Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

উচ্চতা বাড়ছে সাগরের, আতঙ্কে অর্ধকোটি মানুষ

Coxbazzarক্রমশ বাড়ছে সাগরের উচ্চতা। অব্যাহত ভাঙনে ফলে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। এর ওপর বেড়িবাঁধ না থাকায় আতঙ্কে ভুগছেন উপকূলীয় এলাকার অর্ধকোটি মানুষ।

 

chardike-ad

কক্সবাজার সৈকতের কলাতলী গ্রামের মফিজুর রহমান জানান, সমুদ্রের এরকম আগ্রাসী রূপ জন্মের পর থেকে আর দেখেনি। গত কয়েক বছরে তলিয়ে গেছে কলাতলী গ্রামের শতাধিক বাড়ি-ঘর। কেবল ভাঙছেই। সরকারি উদ্যোগে পাথরের বাঁধ দেওয়া হয়েছিল গ্রামকে ঘিরে। সে বাঁধ এখন সমুদ্রে বিলীন।

 

কক্সবাজার শহরের নাজিরার টেক থেকে টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সৈকতের বিশাল এলাকা এভাবেই সাগরের আগ্রাসী ভাঙনে তলিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সাগরে বিলীন হয়েছে সৈকতের নয়নাভিরাম ঝাউ বাগান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হ্যাচারিসহ মেরিন ড্রাইভ সড়কের এক কিলোমিটার অংশ। সাগরের এই অব্যাহত ভাঙনে পর্যটননগরী এখন হুমকির মুখে। পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগকারীরাও আতঙ্কিত।

 

স্থানীয় অধিবাসীদের মতে গত কয়েক বছর ধরে সমুদ্র যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তাতে উপকূলবাসী আতঙ্কিত। জোয়ারের পানি বেড়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি। অনেক স্থাপনা সমুদ্র গ্রাস করেছে। বিলীন হয়ে গেছে হিমছড়ি, সোনারপাড়া, ইনানী, টেকনাফ, সাবরাং ও শাহপরীর দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ভূমি।

 

কক্সবাজার সৈকত, হিমছড়ি এবং টেকনাফের নয়নাভিরাম তিনটি বিশাল ঝাউ বাগান রেহাই পায়নি সমুদ্রের গ্রাস থেকে। ১৯৯১-এর ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়টি যখন আঘাত হানে, তখন তার সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ঝাউবন। এখন এখানে স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটি গাছ মাত্র। বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা সজল কান্তি ধর জানিয়েছেন, গত বর্ষায় পাঁচ হাজার ঝাউ গাছ সাগরের বুকে চলে গেছে।

 

ভাঙছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন
শতাব্দীর ভয়াবহ সব ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস কিংবা সুনামির ধাক্কা সামাল দিয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সাহসী মানুষ। এখন দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপের প্রায় আট হাজার মানুষ আতঙ্কিত। কারণ সমুদ্রের পানি ফুঁসে উঠছে। শতাব্দীকাল ধরে যে দ্বীপ কখনো ভাঙেনি, সেই দ্বীপ এখন সাগরের আগ্রাসী ভাঙনের শিকার। দ্বীপের পশ্চিমাংশে বিশাল ভূমি তলিয়ে গেছে সমুদ্রে। এখন ভাঙন শুরু হয়েছে দ্বীপের পূর্ব অংশেও।

 

দ্বীপবাসীর মনে এতদিন একটি ধারণা ছিল, প্রবাল দ্বীপ কখনও তলিয়ে যাবে না। কিন্তু গত কয়েক বছরে সাগরের রুদ্র রূপ দেখে তাদের সেই অহংকারে চিড় ধরেছে। জীবন-জীবিকা এবং তাদের শত বছরের আবাস ভূমি নিয়ে তারা এখন আতঙ্কিত।

 

মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে ধলঘাটা দ্বীপ
কক্সবাজার সাগর উপকূলের আরেকটি দ্বীপ ধলঘাটা। ১৯৬০ সালে এ দ্বীপের আয়তন ছিল ৩৭ বর্গকিলোমিটার। সাগরে ভাঙতে ভাঙতে ১৯৮০ সালে এসে এর আয়তন ২০ কিলোমিটারে নেমে যায়। তখনও দ্বীপের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজারের মতো। এখন ধলঘাটা দ্বীপের আয়তন ১২ বর্গকিলোমিটার। আর বর্তমানে দ্বীপের লোকসংখ্যা ২৪ হাজার। সাগরের ভাঙনের কবলে পড়ে দ্বীপটি প্রতিনিয়ত আয়তনে ছোট হচ্ছে। দ্বীপবাসীকে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হচ্ছে।

 

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি আকতারুজ্জামান বলেন, ধলঘাটার অধিকাংশ গ্রাম এখন সমুদ্রের নিচে ডুবে আছে। আগে এভাবে পানি বাড়তে দেখেননি তারা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় এ সমস্যা হয়েছে বলে তাদের ধারণা।

 

কুতুবদিয়া দ্বীপের এক লাখ মানুষ উদ্বাস্তু
দেশের প্রখ্যাত দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দ্বীপটি সমুদ্রবক্ষ থেকে জেগে ওঠে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে। গঠিত হয়েছে সাঙ্গু (শঙ্খ) ও মাতামুহুরী নদীর পলি দিয়ে। সৌন্দর্যের রাণী কুতুবদিয়ায় মানুষের পদাচারণা ঘটে ১৫০০ খিস্টাব্দের শেষের দিকে। ধর্মসাধক কুতুবুদ্দিন বখতিয়ারের নামানুসারেই এ দ্বীপের নাম হয়েছে কুতুবদিয়া। শতাব্দী কাল আগে দৃষ্টিনন্দন এই দ্বীপের আয়তন ছিল ৪০ বর্গমাইলের বেশি। ভাঙতে ভাঙতে এখন ২০ বর্গমাইলে এসে ঠেকেছে।

 

এলাকাবাসী জানান, কুতুবদিয়া দ্বীপ প্রতি বছর ভাঙছে। ১৮৮১ সালের জরিপে দ্বীপের আয়তন ছিল ৪৫ বর্গমাইল, ১৯০১ সালের জরিপে ৪১ বর্গমাইল এবং ১৯৯০ সালে এসে দ্বীপের আয়তন দাঁড়ায় ২৭ বর্গমাইলে (৬৯.১২ বর্গ কিলোমিটার)। এখন এই দ্বীপের আয়তন ২০ বর্গমাইলে এসে ঠেকেছে। কুতুবদিয়া দ্বীপের এক লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে।

 

বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী জানিয়েছেন, শুধু কুতুবদিয়া দ্বীপ নয়, বঙ্গোপসাগরের ৭১০ কিলোমিটার সমুদ্র উপকূলের মানুষ এভাবেই উদ্বাস্তু হচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে উপকূলে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়ি হারিয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে ‘পরিবেশগত উদ্বাস্তুর’ সংখ্যা। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হার দ্রুত গতিতে বাড়ছে।

 

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) গবেষণায় বলা হয়েছে, উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা গত ৩০ বছর ধরে পাঁচ মিলিমিটার করে বাড়ছে। এটা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ তা ২৭ সেন্টিমিটার ছাড়িয়ে যাবে। আর তখন দেশের উপকূলীয় জেলার গৃহহীন মানুষকে স্থানান্তরিত হতেই হবে।

 

সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমান হারে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ স্থলভাগের বড় একটি অংশ তলিয়ে যাবে পানির নিচে। আর এর প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোর কমপক্ষে দুই কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবে।