Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই জিহাদের পথ তৈরী করেছেন!

mayanmar-3সম্প্রতি পাকিস্তান তালেবানের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের প্রতি ‘তলোয়ার হাতে তুলে নিয়ে আল্লাহর পথে হত্যা চালানোর’ ডাক দেয়া হয়। বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল, নিন্দা প্রস্তাব সবকিছুকেই অকেজো উল্লেখ করে এবং জিহাদের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, একমাত্র জিহাদই পারে পরিবর্তন আনতে। দীর্ঘদিন ধরে এমনই এক আশঙ্কার অজুহাতে মুসলিম রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।

তবে হুমকিটি আদতে মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশঙ্কারই বাস্তব রূপ নাকি তাদের আশঙ্কাজনিত সহিংসতারই ফলাফল? ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেনডেন্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সেই প্রশ্নটিই তুলেছেন সংবাদমাধ্যমটির বিদেশ প্রতিনিধি ও ফিচার লেখক পিটার পোফাম।

chardike-ad

তাঁর মতে দীর্ঘদিন ধরে নিজেরাই সহিংস হুমকির পথ তৈরি করেছেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। নিবন্ধে বলা হয়, বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম হলেও মিয়ানমারে অন্য ধর্মের মানুষকে শান্তিকামনার আওতায় রাখতে চান না বেশিরভাগ বৌদ্ধ ভিক্ষু। আর যারা সেখান থেকে বের হয়ে এসে স্বাধীন ধারায় ধর্ম প্রচার করতে চান, শান্তির বাণী শোনাতে চান সেসব ভিক্ষুদের নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। পিটারের সে নিবন্ধটি প্রিয় পাঠকদের জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।

রোহিঙ্গাদের প্রতি তালেবানের জিহাদের ডাকের কথা উল্লেখ করে নিবন্ধে বলা হয়, ‘হঠাৎ করে এক দুঃস্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার দোরগোঁড়ায় পৌঁছে গেল মিয়ানমার। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা জানিয়ে আসছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। আর সে আশঙ্কা থেকে তারা যে শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশ তৈরি করেছেন, তাতে দেশটির সরকার বাধ্য হয়েছে আরাকান রাজ্যে রাষ্ট্রহীনভাবে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করতে। আর বলা যায়, এ ধরনের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে একরকম নিজেদের পূর্বাভাসকে নিজেরাই বাস্তবায়িত করেছেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।

mayanmar-1পিটার বলেন ‘বিশ্বব্যাপী সহিংস জিহাদি মুভমেন্ট বিভিন্ন ধর্ম, ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ইস্যুটি একেবারে সুনির্দিষ্ট। আর তাহল হাজার বছর ধরে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে দেশটিতে বৌদ্ধ ধর্ম দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং বিলুপ্তির পথে আছে। নিবন্ধে অভিযোগ করা হয়, হাজার বছরের সে আশঙ্কার ধারাবাহিকতায় অ-বৌদ্ধজনিত আচরণ করে যাচ্ছেন বর্তমান সময়ের বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ধর্মান্ধ বৌদ্ধরা। অজানা এক আশঙ্কায় রোহিঙ্গাদের জন্য অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছেন তারা।’

সময়ের সাথে পাল্টেছে ভিক্ষুদের প্রচারণার ধরন
বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম উল্লেখ করে নিবন্ধে বলা হয়, ২০০৭ সালে মেত্তা সূত্তা অর্থাৎ প্রেমময় উদারতার সূত্র ধ্বনিত করতে করতে মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরে মিছিল করেছিল হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু। সূত্রটি ছিল: ‘যাই হোক না কেন, মানুষের শ্বাস আছে, সবাই একটি সুখী জীবন লাভ করতে পারে….আমাদের অগণিত ভালোবাসা ধারণের উদ্দীপনা হোক।’ এ মেত্তা সুত্তার মধ্যে একবারও মুসলিমদের শুভকামনা থেকে বাদ দেয়া হয়নি।

তবে সময়ের সাথে সাথে পাল্টেছে শান্তি কামনার ধরন। গেল মাসে, বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং তাদের সমর্থকেরা আবারও ইয়াঙ্গুনে মিছিল করে। তবে এবার তাদের সুর ছিল ভিন্ন। এ দফায় বিক্ষোভের উদ্দেশ্যই ছিল মানব পাচারের শিকার হয়ে আন্দামান সাগরে ভাসমান বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে রাজি না হওয়ার জন্য মিয়ানমারকে দোষারোপ করার নিন্দা জানানো।

অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমারের ওপর যে চাপ তৈরি করছে তার নিন্দা জানাতেই রাস্তায় নামেন ভিক্ষুরা। তাদের বক্তব্য ছিল যে, ভাসমান মানুষরা সহায়তা পাওয়ার যোগ্য নন, এমনটা তারা মনে করেন না। তবে ভাসমানদের আশ্রয় না দেয়ার সিদ্ধান্তে মিয়ানমারকে দোষ দেয়া হচ্ছে-সেটাই ছিল তাদের ভাবনার বিষয়।

তাদের দাবি, যেহেতু সাগরে ভাসমানদের চামড়া কালো এবং তারা মুসলিম, সুতরাং তারা বার্মিজ হতে পারেন না। তবে আশ্চর্যজনক বৈপরীত্য হলো ইয়াঙ্গুনে হাজার হাজার মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বাস করলেও ধর্মান্ধদের দৃষ্টিকোণ থেকে মিয়ানমার হলো একমাত্র ভূখণ্ড যেটিকে শুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্মের দেশ বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আর ধর্মান্ধরা দেশটিকে সেরকম বিশুদ্ধ রাখার পক্ষেই কথা বলে।

কথা বললেই বিপদ
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে যারা এর বিরোধিতা করেন তাদের পড়তে হয় বিপদে। এমনই একজন ইউ পিন্নায়াসিহা। সহকর্মীদের মুসলিম বিরোধী ভূমিকার নিন্দা জানানোর পর বৌদ্ধ ভিক্ষু নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি পরিষদ মা হা না তাকে ধর্মপ্রচারক পদ থেকে নিষিদ্ধ করে।

‘বৌদ্ধ ধর্মের নীতি হলো মানুষকে বাঁচানো, তাদের সহায়তা করা, সবার প্রতি ভালোবাসা দেখানো। মানুষের গায়ের রং এবং ধর্ম দিয়ে তাদের বিবেচনা করা ঠিক নয়। যেসব মানুষ নির্দিষ্ট ধরনের মানুষকে ভালবাসতে চায় না তারা বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধী।’ আর শান্তির এ বার্তাটি পৌঁছাতে গিয়েই নিষিদ্ধ হন পিন্নাসিহা।

রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলে বিক্ষোভ
মিয়ানমারে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যে এবং অনুমতি নিয়ে রাস্তাজুড়ে ভাসমান মানুষদের আশ্রয়দানবিরোধী বিক্ষোভ চলে। সেখানে কোন পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি থাকে না।

mayanmar-4ভোটার ও ধর্মের রাজনীতি
মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে অং সান সুচিসহ রাজনীতিবিদদের চুপ থাকার বিষয়টি উল্রেখ করেন পিটার। তিনি বলেন, উদারপন্থী ও আন্তর্জাতিক মনোভাব সম্পন্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গাবিরোধিতার সমালোচনা করলেও, নোবেলজয়ী অং সান সুচি নিরব থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন পিটার।

তিনি বলেন, ‘মা বা থা নামে একটি বর্ণ ও ধর্ম সুরক্ষা সংগঠন সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, যারা বৌদ্ধ ধর্মকে সমর্থন দেবে না সেসব রাজনীতিবিদকে ভোট না দেয়ার জন্য প্রচারণা চালাবে তারা। আর এ কারণটিই হয়তো চুপ করিয়ে রেখেছে রাজনীতিবিদদের।’ পিটার বলেন, ভোটারদের টানতে ধর্মের ব্যবহার ২০১০ সালে নির্বাচনী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ হলেও দেশের আইনী ব্যবস্থাকে নাড়া দিয়ে এবং মা বা থা’র সম্পূর্ণ সমর্থন নিয়ে চলছে এ খেলা।

তবে দীর্ঘমেয়াদে বৌদ্ধ ধর্মই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটা বোঝাই যায়। বিপ্লবী ধর্মভিক্ষু ইউ পিন্নাসিহার উদ্ধৃতি দিয়ে নিবন্ধ শেষ করেছেন, পিটার পোফাম। তিনি বলেন, ‘যদি মানুষ নৈতিকতা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি এ তিনটি বিষয় চর্চা করতে থাকে, তখন বৌদ্ধধর্মের প্রজ্ঞা ও আচার বিলীন হবে না।

আর যদি মানুষ তা চর্চা না করে, এ পৃথিবী থেকে তা হারিয়ে যাবে। লোকজন কীভাবে চর্চা করে কেবল তার ওপরই এটি নির্ভরশীল।