Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কোন নবীর আমলে রোজা কেমন ছিলো?

romzanরোজা কেবল উম্মতে মুহাম্মদীর একক বৈশিষ্ট নয়, বরং পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রতিও এই বিধান কার্যকর ছিলো, যা পবিত্র কুরআনে  মহান আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করে বলেন, ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ, তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারে (সূরা বাকারা : ১৮৩)।

উল্লেখিত আয়াতের ‘যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববতীদের উপর’ অংশ দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রোজা শুধু উম্মতে মুহাম্মদীর উপরই ফরয হয়নি বরং অন্যান্য নবিদের যুগেও ফরয ছিলো। ঐতিহাসিক তথ্যে জানা যায়, প্রথম মানুষ ও প্রথম নবি হযরত আদম (আ.) এর যুগে থেকে হযরত ঈসা (আ.) এর যুগ পর্যন্ত রোজার প্রচলন ছিলো। অবশ্য সেই রোজার ধরণ ও প্রকৃতি আমাদের মতো ছিলোনা। সংখ্যাতেও ছিলো ব্যবধান।

chardike-ad

হযরত আদম (আ.) –এর রোজা
প্রথম মানব ও নবি আদম (আ.) রোজা পালন করেছিলেন। এ ব্যাপারে ওলামায়ে উম্মত একমত পোষণ করেছেন। তবে তিনি কতদিন কিভাবে রোজা পালন করেছেন সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল প্রধান পাওয়া যায় না। এ ব্যপারে যে বক্তব্যগুলো প্রচলিত আছে তার নির্ভরযোগ্যতাও প্রশ্নাতীত নয়। যেমন, মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘ হে আদম তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। তবে এই গাছটার কাছেও যেওনা।’ – কেউ কউে বলতে চান তাদেরকে ঐ বৃক্ষের কাছ থেকে নিভৃত রাখাটাও এক ধরনের রোজা। কতিপয় ওলামায়ে কেরাম বলেন, হযরত আদম (আ.) এর উপর প্রতি চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা আবশ্যক। আল্লামা আহামদ বিন মুহাম্মদ নিশাপুরী উল্লেখ করেছেন, জান্নাতের নিয়ামত চলে যাবার পর আদম ও হাওয়া সুদীর্ঘকাল ক্রন্দন করেছেন। খাবার গ্রহণ করেননি, পান করেননি, এবং আদম ও হাওয়া বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এটাও এক ধরনের রোজা পালন। এই বর্ণনার ও নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া যায়নি। মুসা বিন নাসর বাগদাদী বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ আমার উম্মতের উপর ৩০ দিনের রোজা পালন ফরয করে দিয়েছেন। অন্যান্য জাতির উপরও কম বেশি করে রোজা ফরয করেছেন। কারণ, আদম (আ.) গাছ থেকে যখন ফল খান, তা তার পেটে ৩০ দিন অবশিষ্ট ছিলো। যখন তার তওবা কবুল করলেন, তখন বলে দিলেন ৩০ দিন-রাত্র রোজা রাখবে। আমার উম্মতের বেলায় দিনের বেলায় রোজা ফরয, রাতের খানাপিনা আল্লাহ অনুগ্রহকরে ক্ষমা করেছেন।’’ আল্লামা কিনানী এ হাদিসটিকে জাল হাদিসের মধ্যে গন্য করেছেন। মোটকথা, হযরত আদম (আ.) কতদিন রোজা রেখেছেন এর স্ব-পক্ষে নির্ভরযোগ্য কোন দলিল প্রকাশমান নয়। তবে তিনি রোজা রেখেছেন এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, তা স্বতঃসিদ্ধ। আল্লাহ মা’লুম!

