Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শরীর কি তার প্রতি অঙ্গ চেনে

shamim-1

হায়রে আমার দেহের বিশেষ এক জোড়া প্রত্যঙ্গ নিয়ে ঘানা বংশোদ্ভূত শান্ত দর্শন নার্সের সে কি হাতাহাতি! এদিক করে- ওদিক করে। আমি খালি গা। একবার সে ঠান্ডা যন্ত্রে প্রায় লটকে লটকে থাকে। এক পর্যায়ে মনে হল শরীরের ও যন্ত্রের মধ্যে একটা সমঝোতা আনার কুস্তি এটা ! যে করেই হোক তার পরিপূর্ণ ছবি চাই।

chardike-ad

কিন্তু এ তো হাত কিংবা পা না যে ইচ্ছা মত দেহ থেকে বাইরে টেনে এক্সরে মেশিনের গায়ে স্থাপন করা যাবে, বা টা টা বাই বাই করা হাত বা নৃত্য পরয়ন পা হিসেবে ছবি তোলা যাবে। এর নাম স্তন। ঠিক কলিজার উপর গেঁড়ে বসা। যৌবনে সৌন্দর্য সুষমা ও ব্রীড়ার কারণ ছিল। সন্তান জন্মের পর তার অন্যজল হল। এখন মেদ মাংসে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। এখন পারলে মিনিমাইজার কিনি। এখন এ এক বিড়ম্বনা।

শুরু থেকেই তা বুকে বসা লেডী বার্ডস হলেও যখন তখন কর্কট কামড়ে হতে পারে আমার অকস্মাৎ মরণ । আর এথেকে রেহাই পাবার জন্য এই আব্রু খোলা- এই অজানা অচেনা নারীর কাছে আমার এই দেহ খানি তুলে ধরেছি। পাগলের বিষ নেই, রোগীর কোন পর্দা নেই। আর মৃতের নেই কোন মতামত।

ভ্রাম্যমান এরকম হাসাতাল এখন সারা লন্ডন ঘুরে ঘুরে স্তন ক্যান্সার এর জন্য মেমোগ্রাম করে। মেশিন কি আর মন বোঝে? কাজেই ঠেসে ধরলেও সে কিছু বলে না। তার ভেতরে জোনাক জ্বেলে ছবি তুল্লে দেখা যাবে বুকের ভেতর কোন গিট্টু আছে কিনা। কিন্তু জোরে আকর্ষন করলেই কি, তা তো আর দেহের দরোজা খুলে দূরে যেতে পারেনা। বরং স্তনের সঙ্গে পুরো বুক বাহু এমনকি দেহ ও সঙ্গে সঙগে দৌড় দেয় । কি জ্বালা! ও আমার কৃষ্ণ বরন কইন্যা বন্ধুয়ারে আমার এই দুই খন্ড মেদ নিয়া কর তোমার মনে যাহা লয়। আর ভাইরে তারপর আমাকে মুক্তি দাও। জনপ্রিয় কবি ফেরদৌস নাহার ক্যানাডা থেকে লন্ডনে এসেছে। আমি এই ঝামেলা সেরেই তাকে ফোন করতে হবে। অথবা দেখবো মোবাইলে কোন ম্যাসেজ রাখলো কিনা।

আজাদের অসুস্থতায় ধমাধম বাড়ি বদলের সময় কত কিছু হারিয়ে ফেলেছি। কি আছে জীবনে। মানুষের চেয়ে বড় মাদক আর নেই। তাই সেই মানুষকে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি পাচারেই ছিল মন। প্রথম এ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটার সাফল্যের সঙ্গে হারিয়েছি। দ্বিতীয়বারের চিঠি পেয়ে পাগলের মত এসেছি।আমার এ পরীক্ষা করাতেই হবে। আমার প্যাট্রিসিয়া ও দীপাকে হারিয়েছি,আরো কিছু প্রিয় নারীরা ঐ দুষ্ট, শয়তান, বদমাশ, গুন্ডা ব্যাধি নিয়ে লড়াই করে চলেছে হাসি মুখে। তারা এমন সব কাজ নিয়মিত করে যাচ্ছে যে সে সবারতো নমস্য হয়েছেই- আমারো তাদের দুবেলা সালাম করতে ইচ্ছে হয়।

ভালো অসুখ বলে কোন কথা নেই। তবু এই স্তন কর্কটের ভালো দিক এইযে- প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে বেঁচে যাওয়া যায়। একজন ছাড়া আমার কেউই প্রথম অবস্থায় ধরা খায় নাই। এমন কি আমার মত নিয়মিত পরীক্ষাও করায়নি। আমিও কি করতাম? ওভাবে ভয় না খেলে আমিও পুতুর পুতুর করে লৌড় দিতাম না। লজ্জা লুকিয়ে এমন একটা ভালনারেবল অবস্থায় নার্সের সঙ্গে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় গল্প করে করে নিজের বেকুব চেহারায় চালাক ভাব আনার চেষ্টা করতাম না।

