Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ধ্বংসের ঝুঁকিতে ৬৬% বনভূমি

একটি দেশে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় মোট ভূখণ্ডের প্রায় ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে তা নেই। বরং বিগত ২৫ বছরে দেশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমেছে। বনাঞ্চল রক্ষায় নেই সমন্বিত উদ্যোগ। বিদ্যমান প্রাকৃতিক বনের প্রায় ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশই ধ্বংসের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। বন অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশ ফরেস্ট্রি মাস্টারপ্ল্যান ২০১৭-২০৩৬’ শীর্ষক খসড়ায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বন অধিদপ্তরের মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দেশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের মধ্যে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা সুন্দরবন ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলোই বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শালবনের ১ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ১৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত আছে। অর্থাত্ শালবনটির মাত্র ১৫ শতাংশ এখন বিদ্যমান আছে। অন্যদিকে দেশে সাত লাখ হেক্টর পার্বত্য বনাঞ্চলের মধ্যে মাত্র এক লাখ হেক্টর বর্তমানে প্রাকৃতিক বন দ্বারা আচ্ছাদিত। অর্থাত্ জীববৈচিত্র্যের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি বনের মাত্র ১৪ শতাংশ এখন টিকে আছে।

chardike-ad

বাংলাদেশে বনজ সম্পদের বর্তমান অবস্থা, বিরাজমান ঝুঁকির পাশাপাশি বন অধিদপ্তরের মহাপরিকল্পনায় বনভূমি ধ্বংসের তুলনামূলক তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, গত ২৫ বছরে সুন্দরবন কমেছে ১০ হাজার ৯৮০ হেক্টর। একই সময়ে শালবন ৬ হাজার ১৬০ হেক্টর এবং পার্বত্য বনাঞ্চল ৪৮ হাজার ৮১০ হেক্টর কমেছে। একইভাবে বাঁশবাগান কমেছে ৭৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর।

খসড়া মহাপরিকল্পনায় বন অধিদপ্তর বলেছে, দেশে যে বনাঞ্চল রয়েছে, সেগুলোও ধ্বংসের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিদ্যমান বনাঞ্চল রক্ষা করা ছাড়াও ৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজন রয়েছে বলে মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে। বন অধিদপ্তর এজন্য ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জনবল সংকট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের অনুপস্থিতি বনভূমি রক্ষায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি বন বিভাগের অদক্ষতা, জনসচেতনতার অভাব এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞার কারণে দেশের বনাঞ্চল ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

দেশে বনাঞ্চল কমার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনও ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক দশকে ঝড়, বন্যা ও অতিবর্ষণের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে যে ভাঙন হয়েছে, দেশের বনাঞ্চলে তার নানামুখী প্রভাব পড়েছে। জীবিকা, আবাসনসহ নানা প্রয়োজনে বনভূমিতে মানুষের নির্ভরতা ও চাপ বাড়ছে। বনাঞ্চল হ্রাসের এ ধারা ঠেকানোর পাশাপাশি নতুন বন সৃজন করতে না পারলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়বে দেশ। বাড়বে উষ্ণতা, পরিবর্তিত হবে ঋতুচক্র, বিঘ্নিত হবে বাস্তুব্যবস্থার ছন্দ। ফলে সরাসরি প্রভাব পড়বে শস্য আবাদ ও জনজীবনে। এতে বিঘ্নিত হবে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা।

এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) কান্ট্রি ডিরেক্টর ও সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে এখন সুন্দরবন ছাড়া আর কোনো প্রাকৃতিক বনাঞ্চল নেই বললেই চলে। বন অধিদপ্তরে সুশাসন ও দক্ষতার অভাবের কারণে বনাঞ্চল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। বনাঞ্চল রক্ষায় গৃহীত কার্যক্রম জোরদার এবং সামাজিক বনায়নে মালিকানার বিষয়টি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। বনাঞ্চল রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আইন, নীতিমালা, জনবল ও উপযুক্ত উপকরণের সমন্বয়ে বন অধিদপ্তরকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।

বন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ১৯৯০ সালে দেশে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ছিল ৪ লাখ ১ হাজার হেক্টর; ২০০০ সালে তা ৩ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর এবং ২০০৫ সালে ৩ লাখ ৯৫ হাজার হেক্টরে নেমে আসে। প্রাকৃতিক এ বনজ ব্যবস্থা সংকোচনের ধারাবাহিকতা ২০১৫ সালেও দেখা গেছে। ২০১৫ সালে ম্যানগ্রোভ বনের আয়তন ৩ লাখ ৯০ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। অন্যদিকে শালবনের আয়তন ১৯৯০ সালে ২৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর থাকলেও ২০০০ সালে তা ২১ হাজার ৯৯০ হেক্টর এবং ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৯০ হেক্টরে নেমে আসে। একইভাবে পার্বত্য বন ১৯৯০ সালে ১ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর থাকলেও ২০১৫ সাল নাগাদ তা ৭৯ হাজার ১৬০ হেক্টরে নেমে আসে। ২৫ বছরে পার্বত্য বন কমেছে ৪৮ হাজার ৮১০ হেক্টর। মানবসৃষ্ট কারণের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন সুন্দরবনসহ দেশের বনভূমির জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বসতি স্থানান্তর ও অন্যান্য কারণে মাটি ও পাহাড়ের ওপর চাপ বাড়ছে। উপরন্তু ২০৫০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি ও শীতকালে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ৩ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এ সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়বে ২ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত।

‘প্যাটার্নস অ্যান্ড এক্সটেন্ট অব থ্রেটস টু দ্য প্রটেকটেড এরিয়াস অব বাংলাদেশ: দ্য নিড ফর রিলুক অ্যাট কনজারভেশন স্ট্র্যাটেজিস’ শীর্ষক এক গবেষণায় প্রাকৃতিক ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংসে ১০টি ঝুঁকির কথা বলা হয়। এর মধ্যে বনাঞ্চল রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আইনি ও নীতিসহায়তা এবং অর্থ বরাদ্দে অপর্যাপ্ততার কথাও উল্লেখ করা হয়। বিধি ও আইনবহির্ভূতভাবে গাছ কাটা, বাজারে অবৈধভাবে কাঠ বিক্রি, স্থানীয় সম্প্রদায় দ্বারা অ-টেকসই ও অবৈজ্ঞানিকভাবে বনজ সম্পদ আহরণকেও দায়ী করা হয়। শিল্প ও আবাসন ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ এবং জমি দখলকারীদের প্রভাবের কারণে বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে গবেষণায় বলা হয়। এছাড়া স্থানীয় জনগণের অসহযোগিতাও বনাঞ্চল সংরক্ষণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বনাঞ্চল ধ্বংসের ঝুঁকি হিসেবে বিভিন্ন আইনি কাঠামো প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে অপ্রয়োজনীয় কালক্ষেপণকে গবেষকরা দায়ী করেছেন।

ক্রমাগত ও ধারাবাহিক বনাঞ্চল ধ্বংসে হুমকিতে রয়েছে দেশের জীববৈচিত্র্য। বিলুপ্তির পথে রয়েছে দেশের বনাঞ্চলের ৪০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪১ প্রজাতির পাখি, ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং আট প্রজাতির উভচর প্রাণী।

বিশ্বব্যাপী বনাঞ্চল হ্রাসের ধরন ও কারণ নিয়ে গবেষণা করেছে আইইউসিএন। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, আর্থসামাজিক, প্রাতিবেশিক ও পারিবেশিক বিবেচনায় বনজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ হলেও গত ১০০ বছরে বিশ্বের প্রায় ৪৫ শতাংশ বন ধ্বংস করা হয়েছে। বাংলাদেশে এ হার আরো বেশি। গত ৫০ বছরে দুই-তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে বলে আইইউসিএনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, জনসংখ্যার তুলনায় দেশে জমি কম থাকায় প্রয়োজনীয় বন সংরক্ষণে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। সারা বিশ্বে যেখানে বনাঞ্চল কমছে, সেখানে বর্তমান সরকার ৪ শতাংশ বনাঞ্চল বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং বনাঞ্চল রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করতে পর্যাপ্ত অর্থায়নের প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে। আর সরকারের কর্মকাণ্ডে জনগণ উত্সাহিত হয়েছে বিধায় মানুষের ভেতরে বন রক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও উত্সাহ তৈরি হয়েছে। এটি কাজে লাগিয়েই বন রক্ষায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। বণিকবার্তার সৌজন্যে।