Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিতর্ক, খসড়া সংশোধনের উদ্যোগ

expatবাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইনের খসড়ার কয়েকটি ধারা নিয়ে আপত্তি ওঠায় তা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ আইন কার্যকর হলে, বিশেষ করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের প্রবাসীদের বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাবে। তা ছাড়া এটির কিছু ধারা কিছু মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অভিবাসন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এগুলো সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পরিপন্থী। এসব আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে আইনের খসড়া সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মন্ত্রিসভা নাগরিকত্ব আইন ২০১৬-এর খসড়াটি অনুমোদন করে, যা আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের (যাচাই) জন্য পাঠানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে এটির কিছু দুর্বল দিক শনাক্ত করেছেন। এ ছাড়া ইতিমধ্যে আইনমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বিশেষজ্ঞ ও প্রবাসীরা বলছেন, এ আইন পাস হলে প্রবাসে ভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব (দ্বৈত নাগরিক) নিয়ে যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁদের সন্তানেরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারাবেন। যাঁদের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকবে এবং যাঁরা বংশসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হবেন, বাংলাদেশে তাঁদের নাগরিক অধিকার সংকুচিত হয়ে যাবে। তাঁরা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে পারবেন না, কোনো সরকারি চাকরি পাবেন না, কোনো রাজনৈতিক সংগঠনও করতে পারবেন না।

এ নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রবাসীদের স্বার্থরক্ষা করে নাগরিকত্ব আইন চূড়ান্ত করা হবে। এটা ভেটিংয়ে আসার পর প্রবাসীরা চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা আইনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। তাঁরা যে বিষয়গুলো নিয়ে আপত্তি তুলে ধরেছেন, সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজন হলে শুধু প্রবাসীদের সব সুবিধা যাতে সুরক্ষা হয়, সেভাবেই নাগরিকত্ব আইন নতুনভাবে করা হবে।

chardike-ad

জনপ্রশাসনসচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক আইনের বিষয়ে সমালোচনার কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেছেন, আইনটিতে অনেক ভুল হয়েছে। অনেক বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তা সংশোধন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সংসদের স্পিকার আইনটির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

যেখানে প্রবাসীদের উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কয়েকজন প্রবাসী নাগরিক প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রস্তাবিত আইনটিতে ৫-এর (২) (ক)উপধারায় বলা হয়েছে, বংশসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য জন্মের দুই বছর বা আইনটি বলবৎ হওয়ার দুই বছরের মধ্যে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনে জন্মনিবন্ধন করতে হবে। ফলে দুই বছরের মধ্যে জন্মনিবন্ধনে ব্যর্থ হওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রবাসীরা বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। তা ছাড়া এ ধারায় যেভাবে শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে, তাতে তৃতীয় প্রজন্মের প্রবাসীদের (যাঁদের পিতা বংশসূত্রে নাগরিক হয়েছেন) বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার কোনো সুযোগই পাবেন না।

প্রবাসীরা প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি বিরাট অংশই তৃতীয় প্রজন্মের। এই আইন বলবৎ হলে তাঁরা বংশসূত্রে নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন। এতে অনেকেই আর বাংলাদেশে আসতে ও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না।

ব্রিটেনের আইনজীবী নজরুল খসরু প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসী এবং আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে এটাকে সংশোধন করে সংসদে উত্থাপন করা উচিত। তিনি বলেন, এ আইন পাস হলে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ১৮ লাখ প্রবাসী, যাঁরা ওই সব দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করছেন, তাঁরা ভোগান্তিতে পড়বেন। কারণ তাঁরা দ্বৈত নাগরিক। এর মধ্যে শুধু ব্রিটেনেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাড়ে ৭ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি।

ফ্রান্সের প্রবাসী ও ইয়ুথ অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট নূর ইসলাম হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই আইনের কিছু ধারা সরাসরি প্রবাসী স্বার্থের পরিপন্থী। আইনের ৫ ও ১৩ নম্বর ধারার মাধ্যমে প্রবাসীদের মূলত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।’

পিতার অপরাধে পুত্রের শাস্তি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত আইনের ধারা ৪(২) (খ), ৫(৩) এবং ১১(গ) উপধারায় পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এটি সংবিধান এবং সর্বজনীন মানবাধিকারের পরিপন্থী। পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতার কারণে শিশুকে শাস্তি দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, জাতীয়তা নির্ধারিত হওয়ার পর কাউকে রাষ্ট্রহীন করা যায় না।

আইনের ৪(২) উপধারায় বলা হয়েছে, কারও পিতা বা মাতা বিদেশি শত্রু হলে তিনি জন্মসূত্রেও নাগরিক হতে পারবেন না।

আইনের খসড়ার ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আপাতত বলবৎ কোনো আইন, দলিল, রায়, ডিক্রি যা-ই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধান প্রাধান্য পাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে সংবিধানের সার্বভৌমত্ব ও আদালতের সাংবিধানিক ক্ষমতা সংকুচিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, বাংলাদেশের সব নাগরিক সমান। প্রত্যেকে সমান অধিকার ভোগ করবেন। চাকরি ও নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করা যাবে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘খসড়া আইনটি সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ওই ঘোষণায় জন্মনির্বিশেষে সবারই সমান অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিদ্যমান নাগরিকত্ব আইনের সংস্কার জরুরি। কিন্তু যে খসড়াটি মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।’

আইনজীবী শাহদীন মালিক এ বিষয়ে বলেন, কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব নির্ধারিত হওয়ার পর তাঁকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। এটা আইনের স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, খসড়ায় সবচেয়ে ভয়ংকর দিক ফুটে উঠেছে ২০ নম্বর ধারায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব ছাড়া বাংলাদেশের অন্য যেকোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে, যদি তিনি কোনো কাজে বা আচরণে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আনুগত্যহীনতা প্রকাশ করেন বা বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রত্যাহার করেছেন মর্মে তথ্য পাওয়া যায়। এখন সার্বভৌম বা সংবিধানের আনুগত্যহীনতা প্রকাশ করা বলতে কী ধরনের কর্মকাণ্ড বোঝাবে বা কে তা নির্ধারণ করবে, সে বিষয়ে এই আইনে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তিনি বলেন, আইনটি নিয়ে যতটা আলোচনা প্রয়োজন, তা হয়নি। নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কেউ একবার রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়লে প্রতি পদে তাঁকে অসংখ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তাঁর কোনো নাগরিক অধিকার থাকে না। এটি অত্যন্ত অমানবিক একটি বিষয়।

প্রথম আলো থেকে নেওয়া।