কিন্তু সে কৃষ্ণা মমতাময়ী অনেক কৌশল জানে। কি ভাবে শীতল ও শক্ত সেই ক্রেন মার্কা যন্ত্রে স্ক্যান করার জন্য কিভাবে হেলে পড়তে হয়, হাত তুলে সারেন্ডার ভঙ্গিতে দাড়াতে হয় সব সব। মেটালের ওপর আমার মেদখন্ড বসিয়ে আমাকে স্থির হয়ে থাকতে বলে সে পালা করে আমার ঐ অংগ দুটোকে রঞ্জন রশ্মির জন্য একটা একটা করে ফিট করে ছবি নিতে থাক্লো। আমি শুধু মাত্র নিম্নাঙ্গের পোশাক পরা অবস্থায় গা থেকে স্তন খুলে দেবার চেষ্টা করতে থাকলাম। তার কথায় কথায় একবার হাত পিছাইতো আরেকবার ঘাড়। এক সময় সে ধাতব অন্ধকার ফুড়ে নারী-নবীর অহি নাজেল হয়, ওয়েল ডান মিসেস আজাদ, ইউ মে ড্রেস আপ নাউ।

জামা গায়ে বাইরে এসে দেখি তাজ্জব কান্ড! স্ট্রবেরী আইস্ক্রিম রঙা পাপড়িতে ঢেকে গেছে আমার বাহন রূপালী রাজহাস। চাবি ঘোরাতেই রেডিও এফ এম এ জনি ক্যাশ বাজতে থাকে যেন গয়না। আহা আহা! আর এদিকে এত পাপড়ি পড়েছে রাস্তায় যে নিজেকে রানী লাগছে। আজ আমি ফুলের ওপর দিয়ে রাজহাসে ভাসবো। আকাশের আব গায়ে মাখবো। আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।

তার আগে ফেরদৌস! ওকে পেলেই শুরু হবে আমাদের সেই মাতাল ভ্রমন! কোথায় কবি, তুমি কোথায়? কিন্তু টেলিফোন ধরলো রিন রিনে কন্ঠস্বরের অন্য এক কন্যা। আমি এত আনন্দিত যে বলি, কি নাম তোমার কন্যা – কোথায় তোমার ঘর। এত সুন্দর স্বর । মেয়েটি হেসে কুটি কুটি।
– আপা আমি রেশমী। কিন্তু তো এখন অন্য বাসায় তিনি।
– তুমি যে কি মিষ্টি।
– আপনিতো আমাকে দেখেনই নাই। আর আপনি যা অহংকারী।
– এ্যা?
– আর আ আ আমি ফেইস বুকে আপনাকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম- আপনি এ্যাক্সেপ্ট করেননি (সেই রিন রিনে হাসি) এত সহজিয়া নারী! তোমার হাসি যা সুন্দর। আমি অনেক কথা বলি তার সঙ্গে। গাড়ি স্টার্ট দেই না। বলি কেন আমি ফেইস বুকে ইন বক্সে কথা না বললে বন্ধু বানাই না। বলি সদ্য পরিচয় হওয়া সু লেখক শেগুফতা শারমিন তানিয়া এর কথা। বলি – দেখ ঠিক চলে আসবো একদিন।
– আপা, আসতে হবেনা। শুধু আমার জন্য একটু দোয়া করবেন- আমি ব্রেস্ট ক্যান্সারের পেশেন্ট। ট্রিটমেন্ট স্টপ করা হয়ে গেছে। আর আশা নেই। আমার একটি ৬ বছরের ছেলে আছে আপা।ওর বাবা?… সে অনেক কথা আপা। দ্যাখা হলে বলবো। বলে একটা শ্বাস ফেলে। কিন্তু এক মুহুর্ত মাত্র। আবার চনমন করে ওঠে। এবার আমার ফেইস বুকের ছবি দেখবেন। আমি খুব ফুলের ছবি তুলি। আর ফেরদৌস আপা আমাকেই দেখতে এসেছে… তানিয়া আপাও ফোন করেছে, দেখতে এসেছে। আপনি কবে আসবেন?

কবে! এর পর গাড়ি স্টার্ট দেই। চলতে থাকি, পাপড়ি উড়তে থাকে, কিন্তু জনি ক্যাশ নেই। সে মারা গেছে। এই এখন। আমার কাছে নেই কিছু নেই। আমি আমার বুকের দিকে তাকাই। বালির ঢিবির মত চুপ হয়ে আছে তারা। আমি কি তাদের চিনি!

আমার পুত্র সজীব এখন এক পরিপূর্ণ যুবক এখন। আমি তাকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে বড় হটে দেখেছি। আমার সজীবের ৬ বছর বয়সের কোমল মুখটা মনে পড়লো। নীল শার্ট পরে আছে। ধানমন্ডির বাসায়। স্কুল থেকে ফিরে চৌদ্দবার অকারনে মা মা করছে। সামনের দুটো দাঁত মাত্র পড়েছে। আহারে ঐ বয়সের একটি বালকের মা চলে যাচ্ছে চিরতরে। হঠাৎ আমি একদম নিস্ব হয়ে গেলাম … জারে জার হয়ে কাঁদতে থাকলাম। স্পষ্ট পৃথিবী অস্পষ্ট হয়ে এল।

• হা ঈশ্বর, মা জাতির এত প্রয়োজনীয় অঙ্গে তুমি কী করে এত বিষ দাও- কেন দাও।

(১৪ মে ২০১৩ সালের নোট। রেশমীর অকাল প্রয়াণ হয়েছে তার কমাস পর। এখন আমার আরো দু’জন কাছের মানুষ কি ভীষণ যুদ্ধ করে চলেছে! এখন প্রতি পাঁচ জনে একজন নারীর স্তন ক্যান্সার হচ্ছে। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লেই কেবল আমরা বাঁচবো। বাঁচবে আমাদের সন্তানও।)

 

শামীম আজাদঃ লন্ডন প্রবাসী কবি, লেখক, গল্পকার ও শিক্ষিকা