Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ওয়াজ-নসিহতও নজরদারিতে!

masud-mojumdarবাউল ও লোকশিল্পী শাহ আবদুল করিমের সাথে এ জাতিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কিংবদন্তিতুল্য লেখক মরহুম হুমায়ূন আহমেদ। ‘এক দিন কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’; ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’সহ অনেক কালজয়ী লোকগান হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তার লেখায় ও নাটকে ব্যবহার করেছেন। সত্যিই এই তল্লাটের মানুষ একসময় সুন্দর দিন কাটাত। ‘গ্রামের হিন্দু-মুসলমান’ মিলেমিশে বসবাস করত। পূজা-পার্বণ যেমন নির্বিঘ্নে হতো, তেমনি কবিগান, জারি, সারি, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালির কমতি হতো না। মুর্শিদি ও গজলের আসর বসত নিয়মিত। সোনাভান আর গাজিকালু চম্পাবতির পুঁথি পাঠের সাথে একসময় ‘বিশ্বনবী’ ও ‘বিষাদসিন্ধু’ শোনার জন্য লোকসমাগম হতো প্রচুর। গ্রামগঞ্জে ওয়াজ মাহফিল হতো নিয়মিত। পুরো শীত মওসুমজুড়ে যাত্রাপালা যেমন হতো, তেমনি ওয়াজ মাহফিলের জোয়ার বইত। ওয়াজ মানেই শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম ইসলামের দাওয়াত। জনগণ ইসলাম সম্পর্কে যা জানে ও মানে তা ওয়াজ-নসিহত থেকেই শোনা। নয়তো পীর-আউলিয়ার মাধ্যমে পাওয়া। নতুন ধানের ম-ম গন্ধ আর পিঠা-পায়েসের সাথে শীতকালজুড়ে ওয়াজ-নসিহতের নৈতিক চাষ আবহমান বাংলার অতি চেনা পরিচয়।

এখন অন্য সব হয়, ওয়াজ হয় না। অভিযোগ, ওয়াজ মাহফিল করতে দেয়া হয় না। এর মাধ্যমে মৌলবাদ ছড়ায়, জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে- এমন উদ্ভট ও জাতিঘাতী বক্তব্য শুনতে পাই। এ ধরনের অনুযোগ ও অভিযোগ কতটা সত্য, তা সাদা মনে বিশ্বাস করা কঠিন। তবে ওয়াজ-নছিহতের সাথে চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের সংশ্রব কখনো দেখিনি। এখন অলি আল্লাহর বাংলাদেশ, শহীদ গাজীর বাংলাদেশে মসজিদে খুতবা পাঠ এবং ওয়াজ মাহফিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও তোলা হয়। আগের মতো গ্রামে গ্রামে কুরআনি মক্তব বসে না। মসজিদ ও লাগোয়া মক্তবগুলোসহ গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাদরাসা-মক্তবগুলোর বেহাল দশা। কওমি মাদরাসাগুলো কার্যত ধর্মীয় নেতৃত্বের অভাব ঘুচায়। এখন কওমি মাদরাসাগুলোকে দরবারি ও তথাকথিত কবরপূজারীদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ উঠেছে।

chardike-ad

মসজিদের ইমামরাও নাকি নজরদারিতে। কারা যেন কথা ছড়ায়- মাদরাসাগুলো জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র। বাংলাদেশের সবচেয়ে অসংবদ্ধ কিন্তু সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য প্রভাবকশ্রেণী হচ্ছেন আলেম-ওলামা, ইমাম-মুয়াজ্জিনরা। তাদের ওপরও নাকি কারা নজর দারি করে। ইমাম-খতিব খুতবায় কী বলবেন, কী বলবেন না তাও নাকি মসজিদ কমিটি শিখিয়ে-পড়িয়ে দিচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসনের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে বলা হচ্ছে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা যাবে না। অথচ মসজিদ, মক্তব, মাদরাসা কখনো রাজনীতির জন্য ব্যবহৃত হয় না। কখনো হতো না, এখনো হয় না। ঈমান, আমল ও ফজিলত নিয়েই মসজিদ-মাদরাসায় কথা হয়- যা সওয়াব পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। হাকিকতের কথা তারা প্রায়ই এড়িয়ে যান।

আলেম-ওলামারা অভিযোগ তুলছেন, এখন যেভাবে তৃণমূল পর্যন্ত ডিইসলামাইজেশনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে, সন্দেহ হয়- একসময় সন্তান জন্মের পর কানে আজান দেয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব তোলা হবে। মুসলমান নাম রাখার ওপর কর আরোপ করা হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ইংরেজ ও হিন্দু জমিদারেরা একসময় দাড়ি রাখার ওপর কর বসিয়েছিল। বাংলায় প্রজা আন্দোলনের নেতা তিতুমীর সেই অপকর্ম রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ, মুন্সী মেহেরুল্লাহ্, ইসলমাইল হোসেন শিরাজী, মাওলানা ইসলামাবাদী, হজরত শামসুল হক ফরিদপুরী, হাফেজ্জী হুজুর, শায়খুল হাদিসসহ অসংখ্য আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ বাংলার জমিনকে নৈতিক শিক্ষা ও দ্বীনের জন্য আবাদ করেছেন।

স্বাধীনতার পর অতিবাম ও ধর্মবিদ্বেষী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী কিছু মানুষ মাদরাসা-মক্তব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। মুক্তচিন্তার মানুষ আবুল ফজল, সৈয়দ আলী আহসান, মাওলানা তর্কবাগীশসহ অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে এর ভয়াবহ পরিণাম স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হতে দেননি। বরং ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। ওআইসির সদস্য হয়ে নিজেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের স্থপতির মর্যাদায় উন্নীত করার এক কালজয়ী ঘোষণা দিয়েছিলেন।

সবার জেনে রাখা ভালো, ওয়াজ মাহফিলে কী বলা হয়, সাধারণত বিবি তালাকের মাসয়ালা থেকে শুরু করে অজু-গোসল, পাঞ্জেগানা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান, সদকা, বেহেশত-দোজখ, হালাল-হারাম, সওয়াব-গুনাহ, বেহেশতের বর্ণনা, দোজখের আজাবের ভীতিকর মাসয়ালা-মাসায়েল বর্ণনা করা হয়। নবী-রাসূলের জীবন আর সাহাবা চরিত দিয়ে শ্রোতাদের উজ্জীবিত করা হয়। এতে না থাকে সরকার প্রসঙ্গ, না থাকে রাজনীতির সংশ্রব। দুনিয়ার চেয়ে আখেরাতের বর্ণনা দিয়ে বয়ান হয় বেশি। এতে নজরদারি বাড়াবাড়ি কি না, ভেবে দেখা দরকার। কারণ, তারা সরকার পাল্টানোর কথা ভাবেন না। এ ধরনের কোনো কর্মসূচিও তাদের কখনো ছিল না। এখনো নজরে পড়ে না। উত্ত্যক্ত না করলে, উসকানি না দিলে তারা নীরবে জুলুমও সহ্য করেন। বাধ্য হলে প্রতিবাদ জানান। সেটাও নিয়ম ভেঙে নয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্টির সময় বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ধর্মের ব্যাপারে অসংখ্য প্রতিশ্রুতি আছে; বাড়াবাড়িমূলক কোনো উক্তি নেই। বরং ইসলামের নামে পাকিস্তানি শাসকদের ভণ্ডামিকে তিনিও চিহ্নিত করেছেন। ৭ মার্চের কালোত্তীর্ণ ভাষণটি শেষ হয়েছে ইনশাআল্লাহ দিয়ে। ছয় দফায় কার্যত ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো স্পর্শ নেই। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় ধর্মবিদ্বেষের কোনো ঠাঁই নেই। আজ ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ ঠেকানোর নামে এই দেশের মানুষের চিরায়ত ধর্মবিশ্বাস ও চর্চাকে কটাক্ষ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের মুখোমুখি ও সাংঘর্ষিকভাবে উপস্থাপনের ধৃষ্টতা দেখতে পাই। অথচ আওয়ামী লীগের কাগজপত্রে অনূদিত হলেও বিসমিল্লাহ ও আল্লাহর নাম রয়েছে। রাষ্ট্রধর্মের ধারণা উপড়ে ফেলা হয়নি। তাহলে কারা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মচর্চায় আদি ও অকৃত্রিম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে উদ্যত? কারা আমাদের জাতিসত্তার মৌলিক পরিচয় মুছে ফেলতে মরিয়া? আওয়ামী লীগ সরকার ও এর নেতৃত্ব এ দিকটায় অবহেলা করলে জাতির কী ক্ষতি হবে ভবিষ্যৎই বলবে, তবে নগদ ক্ষতির মধ্যে পড়বে আওয়ামী লীগই। কারণ আওয়ামী লীগ ধর্মভীরু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসী। ধর্মবিদ্বেষী নয়, ধর্মহীনও নয়।

আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা একটি প্রতিবাদী দল। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে এই দলের চিন্তক ভাবা হয়। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। টাঙ্গাইলের বনেদি নেতা শামসুল হক প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু দলটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এটিকে কার্যকর রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করে স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল সংগঠনের স্তরে উন্নীত করেন। শেখ হাসিনা এখন দলটির কাণ্ডারি। কথিত আছে, শেখ পরিবার ইসলামের দাওয়াত দিতে এই দেশে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক, প্রথমে মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নেতা। পরে পূর্ববাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হন। এতে তিনি কোনো সাংঘর্ষিকতা পাননি। তা ছাড়া তিনি ছিলেন ধর্মভীরু মানুষ। টুপি-তসবিহ জায়নামাজ তার শোয়ার ঘরেই থাকত। শেখ হাসিনা নিজেও ধার্মিক মানুষ। জানি না আজ ধর্মপন্থী কোনো বিশেষ দল ঠেকানোর নামে এ দেশের মানুষের ধর্মচর্চা, ওয়াজ মাহফিল ও মসজিদ-মক্তব-মাদরাসাগুলোকে কেন এতটা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠেছে। মাদরাসাগুলো এ দেশের মানুষের দান, সদকা, জাকাত-ফিতরা ও মুষ্টিচালের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। মাদরাসাগুলো গণশিক্ষার হার বাড়াচ্ছে। নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটাচ্ছে। অনৈতিকতার সয়লাব ও অনাচার ঠেকাচ্ছে। ধর্মীয় নেতৃত্বের অভাব ঘুচাচ্ছে। এই দেশে যতবার ধর্মের নামে চরমপন্থা উত্থানের আলামত দেখা দিয়েছে, ততবারই সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, ইমাম-মুয়াজ্জিনরাই রুখে দিয়েছেন। জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা ওবায়দুল হকের চরমপন্থাবিরোধী জুমার খুৎবা কি কারো মনে পড়ে না!

দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবশ্যই উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটাচ্ছে। সাথে রাজনৈতিক টাউট, শিক্ষিত ডাকাত, ঘুষখোর ও অসংখ্য পদলেহী চাকরেরও জন্ম দিচ্ছে। তাই বলে কি আমরা সেগুলো বন্ধ করার কথা ভাবছি? মাদরাসায় পড়ে দু-চারজন চরমপন্থী বিভিন্ন নামে বাড়াবাড়ি করলে তাদের জন্য ব্যবস্থা নেয়া এক কথা; ইসলামি শিক্ষা ও আলেম-ওলামার নির্বিরোধ জীবন ভিন্ন কথা! কাদের কাছে এরা এতটা অসহ্য? কেন? তারা কি আমাদের চিরায়ত ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচার থেকে ইসলামকে নির্বাসনে দিতে চান? এ দেশের মানুষ কোনো বিশেষ ধর্মভিত্তিক দলকে ইসলামের সোল এজেন্সি দেয়নি। তেমনি কোনো দলকে মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মচর্চাকে উপড়ে ফেলার ম্যান্ডেটও দেয়নি। সরকারকেই ভেবে দেখতে হবে- কারা, কেন সরকারের আনুকূল্য নিয়ে দেশ ও জাতির শেকড় কাটছে। স্বাধীনতার অন্যতম রূপকার আবুল মনসুর আহমদ জীবিত থাকলে একাই এই শেকড় কাটা ভুঁইফোড়দের মুখোশ উন্মোচন করে দিতেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের রূপময়তা তুলে ধরতে কার্পণ্য করতেন না। আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে বাঙালি মুসলমানের মন নিয়ে দ্বিতীয় কিস্তি লিখে সবাইকে অবাক করে দিতেন। আর আমরা শুধু অবাক হয়ে দেখছি। বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে অজানা ভবিষ্যতের দাসখতের পাতা উল্টাচ্ছি।

লিখেছেনঃ মাসুদ মজুমদার, email:masud2151@gmail.com (এই লেখার সকল দায়-দায়িত্ব লেখকের নিজের)