Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

তোলপাড় বেশি ফিলিপাইনে

hackingবাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্তে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসায় তোলপাড় চলছে ফিলিপাইনে। বাংলাদেশের চেয়েও বেশি নড়েচড়ে বসেছে সে দেশের প্রশাসন। প্রমাণ পাওয়া গেছে সেখানকার রিজাল ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতো নিজেই ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করে তারই গাড়িতে করে নিয়ে যান ২০ মিলিয়ন পেসো (স্থানীয় মুদ্রা), যা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাক করে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছিল। আরও জানা গেছে, পুরো ঘটনাটি ঘটেছে রিজাল ব্যাংকের সিইও লরেন্স ট্যানের নির্দেশেই। যে চারটি অ্যাকাউন্টে রিজার্ভ পাচার হয়েছিল তারা ছিলেন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহীর ট্যানের পরিচিত। শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতো নিজেই সিনেট শুনানিতে এ দাবি করেছেন।

এদিকে ঘটনার প্রায় দেড় মাস পরে বাংলাদেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরই। দেশটির অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষ (এএমএলসি), সর্বোচ্চ আইন প্রণয়ন সংস্থা সিনেট ব্লু রিবন কমিটি, বিচার বিভাগ বিস্তারিত তদন্ত করছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) শীর্ষ   কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে। ফিলিপাইনের সিনেট ব্লু রিবন কমিটি তিন দফা শুনানি করেছে, বিচার বিভাগ মামলা দায়ের করে সমনও জারি করেছে।

chardike-ad

এই জালিয়াতির ঘটনায় দেশটির আরসিবিসি সংশ্লিষ্টতার কারণে আন্তর্জাতিক চাপেও রয়েছে। গতকাল সিনেট শুনানিতে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার ব্রাঞ্চের অভিযুক্ত ম্যানেজার মাইয়া সান্তো দিগুইতোর সহকর্মী ও ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী একই শাখার কাস্টমার সার্ভিস প্রধান রোমাল্ডো অগার্ডো জানান, দিগুইতোর গাড়িতে তিনি ২০ মিলিয়ন পেসো (ফিলিপাইনের মুদ্রা) দেখতে পেয়েছেন। ওই অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে সাইবার ডাকাতির মাধ্যমে পাচার হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের অংশ। অগার্ডো বলেন, চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি কাগজের প্যাকেটে ভরা ২০ মিলিয়ন পেসো দিগুইতোর গাড়িতে রাখতে দেখেছিলেন। ওই অর্থ ব্যবসায়ী উইলিয়াম গো-র অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা হয়েছিল। ওইদিন বিকালে জুপিটার ব্রাঞ্চের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার অ্যাঞ্জেলা তোরেস ২০ মিলিয়ন পেসো বের করে রাখতে ক্যাশ কাউন্টারে অনুরোধ করেছিলেন। তারপর বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে সশস্ত্র গাড়িটি আসে, ক্যাশ সেন্টার থেকে অনুরোধ করা ২০ মিলিয়ন পেসো আমরা আগে থেকেই গুনে রেখেছিলাম। সিনেট শুনানিতে একের পর এক এ ধরনের তথ্যে নড়েচড়ে বসেছে দেশটির সর্বোচ্চ আইন প্রণয়ন সংস্থা সংসদ। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা হ্যাক হয়ে ফিলিপাইনের ব্যাংকিং সিস্টেম বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। পুরো প্রশাসন থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, সাধারণ মানুষের সমালোচনার মুখে পড়ে ব্যাংকিং সিস্টেম।

দেশটির গণমাধ্যমেও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ফিলিপাইনের প্রথম সারির সবকটি প্রত্রিকা এ বিষয়কে প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে কাভারেজ দিচ্ছে। জানা গেছে, ব্যাংকিং সিস্টেমের মধ্যেই এমন জালিয়াতি হওয়ার আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছে দেশটির বৈদেশিক ব্যাংক লেনদেন। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে ফিলিপাইনের সঙ্গে।

ফিলিপাইনের আর্থিক খাতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় জালিয়াতির ঘটনা হিসেবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দেশটির সর্বোচ্চ আইন প্রণয়ন সংস্থা সংসদের উচ্চ কক্ষ সিনেট ব্লু রিবন কমিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব কর্তৃপক্ষকে ডেকে শুনানি করেন। শুনানিতে উঠে আসে জালিয়াতির ভয়াবহ চিত্র। তাদের শুনানিতে ডাকা হয়, আরসিবিসির চেয়ারম্যান হেলেন ওয়াই ডি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক লরেন্স ট্যান, জুপিটার স্ট্রিট শাখা ব্যবস্থাপক মাইয়া সান্তোস দিগুইতো, রেমিট্যান্স লেনদেন কোম্পানি ফিলরিমের প্রেসিডেন্ট স্লুড বাতিস্তা, পাচারের ব্যবহূত অ্যাকাউন্ট হোল্ডার ব্যবসায়ী উইলিয়াম সো গোকে। সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান সার্জিও ওসমিনা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান তাদের ওপর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে এক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর কীভাবে নজরদারি করে এই টাকা চুরি করা হয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য। কীভাবে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়েছে হংকংয়ে। আরসিবিসি সরাসরি এই ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয় উঠে আসায় প্রশাসন তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক লরেন্স ট্যানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতো জাপানে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তার বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। সঙ্গে সঙ্গে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন এএমএলসি তদন্ত কমিটি গঠন করে হ্যাক হওয়ার পর থেকে পুরো লেনদেন কার্যক্রমের বিষয়টি তুলে ধরে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। দেশটির বিচার বিভাগও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে মামলা দায়ের করেছেন।

গত ১৫ মার্চ বিচার বিভাগ মামলা দায়ের করে আগামী ১৯ এপ্রিল শুনানিতে ডেকেছেন ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে হংকংয়ে পাচার করা রেমিট্যান্স কোম্পানি ফিলরিম, দুই ক্যাসিনোর কার্যক্রম। সিনেট কমিটির জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে, আরসিবিসির জুপিটার শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতোর নির্দেশেই হংকংয়ে টাকা পাচার করা হয়। সিনেট কমিটির সামনে সাক্ষ্য দেয় আরসিবিসির জুপিটার স্ট্রিট শাখার কর্মকর্তা রমুআলদো আগারাদো। তিনি সিনেট কমিটিকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরসিবির ওই শাখায় সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে। ওইদিন বিকাল সাড়ে ৫টায় তার (দিগুইতো) নিজের গাড়িতে করে ২০ মিলিয়ন পেসো নিয়ে যান। এই টাকা ট্রান্সফারের জন্য দিগুইতো দেশটির ইস্টওয়েস্ট ব্যাংককে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন বলেও সাক্ষ্য দেন অ্যালান পেনালোসা। বনিফিসিও গ্লোবাল সিটির শাখা ব্যবস্থাপককে তিনি অনুরোধ করলে তারা অস্বীকার করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চারটি অ্যাকাউন্টে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ৮১ মিলিয়ন ডলার জমা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি। ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ওই অ্যাকাউন্ট জব্দ করার অনুরোধ পাঠায় বিকাল ৫টায়। ওইদিন ব্যাংক ছুটি থাকায় কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি শাখা ব্যবস্থাপক ওই অনুরোধ পাওয়ার পরেও তিনি চার অ্যাকাউন্টের অর্থ পরিশোধ করে দেন। ওই চার অ্যাকাউন্টে পরিশোধ হয় ক্রিস্টোফার লাগরোসাস ৩০ মিলিয়ন, আলফ্রেড ভারগারা ১৯.৯৯ মিলিয়ন, এনরিকো ভাসকুয়েজ ২৫ মিলিয়ন ও মাইকেল ক্রুজের ৬ মিলিয়ন ডলার। যা দুটি ক্যাসিনোতে চলে যায়। এই চারজনের অ্যাকাউন্ট খুলতে যে তথ্য জমা দেওয়া হয়েছিল সেটা পুরোপুরি ভুয়া। এর মধ্যে লাগরোসাসের আলাদা ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট করে সেখানে ২২ মিলিয়ন ডলার জমা করেন এবং গার্মেন্ট ব্যবসায়ী উইলিয়াম সোগো নামে একজনের অ্যাকাউন্টে দুটি অর্ডারের মাধ্যমে ১৪.৭ মিলিয়ন ডলার জমা হয়। সোগোর অ্যাকাউন্ট থেকে যে চেকের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা হয় সেখানে গ্রাহকের স্বাক্ষর ছিল ভুয়া। এখান থেকে কিম অং নামে হংকংয়ে এক ব্যক্তির কাছে চলে যায় বড় অংশ। এখানেই ৬৮ হাজার ডলার জমা রয়ে যায়। পরে ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই অনুরোধ পরিপালন করে অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়। লেনদেনের পরেও ওই ৬৮ হাজার ডলার জব্দ করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শাখা ব্যবস্থাপক ওই অ্যাকাউন্টগুলোতে হ্যাক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা নিয়ে আসা হয়েছে শুরু থেকেই জানতেন। জানার পরেও ডলার জমা হলে তড়িঘড়ি করে তা ট্রান্সফার করা হয়। ক্যাসিনোর কর্মকর্তা উইক্যাং জু চীনের নাগরিক। তার মাধ্যমে এই অর্থ হংকংয়ে কিম অং নামের এক ব্যক্তিকে পাঠানো হয়। উইক্যাং জু বর্তমানে সিঙ্গাপুরে রয়েছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সব অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের গ্রেফতার করতে হন্যে হয়ে খুঁজছে দেশটির পুলিশ। বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে নেওয়া।