Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টে দিয়েছিল যে মাদক সংস্কৃতি

ঠিক ৫০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে নৈরাজ্যবাদে বিশ্বাসী মার্কিন তরুণদের একটি দল ‘সামার অব লাভ’ নামে এক সমাবেশের ডাক দিয়ে বসল। লিসারজিক এসিড ডাইথিলামিড (এলএসডি) নামক মাদক নিষিদ্ধের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট পার্কে হয়েছিল ওই প্রতিবাদ সমাবেশ। এর পেছনে ছিল মূলত মার্কিন বিদ্রোহী তরুণদের দল হিপ্পি। নিজেদের দাবির পক্ষে তারা গঠন করেছিল ‘ব্রাদারহুড অব এটারনাল লাভ’ নামে একটি সংগঠন। আন্দোলনটি মার্কিন সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল বহুলাংশে।

মূলত হিপ্পি সংস্কৃতি থেকে জন্ম নিয়েছিল ব্রাদার অব এটারনাল লাভ। তাদের লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক, তবে শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এই আন্দোলনটি ছিল ইভানজেলিক সম্প্রদায়ের একটি অংশের পরিচালিত। তারা নিজেদের আধ্যাত্মিকতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে এলএসডি সেবন করত। এই এলএসডির মধ্যে থাকে সিলোসিবিন নামের একটি পদার্থ, যা সেবনকারীকে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার এক অনুভূতি দেয়। এজন্য একটি আলাদা একটি প্রার্থনাগারও তৈরি করেছিল ব্রাদারহুড সদস্যরা।

chardike-ad

একটি কল্পরাষ্ট্র বা ইউটোপিয়ার স্বপ্ন ছিল তাদের, যেখানে কোনো আইন কানুন থাকবে না, প্রত্যেকে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। এই ধারণাটি তারা পেয়েছিল দার্শনিক অলডাস হাক্সলির লেখা উপন্যাস ‘আইল্যান্ড’ থেকে। তিনি নিজেও এলএসডি প্রস্তুতকারক দ্রব্য সিলোসিবিন উৎপাদনের একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন।

এ নিয়ে টিমোথি লেয়ারি এবং রিচার্ড আলপার্টের নেতৃত্বাধীন হার্ভার্ড প্রোজেক্ট নামের একটি গবেষণা প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন হাক্সলি। ১৯৬২ সালে মাদকটি নিয়ে বোস্টনে একটি গবেষণা চালানো হয়। ‘গুড ফ্রাইডে এক্সপেরিমেন্ট’ নামের ওই গবেষণায় দেখা যায়, ১০ স্নাতক শিক্ষার্থীর নয়জনই ওই মাদক গ্রহণের পর ধর্মীয় অনুভূতি লাভ করেন। স্রষ্টার সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক অনুভব করেন।

দার্শনিক অলডাস হাক্সলি
দার্শনিক অলডাস হাক্সলি

এক পর্যায়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্টারনাল ফ্রিডম’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনও তৈরি করেছিল ব্রাদারহুড। হাক্সলির উপন্যাস আইল্যান্ড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ওই সংগঠনের অধীনে ‘জিহুয়াতানেজো প্রোজেক্ট’ নামে একটি সাইকেডেলিক (এলএসডি) প্রশিক্ষণকেন্দ্রও খুলেছিল তারা।

এলএসডি মাদককে কেন্দ্র করে হিপ্পিদের ব্রাদারহুড অব এটারনাল লাভ প্রথমে গড়ে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মেক্সিকোতে। সেখানে বসে তারা মৃত্যুর পর কীভাবে পুনর্জন্ম লাভ করা যায়, তা নিয়ে ‘দ্য সাইকেডেলিক এক্সপেরিয়েন্স: এ ম্যানুয়েল বেইজড অন দ্য টিবেতান বুক অব দ্য ডেড’ নামে বই লিখতে শুরু করে। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিল হাক্সলিকে। এতে ১৯৫৪ সালে তার লেখা ‘দ্য ডোরস অব পারসেপশন’ নিবন্ধটিও তুলে দেয়া হয়। ওই নিবন্ধে মেক্সিকোতে পাওয়া সাইকেডেলিক কীভাবে আধ্যাত্মিকতা সৃষ্টি করে, সে সম্পর্কে দিক নির্দেশনা ছিল।

