যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের পর প্রধান প্রধান মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মানের পতন ঘটেছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিশ্রুত আর্থিক ও কর-নীতি সম্পর্কে কোনো অবস্থান তুলে না ধরায় বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়েছেন। এর প্রভাবে বিশ্বের শক্তিশালী মুদ্রার মানের পতন ঘটল। খবর মার্কেটওয়াচ ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
গত বছরের ৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বুধবার প্রথমবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তার বক্তব্যে কর কর্তন ও অবকাঠামো ব্যয় নিয়ে বিস্তৃত কিছু ছিল না। এদিকে এ দুটি প্রধান বিষয়ের ওপর নির্ভর করে বৈশ্বিক স্টক ও বন্ড বাজারে পাঁচ সপ্তাহ ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। এ অবস্থায় তার সংবাদ সম্মেলনকে বাজারবান্ধব থেকে অনেক দূরে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত বাজারে ডলারের মান কিছুটা ঊর্ধ্বগতি পায়। কিন্তু দ্রুতই এর মানের পতন ঘটে। ফ্যাক্টসেটের উপাত্ত অনুসারে, বুধবার ছয়টি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান অনুসরণকারী ইউএস আইসিই ডলার ইনডেক্স দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেলেও, পরবর্তী সময়ে দশমিক ৩ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১০১ দশমিক ৬৬ পয়েন্টে দাঁড়ায়। সে সময় ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ডলার ইনডেক্স দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯২ দশমিক ৪১ পয়েন্টে দাঁড়ায়। বিস্তৃত পরিধিতে প্রধান মুদ্রাগুলোর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার মান মূল্যায়ন করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ডলার ইনডেক্স।
সিটি ব্যাংকের জি-১০ কারেন্সি স্ট্র্যাটেজির বৈশ্বিক প্রধান স্টিভেন ইংল্যান্ডার বলেন, বিনিয়োগকারীরা রাজস্বনীতি ও কর সংস্কার-সংক্রান্ত বিশদ আলোচনার আশা করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প তার বক্তব্যে এর কোনো উল্লেখ করেননি।
এদিকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্ অর্থনীতি জাপানের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান দুর্বল হয়েছে। বুধবার রাতে নিউইয়র্কে ১ ডলারের বিপরীতে ইয়েনের মান দাঁড়ায় ১১৫ দশমিক ৩২, যা নিউইয়র্ক বাজারে মঙ্গলবার ১১৫ দশমিক ৮১ ইয়েনের চেয়ে কম। ইংল্যান্ডার বলেন, ডলার-ইয়েনের মানকে সবসময় প্রাথমিকভাবে ইল্ড ডিফারেন্সিয়াল হিসেবে ধরা হয়। ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ইল্ড এক মাসের সর্বনিম্নে গিয়ে দাঁড়ানোয় ইয়েনের বিপরীতে ডলার দুর্বল হয়ে পড়েছে। বুধবার ১০ বছর মেয়াদি মার্কিন বন্ড ও ১০ বছর মেয়াদি জাপানিজ বন্ডের মধ্যকার ইল্ড ডিফারেন্সিয়াল ২ দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট সংকুচিত হয়েছে। এর আগে গত বছরের মধ্য ডিসেম্বরে তা ২ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে। সে সময় স্প্রেড বেড়ে যাওয়ায় জাপানি বিনিয়োগকারীরা উচ্চ ইল্ডের মার্কিন বন্ড কেনার জন্য তাদের ইয়েন বিক্রি করতে থাকে, যার ফলে ডলারের মান বৃদ্ধি পায়।
ইয়েনের পাশাপাশি ইউরোর বিপরীতেও ডলারের মান দুর্বল হয়েছে। বুধবার রাতে নিউইয়র্কের বাজারে ১ ইউরোর বিপরীতে ডলারের মান দাঁড়ায় ১ দশমিক শূন্য ৫৮৪, যা মঙ্গলবার রাতের ১ দশমিক শূন্য ৫৫৩ ডলারের চেয়ে বেশি। এদিকে চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প মেক্সিকোয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জেনারেল মোটরস, ফোর্ড মোটরের ভূমিকা অনুসরণ করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রে আরো কর্মসংস্থান ধরে রাখবে বলে বক্তব্য দেয়ার পর মেক্সিকান পেসোর মান সর্বনিম্নে গিয়ে দাঁড়ায়। তবে সংবাদ সম্মেলনের পর ডলার দুর্বল হওয়ায় মার্কিন মুদ্রার বিপরীতে পেসোর মান পুনরুদ্ধারিত হয়ে ২১ দশমিক ৮৯ হয়েছে।
অন্যান্য মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংবাদ সম্মেলনের পর ডলারের বিপরীতে পাউন্ড পুনরুদ্ধার হয়ে শক্তিশালী হয়েছে। বুধবার রাতে নিউইয়র্ক বাজারে লেনদেনে পাউন্ডের বিপরীতে ডলারের মান দাঁড়ায় ১ দশমিক ২২১০, যা আগের দিনের তুলনায় সামান্য বেশি। মঙ্গলবার রাতে একই বাজারে ১ পাউন্ডের বিপরীতে ১ দশমিক ২১৬৫ ডলার লেনদেন হয়। এর আগে যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান অনুসারে, রফতানির তুলনায় আমদানি বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে ৫০৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে ব্রিটিশ শিল্প উত্পাদন শক্তিশালীভাবে বৃদ্ধি পায়। অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের শিল্প উত্পাদন ২ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফ্যাক্টসেটের উপাত্ত অনুসারে, সে সময় পাউন্ডের মান ১০ সপ্তাহের সর্বনিম্নে নেমে ১ দশমিক ২০৯৬ ডলারে দাঁড়ায়।
ট্রাম্পের আর্থিক নীতিমালা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি করবে এ প্রত্যাশায় বিগত তিন মাসে মার্কিন মুদ্রার মান ৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়। ডলার শক্তিশালী হলেও একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের বর্তমান প্রত্যাশার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধির ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে। সুদহার বৃদ্ধি পেলে ডলারের মান আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তবে এ মুহূর্তে পরিস্থিতি অনিশ্চিত বলে জানিয়েছেন মিত্সুবিশি ইউএফজে মরগান স্ট্যানলির স্ট্র্যাটেজিস্ট দাইসাকু উয়েনো।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প চীনা রফতানির বিপরীতে সম্ভাব্য শুল্ক আরোপের বিষয়েও কোনো উল্লেখ করেননি। ফলে এশীয় শেয়ারবাজারে স্বস্তি দেখা গেছে। সংবাদ সম্মেলনের পর জাপানের বাইরে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় শেয়ারের এমএসসিআই সূচক দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নভেম্বরের পর সর্বোচ্চ। একই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান সূচকও দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ডলারের বিপরীতে ইয়েন শক্তিশালী হওয়ায় জাপানের নিক্কেই সূচকে দশমিক ৭ শতাংশ পতন দেখা গেছে। এছাড়া বুধবার ওয়াল স্ট্রিট উত্থান-পতন কিছুটা সামলে উঠতে পেরেছে। ডাও সূচকে যোগ হয়েছে দশমিক ৫ শতাংশ; এসঅ্যান্ডপি ৫০০ দশমিক ২৮ ও নাসডাক দশমিক ২১ শতাংশ অর্জন করেছে।