Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

প্রাথমিক পর্যায়ে দেওয়া বই নিন্মমানের

base_1474400344-xrfty

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের নতুন বছরের শুরুই হয় বই উৎসবের মধ্য দিয়ে। নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে কোমলমতি শিশুরা। এসব বইয়ের ছাপা ও কাগজের মান, প্রচ্ছদ, ভেতরের গল্প-ছবি সবসময় এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যেন তা শিশুদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে শিশুদের বিতরণ করা হচ্ছে নিম্নমানের বই। সম্প্রতি পাঠ্যবইয়ের বেহাল চিত্রের কথা উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) এক প্রতিবেদনে।

chardike-ad

এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে ছাপা বর্ণগুলো ছোট ও হিজিবিজি। লেখা এবং ছবিও অস্পষ্ট। এগুলো পড়তে শিশুদের কষ্ট হয়। বইয়ের ভেতরে গল্প ও লেখার সঙ্গে মিল নেই ছবির। কোথাও একই ছবি দুবার ছাপা হয়েছে। পৃষ্ঠাসজ্জাও ঠিক নেই। কিছু বইয়ে রয়েছে গল্প ও ছবিবিহীন কেবল সাদা পাতা। আবার কোনো কোনো বইয়ের ভেতরের কিছু পাতাও নেই। কাগজ খুবই পাতলা। সামান্য পানি লাগলেই বইয়ের পাতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বই বাঁধাইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের আঠা। বাঁধাইয়ের মানও ভালো নয়।

সরকারি অর্থে কেনাকাটার গুণগত মান যাচাইয়ে প্রথমবারের মতো এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সিপিটিইউ। প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)। গত সপ্তাহে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদন তৈরির লক্ষ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলের রংপুর সদর, মিঠাপুকুর, সিরাজগঞ্জ সদর ও বেলকুচি উপজেলার ২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি জরিপ চালানো হয়। এতে ২০৩ জন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক এবং ৮ হাজার ৫০৭ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পাঠ্যবইয়ের ব্যাপারে মত নেয়া হয়।

প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের বেশ কয়েকটি বই নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই। ছয়টি করে বই নেয়া হয়েছে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক বিজ্ঞান (বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচিতি)।

পাঠ্যবই ক্রয়-সংক্রান্ত জরিপ পরিচালনাকারী দলের প্রধান ও বিআইজিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী সৈয়দা সেলিনা আজিজ বণিক বার্তাকে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এখানে গবেষকদের ব্যক্তিগত কোনো মত নেই। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বিতরণ করা পাঠ্যবইয়ের বাস্তব চিত্র।

চলতি বছরের প্রথম দিনই দেশের সব প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক স্কুল, দাখিল মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয়। এবার ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২টি বই বিতরণ করা হয়। ২০১০ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বছরের প্রথম দিবসে ২৬ কোটি ২ লাখ ২১ হাজার ৮৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮৯ কোটি ২১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯৫টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করে সরকার। তবে বরাবরই এসব বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সচেতন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিশুদের মনের সুষ্ঠু বিকাশ ও শিক্ষায় আগ্রহ তৈরিতে মানসম্মত বই খুবই সহায়ক। নিম্নমানের ও ভুল ছাপার বই শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কয়েক বছর থেকেই দেশের পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। অথচ কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আগে যেখানে শিশুরা ঝকঝকে ও মানসম্মত বই পেত, এবারের নিম্নমানের বই দেখে স্বভাবতই তারা মনঃক্ষুণ্ন। এমন খারাপ মানের বই শিক্ষার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জরিপে অংশ নেয়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরাও চলতি বছরের বইয়ের মান অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় খারাপ বলে মত দিয়েছেন।

যোগাযোগ করা হলে নাটোর, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, সিলেট, কক্সবাজারসহ দেশের কয়েকটি উপজেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, বছরের প্রথম দিনই উত্সবমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীদের বই বিতরণ করা হয়। কিন্তু বই বিতরণের পর পরই বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকরা বইয়ের মান নিয়ে নানা অভিযোগ নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তাদের অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। কোথাও সীমিত পরিসরে কাটাছেঁড়া বা ভুল ছাপার বই পরিবর্তন করে নতুন বই দেয়া হয়েছে। এ বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বইয়ের বানান ভুলের ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা বইয়ের বানানকেও অশুদ্ধ মনে করেন। আর ছবি ও লেখার অসামঞ্জস্যের কোনো ব্যাপার ধরা পড়েনি। এ-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগও আসেনি। বিষয়গুলো দৃষ্টিগোচর হলে বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষক দলের মাধ্যমে পরবর্তী সংশোধনীতে ঠিক করা হবে।

সিপিটিইউ বলছে, চলতি বছরের প্রাথমিকের বইয়ের জন্য কাজ পায় ২২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দেশীয় প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য ধরে রাখতে এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় বাজারদর থেকে ৩২ শতাংশ কম মূল্যে বইয়ের কাজ নেয়। তবে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ যথাযথ তদারকি হয়নি। এক্ষেত্রে দায়সারা গোছের পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হলেও তাদের ছিল না অভিজ্ঞতা। বই ছাপার ক্ষেত্রে ছিল অপর্যাপ্ত সময়। সব প্রক্রিয়া শেষে মাত্র ১৩০ দিন সময় ছিল বিপুল সংখ্যক এ বই ছাপার কাজ শেষ করার। এমন অবস্থায় যথাসময়ে মানসম্মত বইয়ের ব্যাপারে শঙ্কাও প্রকাশ করেছিল বিশ্বব্যাংক।

সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে সিপিটিইউর মহাপরিচালক ফারুক হোসেন বলেন, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের মান ও বিতরণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। নিরপেক্ষভাবে ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে আগামীতে বইয়ের মান বাড়াতে বেশকিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এনসিটিবি এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় জোরদার এবং পাঠ্যপুস্তকের মান বজায় রাখতে কঠোর নজরদারি আরোপ। এক্ষেত্রে বহুধাপ নজরদারির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যথাসময়ে মানসম্মত বই বিতরণে প্রতিষ্ঠান দুটির দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও রয়েছে। বলা হয়েছে, অসঙ্গতির ক্ষেত্রে সাব-কন্ট্রাক্ট পর্যায়ে জরিমানা বাড়াতে হবে। বই প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের তদারকিও বাড়াতে হবে। প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলা ও দায়সারা গোছের মনোভাব না এড়ালে বই ছাপার ক্ষেত্রে সমস্যা থেকেই যাবে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। বণিকবার্তা থেকে।