হাক্সলির উপন্যাস আইল্যান্ড ছিল মূলত তার আগের আরেকটি উপন্যাস ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’র ধারাবাহিকতা। এর ওপর ভিত্তি করে ব্রাদারহুড তাদের কাল্পনিক রাষ্ট্রের জন্য একটি দ্বীপও ঠিক করেছিল, যার নাম তারা দিয়েছিল ‘পালা’। ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মাউন্ট পালোমারের পাশের একটি শহরের নামে এই নামকরণ করেছিল তারা। ওই শহরে হাক্সলির বন্ধু হাবল টেলিস্কোপের উদ্ভাবক এডউইন হাবল আকাশ দেখতেন এবং ব্রাদারহুড সদস্যরা এলএসডি সেবন করত।

পালা শহরের বাসিন্দারা ব্যাপকভাবে সাইকেডেলিক মাশরুমে আসক্ত ছিল। সেখানে হাক্সলির শান্তিবাদী, আধ্যাত্মিক এবং যৌনতার ধারণার ওপর ভিত্তি করে একটি সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিল তারা। ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড প্রকাশের কয়েক বছর আগে লস অ্যাঞ্জেলেসে তার বাড়িটি আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে এই দার্শনিককে বলা হতো, ‘সম্পত্তিবিহীন এবং অতীতবিহীন একজন মানুষ’।

শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। এক পর্যায়ে তার উপন্যাসে বর্ণিত মৃত্যুর পথ বেছে নেন। জীবনের শেষ সময়ে উচ্চমাত্রার এলএসডি শরীরে প্রবেশ করানোর অনুরোধ করেন তিনি। তার স্ত্রী ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে দেন ওই মাদক। ওই মৃত্যুকে তিনি বর্ণনা করেছেন ‘সবচে শান্তিময়, সবচে সুন্দর মৃত্যু’ হিসেবে।

অবশ্য ছোট ছোট অনেক অপরাধীর ওপরও মাদকটির প্রভাব ছিল অপরিসীম। এরাও ছিল ব্রাদারহুডের সদস্য। এসব অপরাধীর তিনভাগের দুইভাগই পুলিশের তালিকায় ছিল পলাতক আসামী। তাদের প্রতিষ্ঠাতা জন গ্রিগস নিজেও ছিল হেরোইন আসক্ত। একবার হলিউডের এক পরিচালককে বন্দুকের মুখে অপহরণ করেছিলেন তিনি। তবে ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠার পর সহিংসতা পরিহার, ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং চুরি করা সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষে প্রচারণা চালান গ্রিগস।

প্রাথমিকভাবে ব্রাদারহুডের লক্ষ্য ছিল প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ভেঙে দেয়া এবং দ্বীপে একটি নতুন জীবন শুরু করা। সংগঠনটির প্রথম দিকের সদস্য এডওয়ার্ড পাডিলা বলেন, ‘আমাদের কাছে দ্বীপটি ছিল স্বাধীনতার প্রতীক।’ নিজেদের কল্পিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ব্রাদারহুড সদস্য হাওয়াই দ্বীপকে বেছে নিয়েছিলেন। পাডিলার এক বন্ধু নতুন ভূখণ্ডের সন্ধানে মাইক্রোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে চলে গিয়েছিলেন।

একটা বিষয়ে ব্রাদারহুড সদস্যরা একমত ছিল, তারা তখনই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে যখন সম্পূর্ণরূপে আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে। এজন্য নিজেরাই নিজেদের ওপর পরীক্ষা চালিয়েছিল। অরেঞ্জ কাউন্টির মোদজেস্কা ক্যানিয়ন দ্বীপে তারা নিজেরাই ফসল ফলানো, কাপড় তৈরি, নিজেদের বাড়ি নির্মাণ এবং সন্তান প্রসব করানোর প্রক্রিয়া শিখতে শুরু করে। কিন্তু তাদের বানানো অস্থায়ী গির্জায় আগুন লাগায় অবশেষে এই কাজ পরিত্যাগ করতে হয়।

ব্রাদারহুডের চিন্তার মূলে ছিল ধর্ম। নিজেদের ‘মুরিদ’ (ডিসাইপল) বলে পরিচয় দিতেন তারা। এলএসডিকে মনে করতেন ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাওয়ার একমাত্র জানালা, সজ্ঞার দরজা খোলার একমাত্র চাবি। অ্যালান জিন্সবার্গের কবিতা এবং জেফারসন এয়ারপ্লেন ও দ্য গ্রেটফুল ডেডের সঙ্গীতকে এক্ষেত্রে প্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নিজেদের বানানো এলএসডি ‘অরেনঞ্জ সানশাইন’ বিনামূল্যে বিতরণ করতো ব্রাদারহুড সদস্যরা। এর জন্য তহবিল সংগ্রহে আফগানিস্তানের ভাং চোরাচালান করতো তারা। করাচি, ইস্তাম্বুল, ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং লন্ডন হয়ে কাবুল ও কান্দাহার থেকে ওই মাদক চোরাচালান করতো সংগঠনটি।

ব্রাদারহুডের সমাবেশে কবি অ্যালান জিন্সবার্গ (বায়ে)
ব্রাদারহুডের সমাবেশে কবি অ্যালান জিন্সবার্গ (বায়ে)

পুলিশ ব্রাদারহুড সদস্যদের নাম দিয়েছিল ‘হিপ্পি মাফিয়া’। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে নানান পরিচয় ব্যবহার করতো তারা। তবে এরপরও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ছিল প্রচণ্ড প্রভাব ধরে রাখতে পেরেছিল। দলটির সেলিব্রিটিদের নিয়ে ১৯৭২ সালে ‘রেইনবো ব্রিজ’ নামে একটি আশ্চর্য ধরনের চলচ্চিত্রও তৈরি করা হয়েছিল।

ব্রাদারহুডের অনেকে যিশু, বুদ্ধ, হেনরি ডেভিড থুরো এবং মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল। ভারতীয় দর্শনের প্রভাবও ছিল তাদের মধ্যে। রিচার্ড আলপার্ট নামের এই ব্রাদারহুড সদস্য ভারতে তার গুরুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর নিজের নাম পাল্টে রাখেন ‘রামদাস’, অর্থাৎ, ঈশ্বরের গোলাম। তবে শেষের দিকে এসে নিজেদের আদর্শ থেকে কিছুটা সরে আসে তারা। ১৯৬৮ সালে এক বাৎসরিক ভাষণে ব্রাদারহুড প্রধান লিডন জনসন মাদক বিতরণের নিন্দা করেন। তিনি বলেন, ‘সময় এসেছে যুবকদের কাছে এই দাসত্ব বিক্রি বন্ধ করতে হবে।’ এলএসডিকেই দাসত্ব আখ্যায়িত করেছিলেন জনসন।

পরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। বলা যায়, এটাই ব্রাদারহুডের শেষ যুগ। একই সময়ে আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কোকেইন। এই মাদকটি মূলত সেবনকারীর মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিকতা তৈরি পারতো না। মানুষ যখন এই মাদকে আসক্ত হয়ে ওঠে, তখন থেকে এলএসডির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে যায়।

তবে ওই আন্দোলনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থারও বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। ষাটের দশকের সময়টাকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কালো অধ্যায় বলা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা, ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ নানা কারণে তখন যুবক সম্প্রদায় হতাশ হয়ে পড়ে। যুবকদের তখন বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছিল। এতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অসংখ্য শিক্ষিত যুবক বেকার জীবনযাপন করতে থাকে।

পুলিশের করা ব্রাদারহুডের অপরাধী তালিকা
ব্রাদারহুডের সমাবেশে কবি অ্যালান জিন্সবার্গ (বায়ে)

তখনই যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠে হিপ্পি সংস্কৃতি। শহরের সীমা ছড়িয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম এবং মফস্বলে। এরাই মূলত ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের আরাধক হয়ে ওঠে। অধ্যাত্মিকতা আর স্বজ্ঞাকে অবলম্বন করেই আবর্তিত হয় তাদের চিন্তা চেতনা। যুক্তরাষ্ট্রে রক গানকে জনপ্রিয় করে ‍তুলেছিল তারাই।

অবশ্য আন্দোলনটি মোটেও কোনো সুসমন্বিত আন্দোলন ছিল না। লিখিত কোনো ইশতেহার ছিল না। ছিল না কোনো কেন্দ্রিয় নেতৃত্ব। ছিল কেবল পরিবর্তনের জন্য হাহাকার। ষাটের দশকের শুরুতে সংগীত, সাইকোঅ্যাকটিভ মাদক, অবাধ যৌনতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সানফ্রান্সিসকো। ওই একই সময় হিপ্পিরা নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, ফিলাডেলফিয়াসহ আরো কিছু মার্কিন শহরে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। ফলে হিপ্পি দর্শন সম্পর্কে মানুষের একটা ধারণা তৈরি হয়।

এদিকে ওই আন্দোলনের ৫০ বছর পরে এসে এখন সেই এলএসডি মাদকের উপকারীতার কথাও বর্ণনা করছেন অনেক গবেষক। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সম্প্রতি জানিয়েছেন, ক্যান্সার রোগ নিরাময়ে নাকি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এলএসডি।

উইকিপেডিয়া, বিবিসি, টাইম ম্যাগাজিন অবলম্বনে