জানেন না। জ্যামে মনে হয় নিজেরা কখনও ময়লার ট্রাকের পেছেন পড়েন না। মন্ত্রীদের জন্য রাস্তা সব সময় ক্লিয়ার করে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী জীবনেও এই গন্ধ কি দুর্বিষহ জানার সুযোগ পাবেন না। তার নিরাপত্তার কারণে তাকে নগরবাসীর সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাই তিনি যাদের ডেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন তারা আবর্জনার খবর রাখেন কিনা এ বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ কাজ করছে। এখনও সময় আছে এ ধরনের উচ্চ শ্রেণীর প্রার্থীরা যেন একটু ঢাকা শহরে আবর্জনার হিসাব নেন, সরাসরি গন্ধ শুঁকে নেন তাহলে ভালো মেয়র হতে পারবেন।

তাদের সুবিধার জন্য দুই-একটি গবেষণা থেকে ঢাকার আবর্জনার হিসাব দিচ্ছি। জাপান সরকারের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে করা ঈষবধহ উযধশধ গধংঃবৎ চষধহ-এর জন্য করা জরিপ অনুযায়ী দিনে ২ হাজার ৭৬৭ টন প্লাস্টিক, কাগজ, গ্লাস, ধাতব পদার্থ এবং বাসাবাড়ির আবর্জনা (প্রায় ২ হাজার ২১১ টন) সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে প্লাস্টিক, কাগজ ও গ্লাস সামগ্রী রিসাইকেল হয় বেশিরভাগ; কিন্তু বাসাবাড়ির আবর্জনা যা মূলত দুর্গন্ধ ছড়ায় তা রিসাইকেল হয় মাত্র ৬ টন। আরেকটি গবেষণায় জাপানি গবেষক ও বাংলাদেশের বুয়েটের গবেষকের (২০০৫ সালে প্রকাশিত) প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বর্তমানে দিনে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ টন আবর্জনা তৈরি হচ্ছে, ২০২০ সালে গিয়ে তা ৩০ হাজার টনে গিয়ে ঠেকবে। বিল্ডিংও বাড়বে, ময়লাও বাড়বে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের এত ব্যাপক পরিমাণ আবর্জনা পরিষ্কার করার ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। জনবলের ঘাটতি যেমন আছে, তেমনি আছে তথ্যের ঘাটতি। ব্যবস্থাপনার তো কোনো চিন্তাই নেই। সিটি করপোরেশনের জানা দরকার যে, সলিড ও ক্ষয় হয় এমন আবর্জনার প্রায় ৫০ ভাগ বাসাবাড়ি থেকে আসে। তাদের এ কাজটি প্রথমে অবশ্যই করতে হবে। এ বাসাবাড়ির মানুষই কর দেয়। তাদের সেবা পাওয়ার অধিকার আছে। আর শিল্প-কলকারখানা, হাসপাতালের আবর্জনা সাফ করাও খুব জরুরি। তারাও কর দেন; কিন্তু তারা নিজেরাও কিছু দায়িত্ব নিতে পারেন।

আর বেশি বলতে চাই না। শুধু বলব, নির্বাচনের প্রচারে ঢাকা শহরকে বাতি দিয়ে ও বড় বড় রাস্তা এবং ব্রিজ বানিয়ে সুন্দর করার ঘোষণা দিয়ে ভোটারদের মুগ্ধ করার আগে আবর্জনা পরিষ্কারের অঙ্গীকার চাই।

ফরিদা আখতার : নারীনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী