Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সিউলে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস-এর কংগ্রেস

১৯৪৮ সালের ৯ জুন ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আকাইভস (আইসিএ)-এর জন্ম। সংস্থাটি পৃথিবী জুড়ে আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থপনা নিয়ে গবেষণা, উন্নয়ন ও নীতি নির্ধারণ এবং আর্কিভিস্ট ও নথি ব্যবস্থাপকদের নেটওয়ার্ক সৃষ্টি ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আইসিএ ইউনেস্কো স্বীকৃত সর্বোচ্চ সংস্থা। প্রতিটি দেশের জাতীয় আর্কাইভস সহ এই বিষয়ের হাজারের উপরে সংগঠন এই সংস্থার সদস্য। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসও এই সংস্থার একজন সদস্য। ফ্রেন্ডস অব আর্কাইভস, বাংলাদেশ (এফএবি) নামে অপর একটি বেসরকারি সংস্থা আইসিএ’তে বাংলাদেশকে প্রতিনিধীত্ব করছে।

archive
সিউলে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস অংশ নেন ১১৪ টি দেশের প্রতিনিধিগণ

১৯৫০ সালে আইসিএ আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্যারিসে প্রথম বিশ্বসভা বা কংগ্রেসের আয়োজন করে। পরবর্তীতে চার বছর অন্তর অন্তর পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে তাদের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলো ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিউলের কোয়েক্স কনভেনসন সেন্টারে। একশত দশের অধীক দেশ থেকে আর্কাইভস, নথি ও তথ্য প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট প্রায় দুই হাজারের অধীক প্রতিনিধী সিউল কংগ্রেসে অংশ নেন। কনভেনসন সেন্টারের প্রায় পুরো তৃতীয় তলা জুড়েই কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মসূচী চলে। ৫টি কক্ষ, ৬টি ছোট হলঘর, ৩টি বড় হলঘর ছাড়াও মূল মিলনায়তনটি কংগ্রেসের বিভিন্ন আয়োজনের জন্য ব্যবহার হয়।
এবারের কংগ্রেসের থিম বা বিষয়বস্তু ছিল: ‘আর্কাইভস, হার্মোনি (সমন্বয়) এন্ড ফ্রেন্ডশিপ (বন্ধুত্ব)’। কোরিয়ার জাতীয় আর্কাইভসের প্রধান স্যাঙ জিন লী কংগ্রেসে আগত সকল আর্কিভিস্টদের স্বাগত জানান এই বলে যে, এবারের কংগ্রেস ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় ঘটাবে এবং সারা বিশ্বের আর্কিভিস্টদেরকে একে অপরের কাছাকাছি নিয়ে আসবে।

chardike-ad

৬ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টায় কনভেনসন সেন্টারের মিলনায়তনে কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। তবে ৫ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই আইসিএ-এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলির সমন্বয় সভা, বাত্সরিক সভা ও নীতি নির্ধারণী সভার মাধ্যমে কংগ্রেসের যাত্রা শুরু হয়। এ সভাগুলিতে সংগঠনগুলি তাদের অতীত কর্মকান্ডের মূল্যায়ন এবং তাদের লক্ষ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এসব সভার পাশাপাশি ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বরের দুপুর পর্যন্ত, পেশাগত বিষয়েরও বেশ কিছু উপস্থাপনা ছিল।

lutful
কনগ্রেসে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিদের সাথে লেখক

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আগত অতিথি ও অংশগ্রহণকারীদের সবার স্থান মিলনায়তনে সংকুলান হবে না বলে আগে থেকেই পাশের হলঘরে বড় পর্দায় অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়। যারা মূল মিলনায়তনে জায়গা পাননি তারা হলঘরে বসে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘ্য, ইউনেস্কো, আইসিএ ও কোরিয়ার জাতীয় আর্কাইভসের উর্দ্ধতন প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।

আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক নিয়ে ৫৮টি দেশের ২৫৬ জন বক্তা তাদের প্রতিবেদন ও বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সর্ব্বোচ্চ সংখ্যক বক্তা ছিল কোরিয়া থেকে, এর পরই ছিল চীন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। উপস্থাপকরা ইংরেজি, ফরাসী, চীন, স্পেনিস, রুশ, আরবী, জাপানী ও কোরিয়ান ভাষা ব্যবহার করেন। বড় হলঘর ও অডিটরিয়ামের উপস্থাপনাগুলি তাত্ক্ষণিক ভাষান্তর করে কডলেস ইয়ারফোনের সাহায্যে শ্রোতাদের শুনার ব্যবস্থা ছিল। উপস্থাপনাগুলিতে বেশী গুরুত্ব পায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের ডিজিটাল নথি বা তথ্য সংরক্ষণের বিষয়টি। এছাড়াও তথ্য অধিকার ও তথ্যে নাগরিকের গম্যতাসহ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনা কি ভূমিকা রাখছে ও রাখতে পারে তাও আলোচনা হয়। জাতীয় আর্কাইভসের পাশাপাশি কম্যুনিটি আর্কাইভস বা স্থানীয় আর্কাইভসের প্রয়োজনীয়তা এবং এ ধরণের আর্কাইভস মানব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কিভাবে সাহায্য করতে পারে তা তুলে ধরা হয়।

