Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

দেশে ২১ হাজার অবৈধ বিদেশি

bidesiদেশে বৈধ-অবৈধ সব মিলিয়ে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। গোয়েন্দাদের কাছে এ তথ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের প্রায় ২১ হাজার নাগরিক বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছে বলেও তথ্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, এরা আন্তর্জাতিক অপরাধীচক্রের সঙ্গে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।

১৬টি দেশের অন্তত ৭০০ নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে গোয়েন্দাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন তৎপরতা নেই। খসড়া তালিকা থাকলেও যথাযথ নজরদারিও হচ্ছে না। অবৈধ বিদেশিরা কে কোথায় কী ধরনের কাজ করছে, সরকারকে বিপদে ফেলতে ষড়যন্ত্র ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কি না, সে তথ্যও নেই কোনো সংস্থায়। বছরের পর বছর ধরে কর্তৃপক্ষীয় ঢিলেমির সুযোগে এসব অবৈধ বিদেশি নাগরিক নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। বিদেশিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে খুনের ঘটনাও ঘটছে। ওদের কারণে কখনো কখনো আন্তর্জাতিক মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ।

chardike-ad

পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে জানা যায়, দেশে বৈধ ও অবৈধ নাগরিকের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এর মধ্যে ক্যামেরুন, ঘানা, কঙ্গো, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, সেনেগাল, সিয়েরালিওন, ইথিওপিয়া, আলজেরিয়া, লাইবেরিয়াসহ অফ্রিকা মহাদেশের ১৭ হাজার বৈধ ও অবৈধ নাগরিক দেশে অবস্থান করছে। এর মধ্যে প্রায় ৯ হাজার নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ছয় বছর ধরে এসব বিদেশি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে আর ফিরে যায়নি। এসব অবৈধ বিদেশি নাগরিককে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনায় গ্রেপ্তারও করা হয়। তবে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ নেই। ঢাকায় ওই সব দেশের দূতাবাস না থাকায় গ্রেপ্তারকৃতদের নিজ দেশে পুশব্যাকও করা যায় না।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশি নাগরিকরা অবৈধভাবে অবস্থান করে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করার পাশাপাশি অস্ত্র, স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালান, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, বিভিন্ন দেশের জাল নোট তৈরি, ডলার জালিয়াতি, এমনকি জঙ্গি তৎপরতায়ও জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, তাইওয়ান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, চীন, তানজানিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরে ঢাকা মহানগর পুলিশের অভিযানে দুই শতাধিক বিদেশি নাগরিককে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে আফ্রিকান নাগরিকের সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া কিছু পাকিস্তানি রয়েছে, যাদের সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বেশির ভাগই জঙ্গি, মাদক, জাল মুদ্রা তৈরি, প্রতারণা, হত্যা ও মানবপাচারে জড়িত। ছাত্র, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড় ছাড়াও পোশাকশিল্প, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, আইটি ও টেলিকম সেক্টর, রেস্টুরেন্ট এবং এনজিওসহ নানা প্রতিষ্ঠানের ঢাল ব্যবহার করে তারা অপরাধ করে থাকে। এরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে রয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধ বিদেশিরা দেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর। বিদেশি নাগরিক কখন-কিভাবে ও কী উদ্দেশ্যে এ দেশে ঢুকছে তার সঠিক তথ্য নেই সরকারি কোনো সংস্থার কাছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই অবৈধভাবে বসবাসের সুযোগ নেই। অথচ বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসের পাশাপাশি বিদেশিরা অপরাধ কর্মকাণ্ডও চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিদেশিদের ওপর কড়া নজরদারি থাকলেও বাংলাদেশে সরকারিভাবে খুব বেশি এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কখনোই। শুধু ঘটনাক্রমে দু-চারজন গ্রেপ্তার হলেই চলে তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, এ বিষয়টি সাধারণত সরকারের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ দেখে থাকে। অবৈধ বিদেশি দেশে কত আছে আমার জানা নেই, তবে যদি থাকে তাদের ধরতে ‘ড্রাইভ’ দিতে হবে। ফরেন অ্যাক্টের ধারায় তাদের গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। তবে নিরপরাধ বিদেশিদের আইনগত সহযোগিতা দেওয়া উচিত। তারাও দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে শতাধিক অফ্রিকানসহ বিভিন্ন দেশের দুই শতাধিক নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকরা সরকারকে কোনো রকম ভ্যাট বা কর দেয় না। অথচ সাধারণ নাগরিকের চেয়েও তারা বেশি সুবিধা ভোগ করছে। তারা অবৈধভাবে উপার্জন করে তা নিজ দেশে পাঠাচ্ছে। এসব তথ্য উল্লেখ করে এনবিআর বেশ কয়েকবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। অন্যদিকে পাঁচ শতাধিক বিদেশি নাগরিক নানা অপরাধমূলক কাজে অংশ নিচ্ছে- এমন তথ্য পেয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে সরকারকে প্রতিবেদন দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশিদের মধ্যে বেশির ভাগ পর্যটন ভিসায় বাংলাদেশে এসে কখনো নিজের পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে, আবার কখনো ভিসার মেয়াদ থাকা অবস্থাতেই নানা ‘অপতৎপরতা’ চালায়। পাসপোর্ট না থাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আটকের পর তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তৈরি হয় জটিলতা। এ সুযোগে বারবার তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মূলত গুলশান, বনানী, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোকে বিদেশিরা নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারী পরিচয়ে অভিজাত হোটেলে উঠে বিদেশে লোক পাঠানো, বাংলাদেশে নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার আশ্বাস ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তারা প্রতারণা করছে। অভিজাত এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার দায়ে এর আগে বেশ কিছু বিদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, অবৈধ বিদেশির সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। গত বছর গোয়েন্দারা তদন্তে জানতে পারেন, দেশে ১৯ হাজার অবৈধ বিদেশি অবস্থান করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এ বছর নতুন করে আরো দুই হাজার বিদেশি অবৈধভাবে দেশে অবস্থান করে একইভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।

সূত্র মতে, বিদেশি নাগরিকের আর্থিক লেনদেন ও জঙ্গি অর্থায়নের বিষয় সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য বেশ আগেই অর্থ মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ টিম গঠন করেছিল। বাংলাদেশে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া অবস্থান করা বিদেশি নাগরিকের কার্যক্রম, তাদের ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার বিষয় নিয়ে কাজ করছিল ওই টিম। অনুসন্ধানে তারা ধারণা পায়, বাংলাদেশে অবস্থানকারী প্রায় ১৩ হাজার বিদেশির ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাদের বেশির ভাগই এসেছিল ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে। ইমিগ্রেশন-সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা এ পরিসংখ্যান সমর্থন করে জানান, এ সংখ্যা আরো কয়েক হাজার বেশি হবে।

এর আগে রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরে এক অবৈধ আলজেরীয় নাগরিকের হাতে মর্মান্তিকভাবে খুন হয় ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ (১৭)। ওই ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রামপুরা, বনশ্রী, গুলশান ও উত্তরায় বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকের বাসা শনাক্ত করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ৪০টি টিম একযোগে এসব এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক বিদেশি নাগরিককে আটক করে তাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করে। বেশির ভাগের কাগজপত্রে গলদ পাওয়া যায়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের নাগরিকরা বেশ কয়েক বছর ধরে অনবরতই অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকছে। তাদের একটি বড় অংশ মাদক, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশিদের তালিকা নিয়ে শিগগিরই গ্রেপ্তার অভিযানে নামবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশ মোতাবেক সরকারের নির্দেশনা পেলেই শুরু হবে যৌথ অভিযান। যেসব দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ঢাকায় তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বিষয় নিয়েও পর্যালোচনা চলছে। সব মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ বিদেশি নাগরিকের বিষয়টি নতুন করে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।(কালেরকণ্ঠ)