Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লী

sonagasiপৃথিবীর হাতে গোনা দু’একটি দেশ ছাড়া প্রত্যেকটি দেশেই রয়েছে যৌনপল্লী। এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লীটি অবস্থিত ভারতের একসময়কার রাজধানী কলাকাতায়। শহরটির চারশ’ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে সোনাগাছি নামে এই যৌনপল্লীর নাম। শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্যের আনাচে কাঁনাচে বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে ঐতিহাসিক (!) এই জায়গাটির নাম।

ব্রিটিশ সরকারের আমলেই মূলত সোনাগাছি বৃহৎ রূপ পায়। এরপর স্বাধীন ভারতে ক্রমশ এই এলাকা বিস্তৃত হতে থাকে। যে কারণে একটা সময় পুরো অঞ্চলটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রেডলাইট জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

chardike-ad

এখানে যৌনপেশায় দীর্ঘদিন ধরে আছেন ৩৯ বছর বয়সী গীতা দাস। নিজেকে তিনি এখন আর এই এলাকার বাইরের কেউ ভাবতে পারেন না। উল্টো তিনি বলেন, ‘আমি একজন যৌনকর্মী। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং বৈমানিকদের মতো আমার পেশা হলো যৌন তৃপ্তি দেয়া।’ গীতার যখন ১৬ বছরের কিশোরী, তখন প্রথমবারের মতো তিনি এই অঞ্চলে আসেন এবং এরপর থেকে তার ভাগ্য এখানেই বাঁধা পড়ে যায়। সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে সোনাগাছিতে প্রায় সাত হাজার যৌনকর্মী রয়েছে, যাদের বাড়ি ভারত ও পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

গীতার যখন মাত্র ১২ বছর বয়স তখন ৩৭ বছর বয়সী এক মধ্যবয়সী পুরুষের সঙ্গে তাকে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু স্বামীর হাতে নিদারুণ নির্যাতনের শিকার হয়ে দুই সন্তানের হাত ধরে অল্প বয়সেই বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে হয় তাকে। কিন্তু বাপের বাড়ির আর্থিক অস্বচ্ছলতা তাকে ঠেলে দেয় কলকাতার দিকে, জীবিকার সন্ধানে। কলকাতায় কিছুদিন কষ্ট করার পর এক বন্ধু তাকে নিয়ে আসেন সোনাগাছিতে।

‘এখানে আসার ফলে আমার জীবন নিরাপদ ও নিশ্চিত হয়। আমার দুই সন্তানই এখন তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করেছে এবং তারা কাজ করছে। আমি যদি বাড়িতে থাকতাম তাহলে কি তাদের পড়ালেখার খরচ যোগাতে পারতাম? সমাজের উচিত আমাদের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে তাদের নিজেদের দিকে তাকানো। কেউ কি আমাদের চাকরি দিয়েছিল?’

সোনাগাছিতে অধিকাংশ যৌনকর্মীই তাদের পরিচয় হিসেবে ভিন্ন নাম ব্যবহার করে পিতা-মাতার দেয়া নামের পরিবর্তে। কারণ তারা নিজেরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের পরিবার তো আর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। তাই তাদের কারণে সমাজে যেন তাদের পরিবার হেন প্রতিপন্ন না হয় সেজন্যই তারা ভিন্ন নাম ব্যবহার করেন।

যদিও এমন অনেকেই আছেন যারা জীবিকার জন্য নয়, শুধুমাত্র যৌনতৃপ্তির জন্যই এই পেশা বেছে নেন। এরকমই একজন নারী বলেন, ‘বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে যৌনতা আমার কাছে অনেক উত্তেজনাকর। ওরা আমাকে ভাসমান যৌনকর্মী বলে কারণে আমি কাজ শেষে বাসায় চলে যাই, সোনাগাছিতে থাকি না। আমার একমাত্র ভয় হলো আমার সন্তান যদি কখনও আমার কাজ সম্পর্কে জেনে যায়। আমার এক বন্ধুর সন্তান তার মায়ের এই কাজ সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল। আর এটাই আমার অনেক ভয়ের কারণে। আমি দুটো জীবন যাপন করি এবং এটা আমাকে করতেই হবে।’

তবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর জানা যায় আসল কারণ। তিনিও মূলত তার রোগাক্রান্ত বাবা-মার চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর জন্যই এই কাজ করেন। ‘এই কাজ আমাকে অর্থ এবং আনন্দ দুটোই দেয়। পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীতে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। যতদিন পর্যন্ত খদ্দেররা আমাকে চাইবে ততদিন আমি এই কাজ চালিয়ে যাবো।’

এই পেশায় যারা বয়স্ক হয়ে যায় তাদের অধিকাংশেরই আর সোনাগাছিতে জায়গা হয় না। তাদেরই একজন ৫৫ বছর বয়সী পূর্ণিমা চ্যাটার্জি। পূর্ণিমার জন্ম হয়েছিল একটি বৃহৎ পরিবারে এবং তার নিজ বাবার হাত ধরেই তার পেশায় প্রবেশ। তিনি বলেন, ‘আমি কারো স্ত্রী হতে পারতাম, কারো পুত্রবধূ হতে পারতাম। কিন্তু তারপরেও আমি আমার বাবাকে দোষারোপ করি না। এটা আমার ভাগ্য। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল এভাবেই আমাকে আমার পাঁচ সন্তান ও বাবা-মার দেখাশুনা করতে হবে। আমি শুধু ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু এখন আমার কেউ নেই, অর্থ উপার্জনেরও সক্ষমতা নেই আর। আর কয়েক বছর পরে আমার ভাগ্যে কি ঘটবে আমি জানি না।’

ভারতে যৌনপেশা বৈধতা না পেলেও সোনাগাছি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই সরকারের। কলকাতার সরকার এই মানুষগুলোর জীবন এবং তাদের জীবিকাকে নীরবে সমর্থন দিয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের কোনো সরকারই সোনাগাছিকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেনি। হয়তোবা এটা কতকটা সংস্কৃতিগত কারণে, কতকটা রাজনৈতিক কারণে। কারণ পশ্চিমবঙ্গে অনেক বছর কমিউনিস্ট শাসন থাকার পরেও যেহেতু সোনাগাছির মতো স্বীকৃত যৌনপল্লীর কিছু হয়নি, তাই এর শেকড় আসলেই যে অনেক গভীরে পুতে রাখা আছে সেটা অকপটে স্বীকার করতেই হয়।