Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে সিলেট

sylhet

বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে একযোগে কয়েক দফা ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় ‘ডেঞ্জার জোন’ খ্যাত সিলেটের বাসিন্দাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ও মোকাবেলার কোনো প্রস্তুতি না থাকায় এ আতঙ্কের মাত্রা বেড়ে গেছে আরো কয়েকগুণ।

chardike-ad

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক দশকে সিলেট মহানগরী ও এর আশপাশে ব্যাপক হারে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, মার্কেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আবাসন প্রকল্প। এসব ভবনের অধিকাংশেরই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে।

এদিকে বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অনুমতি নেয়া হলেও নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। দ্বিতল ভবনের অনুমতি নিয়ে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করলেও দেখার কেউ তা নেই। তাছাড়া মহানগরীর অধিকাংশ ভবন নির্মিত হয়েছে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করেই। এমন কি সয়েল টেস্ট ছাড়াই নির্মিত হয়েছে অধিকাংশ ভবন। ফলে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছে এখানকার বাসিন্দারা।

সিলেটে গড়ে ওঠা প্রায় ২শ’ বহুতল ভবনের একটিরও নেই ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের চূড়ান্ত ছাড়পত্র। এছাড়া অনেকেই সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করে অবৈধভাবে তৈরি করেছেন বহুতল ভবন।

ছাড়পত্রহীন ভবনগুলোর বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযানে নামছে ফায়ার সার্ভিস- এমন তথ্য পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।

সিলেটের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিস সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতল বা তার চেয়ে বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। দুর্যোগ দেখা দিলে নিরাপদে বের হওয়ার জন্য প্রতিটি ভবনে জরুরি বর্হিগমন পথ, অগ্নি নির্বাপনের জন্য পানি, ড্রাই পাউডার ও ফায়ার এক্সটিনগুসারের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক। একইভাবে ৫ হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের একতলা ভবনের ক্ষেত্রেও ফায়ার সার্ভিসের এ নীতিমালা প্রযোজ্য। কিন্তু এসব ব্যবস্থা না রেখেই সিলেটে একের পর এক গড়ে ওঠছে আকাশচুম্বি বহুতল ভবন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেট অফিসের সহকারি পরিচালক মো. শহিদুর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি বহুতল ভবনে সেফটি প্ল্যান থাকা আবশ্যক। সিটি করপোরেশন থেকে নকশা অনুমোদনের আগে ভবন মালিককে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিতে হয়।’

সিলেট ফায়ার সার্ভিসের কাছে নগরীর প্রায় ২শ’ বহুতল ভবনের তালিকা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ভবন মালিক ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রাথমিক অনুমোদন নিয়েছেন। ওই অনুমোদনে ভবন মালিকদের ‘সেফটি প্ল্যান’ বাস্তবায়নে ৩২টি শর্তজুড়ে দেয়া হয়। শর্তগুলো পূরণ করে ফায়ার সার্ভিসকে অবগত করলে ভবন পরিদর্শন করে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিলেটের কোনো ভবন মালিকই চূড়ান্ত ছাড়পত্র নেননি।’

মো. শহিদুর রহমান আরও বলেন, ‘ভূমিকম্পের জন্য সিলেট হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। অথচ সিলেটে গড়ে ওঠা বহুতল ভবনগুলো গড়ে ওঠছে ঝুঁকিপূর্ণভাবে। ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালা না মেনে গড়ে ওঠা ভবনগুলোতে ধস বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। ছাড়পত্রহীন ভবনগুলোর বিরুদ্ধে শিগগিরই ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করা হবে।’

দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ও মোকাবেলার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিলেটে লোকবল বা সরঞ্জামাদি ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ দুর্যোগ ও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়।’

ইতিহাস থেকে জানা যায়: ১৫৪৮ সালে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সিলেট এলাকায় ব্যাপক ভূ-পরিবর্তন ঘটে। উঁচু-নিচু ভূমি সমতলে পরিণত হয়। এরপর ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ ও ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্পে সিলেটের মানচিত্র পাল্টে যায়। সিলেটে এ যাবৎকালের মধ্যে ১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকাল সোয়া ৫টার দিকে সংঘটিত ভূমিকম্প ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক’ নামে পরিচিত। ৮ দশমিক ৭ মাত্রার সেই ভূমিকম্প ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ বর্গ কি.মি. এলাকায় পাকা দালানকোঠার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। শুধু সিলেট জেলাতেই ভেঙে পড়ে ৫৪৫টি ভবন। বাড়িচাপা পড়ে মারা যায় প্রচুর মানুষ। এ ভূমিকম্পে সৃষ্টি হয় বিশাল আকারের হাওর, বিল ও জলাশয়ের, যা আজো বিদ্যমান। এরপর ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই সিলেটের শ্রীমঙ্গলে সংঘঠিত ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর তীব্রতা ছিল ৭.৬।

২০০৯ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) পরিচালিত জরিপে উল্লেখ করা হয়, সিলেট অঞ্চলে ৫২ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ হাজার ভবনই ভূমিকম্পের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। সেই জরিপ অনুযায়ী দেশে ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সে সময় ওই জরিপের ফলাফল আশঙ্কাজনক বলে মন্তব্য করেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা।

তারা বিল্ডিং কোড অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিলেও এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এজন্য ভূমিকম্পকে ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার অব ডিজাস্টার’ (এসওডি)-এর অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের ভয়াবহ ঝুঁকিতে থাকলেও এ অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত জরাজীর্ণ ভবনের সংখ্যা কতো তার হিসাব নেই সিলেট সিটি করপোরেশন ও গণপূর্ত বিভাগের। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উদ্যোগে ২০০৬ সালে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, সিলেটে একশ থেকে দেড়শ বছরের প্রাচীন শতাধিক ভবন রয়েছে। সিলেট মহানগরীতেই এ ধরনের স্থাপনা রয়েছে শতাধিক।