এ বছরের মাঝামাঝি আইসিএ প্রথমবারের মতো আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনা নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। এটি বেশ সাড়া জাগায় এবং বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় কুড়িটি তথ্যচিত্র জমা পড়ে। কংগ্রেসে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হয় এবং ছয়টি তথ্যচিত্রকে পুরস্কৃত করা হয়। ছোটছোট বার্তার মাধ্যমে আর্কাইভস, নথি ও তথ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা ও এটিকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশে তথ্যচিত্রগুলি নির্মিত হয়েছিল।
কংগ্রেসের অন্যতম একটি অংশ ছিল আর্কাইভস সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রদশর্নী। প্রদর্শনীতে ৩৮টি স্টল বা বুথ ছিল। সনি, স্যামসং, এলজি, ফুজি, গুগুল সহ বিশ্বের নাম করা অনেক বানিজ্যিক ও তথ্য প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তাদের বিভিন্ন পণ্য ও প্রোগ্রাম দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করে। বেশীরভাগ স্টলে নথি সংরক্ষণ ও তথ্যের নিরাপত্তায় আধুনিক প্রযুক্তির সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার এবং নথির ডিজিটাইজেসন সংশ্লিষ্ট পণ্য ও প্রোগাম প্রদর্শিত হয়।

কোরিয়ার বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রদর্শনীর একটি বড় এলাকা জুড়ে ‘কোরিয়ান পাবলিক সেক্টর এক্সিবিসন’ আয়োজন করে। এখানে ২১টি স্টলে তারা নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে। এই স্টলগুলিতে হাজার বছর ধরে কিভাবে তারা তাদের সংগিত, হস্তলীপি, ক্রীড়া, চিত্রকলা সহ অন্যান্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন-পালন করছে তা উপস্থাপন করে।

৮ ডিসেম্বর রাতে কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারীরা ছাড়াও সে দেশের মন্ত্রি ও বেশ কিছু গন্যমান্য ব্যক্তি নৈশভোজে উপস্থিত ছিলেন। নৈশভোজে কোরিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সংশ্লিষ্ট করে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। রঙ্গীন আলোর খেলা, শব্দের নিখুঁত প্রক্ষেপন আর বড় পর্দায় ভিডিও মিলিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি খুব মনোজ্ঞ হয়েছিল।

৯ সেপ্টেম্বর বিকাল চারটায় আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সমাপ্তির পূর্বে আইসিএ এবং কোরিয়ার জাতীয় আর্কাইভস একটি যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করে। ইশতেহারে নথি ও আর্কাইভস পেশাজীবিরা সারা বিশ্বে তাদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। এছাড়া ইশতেহারে টেকসই নথি ব্যবস্থাপনা, তথ্য ভান্ডার হিসেবে নথির স্বীকৃতি, ডিজিটাল নথি সংরক্ষণ পদ্ধতি, আন্তর্জাতিক পর্য্যায়ে সহযোগিতা বৃদ্ধিকেও জোর দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের শেষে ২০২০ সালের আইসিএ কংগ্রেসের আয়োজক আবুধাবীকে আইসিএ-এর পতাকা তুলে দেয়া হয়।

একটু কষ্টের কথা উল্লেখ করে আমার রচনার ইতি টানছি। কংগ্রেস চলাকালে প্রতিদিন সিউলের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের প্রদর্শনী এলাকায়, বিশেষ করে ‘কোরিয়ান পাবলিক সেক্টর এক্সিবিসনে’, ঘুরে বেড়াতে দেখতাম। বিভিন্ন স্টলে গিয়ে তারা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও তথ্য প্রযুক্তির সবশেষ পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত হতো। একদিন ৩/৪ বছরের কয়েকটি শিশুকেও প্রদর্শনীতে ঘুরে বেড়াতে দেখি। এদিয়ে বুঝা যায় যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রথম পাঠ তারা কিভাবে পেয়ে থাকে। বিপরীত চিত্র দেখি স্বদেশে। ষোল কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। আইসিএ কংগ্রেসে বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসসহ কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান যোগ দেয়নি। অথচ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, পরিদর্শনসহ বিভিন্ন কম, অগুরুত্বপূর্ণ ও অনুল্লেখ্য কর্মকান্ডে সরকারের শত শত কর্মকর্তা আর নীতি নির্ধারকরা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন। অথচ ইতিহাস, ঐতিহ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, মানবাধিকার বিষয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে বাংলাদেশের উপস্থিতি নাই। এর আগের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে, সেখানেও বাংলাদেশের উপস্থিতি ছিলনা। আমরা জানি যে বাংলাদেশে আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনার অবস্থা খুব একটা মানসম্মত নয়। জাতীয় আর্কাইভস ও স্থানীয় পর্য্যায়ের রেকর্ড রুমগুলির অবস্থাও গ্রহণযোগ্য মানের অনেক নীচে। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রযুক্তি, কৌশল ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নেয়া। আর এটা একমাত্র সম্ভব আইসিএ, ইউনেস্কো ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। ২০২০ সালে আবুধাবী শহরে আইসিএ-এর পরবর্তী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। আশাকরি সেই কংগ্রেসে বাংলাদেশ অংশ নিয়ে আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনায় নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিবে।

মুহাম্মদ লুত্ফুল হক
lutful55@gmail.com