হযরত ইদ্রিস (আ.) –এর রোজা
আল্লামা নিশাপুরী ‘আল আরাইশ’ এর ৩৭ ও ৩৮ পৃষ্ঠায় বলেছেন,‘ সাইয়্যেদিনা হযরত ইদ্রিস (আ.) সারা জীবন রোজা রেখেছেন।’

হযরত নূহ (আ.) –এর রোজা
হযরত নূহ (আ.) এর ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেন, তিনি দুই ঈদের দিন ছাড়া সর্বদা রোজা রাখতেন। ইমাম তাবারী (রহঃ) কাতাদাহ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, মুহাররমের ১০ তারিখ নূহ (আ.) তার তরণী থেকে নামেন। অনুসরীদের লক্ষ করে তিনি বলেন, আজ যে রোজা রেখেছো তা পূর্ণ কর, আর যে রাখনি সে রোজার নিয়ত করে নাও (তাবারী)। হযরত মুয়ায বিন জাবাল ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস,মা আতা, কাতাদাহ ও দাহহাক প্রমূখ তাফসীরকারকদের থেকে আল্লামা ইবনে কাসির (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, ইসলামে প্রাথমিক পর্যায়ে রোজা ছিলো, যেনিভাবে অন্যান্য জাতি পালন করতো। আর তা ছিলো প্রত্যেক মাসে তিন দিন। নূহ (আ.) এর যুগ থেকে শুরু হয়। আর রমযানের ৩০ রোজা ফরয হওয়ার পূর্বপর্যন্ত বহাল ছিল (ইবনে কাসির)।

হযরত ইব্রাহিম (আ.) –এর রোজা
হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর রোজা সম্পর্কে আমাদের নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, ইব্রাহিম (আ.) প্রতি মাসের তিনদিন রোজা রাখতেন (ইবনে মাযাহ)। ইমাম তারারী (রহঃ) বলেন, রমযানের ত্রিশ রোজা ফরয ছিলো হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর উপর প্রদত্ত ফরয এর অনুযায়ী (তাবারী)।

হযরত দাউদ (আ.) –এর রোজা
উচ্চ মর্যাদাশীল নবি হযরত দাউদ (আ.)। যাদের উপর প্রধান চারখানা আসমানি কিতাব নাযিল হয়েছে তার একজন হলেন তিনি। তার উপর নাযিলকৃত আসমানি কিতাবের নাম হল‘যাবুর’। হযরত দাউদ (আ.) একদিন রোজা রাখতেন আর একদিন বাদ দিতেন। তার রোজার ব্যাপারে মুসলিম শরিফে উল্লেখ রয়েছে, তুমি রোজা রাখ, আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য সর্বোত্তম আমল রোজা। আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে হযরত দাউদ (আ.) এর রোজা। তিনি একদিন রোজা রাখতেন আর একদিন ইফতার করতেন (মুসলিম)। একবার সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর সারা জীবনে রোজা পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন। ব্যাপারটা মহানবি (সাঃ) শুনে আব্দুল্লাহকে ডাকলেন। ইব্রাহিম (আ.) এর প্রচলিত রোজা পালনকে আদর্শ হিসাবে নিয়ে এক মাসে তিনদিন রোজা পালন করতে পরামর্শ দিলেন। আব্দুল্লাহ্ তাতে সন্তষ্ট না হয়ে তিনি এর চেয়ে বেশি ইবাদতের শক্তি রাখেন বলে জানালেন। মহানবি (সাঃ) বললেন, তাহলে তুমি আল্লাহর নবি দাউদ (আ.) এর রোজা পালন কর। তার চেয়ে বেশি করতে যেওনা। আব্দুল্লাহ (রাঃ) দাউদ (আ.) এর পদ্ধতি জানতে চাইলে রাসূল (সাঃ) বললেন, তিনি একদিন রোজা পালন করতেন, একদিন ভাঙতেন। তিনি আরও বলেন, এটাই উৎকৃষ্ট রোজা পালন। আব্দুল্লহ্ এর চেয়েও বেশী পারবেন বলে জানালেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, এর চেয়ে ভাল রোজা পালন আর নেই (বুখারি)।  ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ হযরত দাউদ (আ.) এর যে জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে, তার পরতে পরতে রয়েছে তার রোজা পালনের ঘটনা বহুল প্রেক্ষাপট। ইসরাঈল নেতা ‘শৌল’ এর মৃত্যুতে দাউদ (আ.) ও তার সঙ্গীরা তার বিষয়ে শোবা ও বিলাপ এবং সন্ধা পর্যন্ত উপবাস করেছিলেন।(শমুয়েলের দ্বিতীয় পুস্তক) ।

হযরত মূসা (আ.) –এর রোজা
তাওরাতে বর্ণিত আছে যে, হযরত মূসা (আ.) সিনাই পর্বতে চল্লিশ দিন আল্লাহর নিকট ছিলেন। সেখানে তিনি রুটিও খেতেন না, পানিও পান করতেন না। অর্থাৎ চল্লিশ দিন রোজা পালন করেছিলেন (কিতাব খুরুজ, বাবঃ ২৪, আয়াতঃ ২৮) ।ওল্ড টেষ্টামেন্ট এর সিফর আল খুরুজের ৩৪-৩৯, তাছনিয়ার ৯-১০ এ রয়েছে, মূসা (আ.) চল্লিশ দিন সিয়াম সাধনায় কাটিয়েছেন। অবিশ্বাস করার কিছু নেই। আল্লাহর সাথে তার কথা হবে, সাক্ষাতের বাসনা তার হৃদয়ে ওহীর লিখিত পুস্তক হাতে পাবেন, এসব অবস্থায় রোজা পালন ছিলো আবশ্যক। তবে বনী ইসরাইলরা বছরে একদিন ফরয রোজা রাখতেন। সেটা হলইয়াওমূল গুফরান বা আশুরা। বছরের বিভিন্ন সমেয় তারা নফল রোজা পালন করে। এই রোজাগুলোর প্রচলন সাধারণত তাদের কোন বিজয় দিবস কিংবা কোন পাদ্রীর প্রণীত নির্দিষ্ট দিবসে হত। তাদের কোন শহরে যদি বিপদ আসতো, মহামারী দেখা দিত, অনাবৃষ্টিজনিত কারনে এমনকি কোন বাদশাহ যদি কোন নতুন প্রকল্পে হাত দিতো তাহলে তারা রোজা পালন করতো। ইয়াহুদীদের আরো কিছু আঞ্চলিক রোজা আছে। যেমন নববর্ষের রোজা। তাদের রোজার ধরণ ছিলো খাদ্য, স্ত্রী সহবাস, ঝগড়া ইত্যাদি পরিহার করা। রোজার সময় নিরবতা পালন ও তাদের অপরিহার্য বস্তুত তাদের রোজার ধরণ বিভিন্ন।

হযরত ঈসা (আ.) –এর রোজা
ঈসা (আ.) তার রিসালাতের কাজ শুরু করার আগে চল্লিশ দিন রোজা রেখেছেন। ইনজীলে বর্ণিত আছে যখন চল্লিশ দিন দিবা-রাত্রি ঈসা (আ.) রোজা পালন করলেন তখন তিনি ক্ষুধা অনুভব করেলন। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে ঈসা (আ.) একদিন রোজা রাখতেন পরবর্তী দু’দিন বিরত থাকতেন। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রোজা পালনের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোরতা পালন করা হতো। এ রোজা ছিল সকাল থেকে মধ্যহ্ন পর্যন্ত। খ্রিষ্টানদের রোজা এক শহর তেকে অন্য শহরে ভিন্ন। রোমের রোজা এবং আলেকজান্দ্রিয়ার রোজা এক ছিলো না। কেউ রোজা পালনের অর্থ প্রাণীর গোশত খাওয়া বারণ মনে করতো, অন্যরা খেত। কেউ মনে করত শুধু মাছ ও পাখির গোশত খাওয়াই রোজা। কেউ আবার শুধুমাত্র ডিম ও ফল ভক্ষন করা বৈধ মনে করত। কেউ আবার শক্ত রুটি খাওয়ার প্রচলন করেছে। পরবর্তী পর্যাযে খ্রিষ্টানগণ বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রোজার প্রচলন করেছে যা অসংখ্য। সে রোজার ধরন ছিলো ৩ ঘন্টা, ৪ ঘন্টা। এসময় রোজাদাররা খেতনা, পানি পান করত। এভাবেই মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রদত্ত বিভিন্ন ইবাদতের মাঝে নিয়োজিত রাখতেন।

গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান