Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যুগে যুগে ইহুদি জাতি

ehudiইহুদি জাতি তাদের আসমানি কিতাবগুলোতে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিবরণ পেয়ে তারা তাঁর আগমনের অপেক্ষায় থাকত। তারা আশা করত, শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.) এলে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলে তাদের দুর্গতি দূর হবে এবং তারা জালেমের অত্যাচার ও অনিষ্টতা থেকে মুক্তি পাবে। তাদের ধারণা ছিল, শেষ নবী ইহুদিদের গোত্র থেকে প্রেরিত হবেন। কিন্তু যখন তারা দেখল যে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন, তখনই তাদের মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। এই ক্রোধে তারা তাঁকে মেনে নিতে পারল না। সে থেকেই এই ইহুদি জাতি শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং শুরু করে দেয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র। (দেখুন : সুরা বাকারা, আয়াত : ৮৯)

মক্কার কাফিরদের অনিষ্টতার কারণে আল্লাহর হুকুমে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। মদিনার অনুকূল পরিবেশে ইসলাম প্রতিকূল ও প্রতিপক্ষ শক্তির মোকাবিলায় ক্রমান্বয়ে প্রবল শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়। মুসলমানদের শক্তি সঞ্চয়কে মদিনার প্রতিক্রিয়াশীল ইহুদিগোষ্ঠী সহজে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মক্কার তুলনায় এখানে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি হওয়ায় তারা সরাসরি চ্যালেঞ্জ ঘোষণায় সাহসী হয়নি। তাই তারা ভিন্নপথে অগ্রসর হয়। গোপন ষড়যন্ত্রই ছিল মদিনার ওই সব ইহুদির একমাত্র হাতিয়ার। মুনাফিকি আর গাদ্দারিই ছিল তাদের অবলম্বন।

chardike-ad

তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণে একদিকে মদিনার মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের সঙ্গে হাত মেলায়, অপর দিকে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রকাশ্য দুশমন মক্কার কুরাইশ কাফিরদের সঙ্গে হাত মেলায় এবং মদিনা আক্রমণ করে মুসলমানদের সমূলে উত্খাত করতে তাদের প্ররোচিত করে। তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানেরও আশ্বাস দেয়।

রাসুল (সা.) মদিনা আগমনের পরপরই স্থানীয়-অস্থানীয় সব গোত্রের সঙ্গে পারস্পরিক সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন। মদিনার ইহুদিরাও ছিল এ সন্ধিচুক্তির অন্যতম শরিক। সন্ধিচুক্তি অনুসারে ইসলাম ও মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে কোনো অন্তর্ঘাত ও নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হওয়া কিংবা ইসলামবৈরী কোনো শক্তির সঙ্গে কোনোরূপ যোগাযোগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল এবং তা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথম দিকে কিছুদিন তারা শান্ত ও নিরপেক্ষ জীবন যাপন করলেও অল্প দিনের ভেতর তাদের মুখোশ খসে পড়ে এবং তাদের চিরাচরিত অন্তর্ঘাত ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক রূপ ফুটে ওঠে। তারা একদিকে মদিনার মুনাফিকদের সঙ্গে হাত মেলায়, অপর দিকে মক্কার কাফির কুরাইশদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আর রাসুল (সা.) এমন ধরনের আশঙ্কা করেননি। কারণ আকিদাগত দিক দিয়ে অর্থাৎ তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতনির্ভর বিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলমানরা ছিল ইহুদিদের নিকটতর। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/৫১৯) এর পেছনে ইহুদিদের জাতিগত বিদ্বেষ, সংকীর্ণচিত্ততা, জাতিবিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী তাদের বাতিল ও ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস, জঘন্য চরিত্র ও নিকৃষ্টতম স্বভাব। কোরআনুল কারিমের বিভিন্ন স্থানে যা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।

নবীদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হওয়া, তাঁদের দাওয়াত ও পয়গামের মোকাবিলা করা, এমনকি নবীদের হত্যা করার মতো দুঃসাহসিক ধৃষ্টতা প্রদর্শন, হিংসা ও বিদ্রোহ, আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ, সীমাহীন অর্থলোলুপ মনোবৃত্তি, শোষণের হাতিয়ার নিষিদ্ধ সুদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ ও প্রীতি, অবৈধ সম্পত্তি অর্জন, জাগতিক স্বার্থে আসমানি গ্রন্থের বিকৃতি সাধন ও জীবনের প্রতি অসীম মায়া এবং মমত্ববোধ তাদের বংশগত ও জাতীয় বৈশিষ্ট্য। রাসুল (সা.) তাঁর দাওয়াত ও তাবলিগের বিভিন্ন পর্যায়ে ইহুদিদের এ জাতীয় চরিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন করলে তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সন্ধির শর্ত লঙ্ঘনপূর্বক প্রকাশ্য ও গোপনে শত্রুতায় আত্মনিয়োগ করে।   একবার নবী করিম (সা.) কোনো এক কাজে বনু নাজির পল্লীতে গেলে সেখানে তারা ওপর থেকে পাথর নিক্ষেপ করে নবী (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। রাসুল (সা.) তাদের কুমতলবের কথা অবগত হয়ে তাদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। (সিরাত ইবনে হিশাম : ২/১৯০) এরপর খন্দক যুদ্ধের অন্যতম উসকানিদাতা ইহুদি কাব বিন আশরাফকে তার অপকর্মের কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪০৩৭) বহিষ্কৃত অন্য ইহুদিরা খায়বরে মিলিত হয়ে তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখলে মহানবী (সা.) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। এখানে তারা সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ভক্তের ছদ্মবেশে মহানবী (সা.)-কে দাওয়াত দিয়ে বিষ পান করিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করে। রাসুল (সা.) একমাত্র বিষ প্রয়োগকারিণীকেই শাস্তিদান করে গোত্রের অন্যদের ক্ষমা করে দেন। (সিরাত ইবনে হিশাম : ২/৩৩৭) পরাজিত ইহুদি গোত্রগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক প্রদানের শর্তে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

মহানবী (সা.) তাদের সাময়িকভাবে আরব ভূখণ্ডে বসবাস করার অনুমতি দিলেও ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সংহতি, স্থিতি ও শান্তি সংরক্ষণের স্বার্থে তাদের হাত থেকে জাজিরাতুল আরবকে মুক্ত করার জন্য সাহাবিদের সতর্ক করে যান। রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকাল-পরবর্তী ইহুদি ষড়যন্ত্র রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মুসলিম জাহানের সার্বিক দায়িত্ব লাভ করেন। এ সময় অনেক অমুসলিম গোত্র রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের সুযোগে ইসলামকে তার বিকাশের প্রথম স্তরেই গলা টিপে হত্যার চেষ্টা চালায়। মুনাফিকদের একদল ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ জাকাত প্রদানকেই অস্বীকার করে। কেউ আবার মদিনার কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে অস্বীকার করতে চেষ্টা করে এবং মদিনা আক্রমণের স্বপ্ন দেখে। এমতাবস্থায় হজরত আবু বকর (রা.) শক্ত হাতে হাল ধরে সব প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে নেন। খলিফার বাস্তবোচিত দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে স্বল্প সময়ে মুনাফিকদের সব তত্পরতা মিইয়ে যায়। হজরত আবু বকর (রা.)-এর পর খলিফা হন হজরত ওমর (রা.)। তাঁর অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব, অনুপম চরিত্র-মাহাত্ম্য এবং অতিমাত্রায় সচেতনতা সাময়িকভাবে হলেও শত্রুদের সব ধরনের শয়তানি অপচেষ্টায় বিরত থাকতে বাধ্য করে। ওমর (রা.)-এর ১০ বছরের খেলাফত আমল ছিল ইসলামের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা ও অবিরাম বিস্তৃতির যুগ। এ সময় মুসলিম বাহিনী সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, মিসর, ইরান ও ইয়েমেন পুরোপুরিভাবে জয় করে। এরপর খলিফা হন হজরত ওসমান (রা.)। তাঁর খেলাফতের প্রথম কয়েক বছর পরিপূর্ণ শান্তি-নিরাপত্তার আবহ বিরাজ করে। সেই সঙ্গে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষামূলক অগ্রাভিযানও অব্যাহত থাকে। ইসলামের এ অব্যাহত অগ্রযাত্রা ও অগ্রাভিযান মুনাফিক ও ইহুদিদের অন্তর্জ্বালা বাড়িয়ে দেয়। সহস্র বছরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ইরানি সাম্রাজ্য, সুদীর্ঘকালের অজেয় বিশাল রোমক সাম্রাজ্যকে নবোত্থিত এ মুসলিম শক্তির সামনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখে দুশমনরা বুঝতে পারে, সম্মুখ সমরে এ অজেয় বাহিনীকে কিছুতেই মোকাবিলা করা যাবে না। এদের ভেতরে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েই কেবল অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। হজরত ওসমান (রা.)-এর দয়া ও সহিষ্ণুতা তাদের জন্য অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়।

রোমক সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান অধিবাসীরা, পারস্য সাম্রাজ্যের অগ্নিউপাসকরা তাদের নিজ নিজ গৌরবমণ্ডিত বিশাল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য মুসলমানদের দায়ী মনে করে এবং যেকোনোভাবে মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণে সংকল্পবদ্ধ হয়। এরাও আগে থেকে তত্পর ইহুদি ও মুনাফিকদের ঘৃণ্য অশুভ প্রয়াসের সঙ্গে হাত মেলায়। এ সময় আবদুল্লাহ বিন সাবা নামক ইয়েমেনের অন্তর্গত সান’আর একজন ইহুদি মুসলমান হওয়ার দাবি করে এবং আগে থেকে মুসলিম সমাজে অবস্থানরত মুনাফিকদের গোপন তত্পরতায় যোগ দেয়। অল্প দিনের মধ্যেই সে তার অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা, নেতৃত্ব গুণ, উদ্ভাবনী শক্তি ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সব মুনাফিককে ছাড়িয়ে যায়। (আল বিদায়া ওয়াননিহায়া, ইবনে কাসির : ৭/১৬৭-১৭০) ইসলামের অব্যাহত অগ্রযাত্রা ও বিস্তৃতির পেছনে কার্যকারণ শক্তি হিসেবে ছিল মুসলমানদের অটুট ঐক্য ও সংহতি। তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাস ছিল তাদের ঐক্য ও সংহতির মূল সূত্র। রাসুল (সা.) ওপরের তিনটি মৌল বিশ্বাসের ভিত্তিতে এমন একটি সমাজের বুনিয়াদ কায়েম করেছিলেন, যার শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্যের প্রতীক ছিল ইমান ও তাকওয়া। সব বংশগত কৌলিন্য, গোত্রীয় আভিজাত্য, রক্ত ও বর্ণের অহমিকাবোধের দাফন ঘটিয়ে শতধাবিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে কালেমায়ে তাইয়েবার পতাকাতলে সমবেত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের ঐক্য ও সংহতি ছিল সিসাঢালা প্রাচীরের মতো। কাফির, মুশরিক, মুনাফিক, ইহুদি ও খ্রিস্টান শক্তি তাই মুসলমানদের শক্তির উৎস এই পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতির ভিত্তিমূলেই আঘাত হানতে প্রয়াস পায়। তারা হজরত ওসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে মুসলমানদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে তাঁকে শহীদ করে।

পরবর্তী সময়ে হজরত আলী (রা.)-এর ছত্রচ্ছায়ায় এসে কূটচাল আরম্ভ করে। এর ফলে হজরত আলী (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে মুসলিম উম্মাহর রক্ত প্রবাহিত করে। পরবর্তী সময় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হজরত আলী (রা.)-কে শহীদ করে। তাঁর পুত্র হাসান (রা.)-কেও একই ষড়যন্ত্রের জালে শহীদ করে। পরবর্তী সময় কারবালায় হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতও একই সূত্রে গাঁথা। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য-ফেরকাবাজির যে সূত্রপাত অভিশপ্ত ওই ইহুদি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শুরু হয়, আজ পর্যন্ত ওই ফেতনার দ্বার বন্ধ হয়নি। (চলবে) লেখক : ফতোয়া গবেষক ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার