Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (তৃতীয় পর্ব)

শুধু এশিয়া নয়, সারাবিশ্বে শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া নেতৃস্থানীয়। সেরা শিক্ষাব্যবস্থার র‍্যাংকিংগুলোতে সেরা পাঁচে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান এখন নিয়মিত ব্যাপার। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, কিংবা সাহিত্য সবক্ষেত্রে কোরিয়ানদের অগ্রগতি ছিলো অনেকটাই মিরাকল। মিরাকলের পিছনে যার বিশেষ ভূমিকা তা হলো তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বাংলা টেলিগ্রাফে নিয়মিত লিখছেন রিদওয়ানুল মসরুর। আজ প্রকাশিত হলো তার  তৃতীয় পর্ব।

জাপানি শাসনামলে একটি স্কুলের চিত্র

১৯১০ – ১৯৫১: জাপানি উপনিবেশকালীন শিক্ষা এবং কোরিয়ান শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা

chardike-ad

বিংশ শতাব্দী দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল অধ্যায় – ঠিক ইতিহাস লিখে পোষাবে না। এ শতাব্দীর শুরুতেই জাপানি উপনিবেশ এর ফলে কোরিয়ার হাজার বছরের (কোরীয় ও জোসন শাসনামলে) তিল তিল করে শক্ত হওয়া শিক্ষার ভিত নড়ে ওঠে, তেমনি শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের মুখে পড়ে মার্কিন প্রগতিশীল শিক্ষাদর্শনের প্রভাবে।

১৯১০ এ কোরিয়া যখন জাপানি শাসনের অধীনে আসে, কোরিয়ার দেশীয় শিক্ষাক্ষেত্রে নেমে আসে বিপর্যয়। জাপানি শাসকেরা কোরিয়াকে আজীবন পদানত করে রাখতে জোসন আমলের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে জারি করে জোসন এডুকেশন ডিক্রি এবং প্রাইভেট স্কুল রেগুলেশন। সেসময়ে বোত্তুং স্কুল (보통학교) (শিক্ষাকাল ছিলো তিন-চার বছরের) ছিলো প্রাথমিক বিদ্যালয় সমমানের, খোদোং বোত্তুং স্কুল (고등보통학교-শিক্ষাকাল ছিলো চার বছরের) ছিলো মাধ্যমিক সমমানের, শিরপ স্কুল (실업학교-শিক্ষাকাল ছিলো দুই-তিন বছরের) এবং গানি শিরপ (간이실업학교) (সময়সীমা অনির্ধারিত) ছিলো বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য, জনমুন স্কুল (전문학교) ছিলো উচ্চশিক্ষার জন্য। সে সময়ের শিক্ষায় জাপানীজ ভাষা, সংস্কৃতি পড়া বাধ্যতামূলক ছিলো।সেসময় ৩০ শতাংশের অধিক ছিলো জাপানিজ শিক্ষক। তথাপিও কোরিয়ার পাবলিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা যেমন দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়, তেমনি দারুণভাবে বেড়ে যায় ভর্তির হার ও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। সেসময়ে মেয়েদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় ছিলো এবং সেসকল বিদ্যালয়ে প্রচুর মেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলো। বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহ কে নিয়ন্ত্রণ (বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, প্রধান ও অন্যান্য শিক্ষক নিয়োগ, টেক্সটবই ইত্যাদি বাধ্যতামূলভাবে নিয়ন্ত্রিত হত জাপানি প্রশাসন দ্বারা) করার জন্য প্রাইভেট স্কুল রেগুলেশন কড়াভাবে অনুশীলিত হত।

education in korea

জাপানিরা কোরিয়ান জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং পদানত রাখতে কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন আমূল বদলে ফেলে তেমনি জাপানিদের সকল বড় ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পদে নিজেদের রেখে শিল্পে উন্নত জাপান এর জন্য কোরিয়ানদের দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তুলতে মৌলিক শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটায়। কোরিয়ান শ্রমিক নির্ভর শিল্পের প্রসার ঘটাতে কোরিয়াতে গড়ে তোলে প্রচুর কল-কারখানা (যদিও সেসবের বেশিরভাগই বর্তমান উত্তর কোরিয়ার মধ্যে পড়েছে)।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে কোরিয়ায় জাপানি শাসনের অবসান ঘটে এবং সেই সাথে কোরিয়া বিভক্ত হয়ে হয় দক্ষিণ কোরিয়া (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে) এবং উত্তর কোরিয়া (সোভিয়েত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে)। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সময়ে দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন নিয়ন্ত্রণে ছিলো। সে সময় এবং এর পরের তিন বছর (১৯৪৯ থেকে ১৯৫১) দক্ষিণ কোরিয়ার যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দেয়। কোরিয়ায় সেসময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতির অন্যতম কারণ হলো মার্কিন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। এর পেছনে লক্ষ্য ছিলো দুটো – প্রথমত, দক্ষিণ কোরিয়াকে জাপানি সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক অনুশীলনের আওতামুক্ত করে এবং কোরিয়ান সংস্কৃতির পুনরুত্থানের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক (ভয় ছিলো উত্তর কোরিয়ার প্রভাবে সমাজতন্ত্রের আগ্রাসনের) রাষ্ট্র গঠন।

দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশ্বে একটি উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করার জন্য তরুণদের দক্ষতামূখী ও সমাজগঠনমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা। যেহেতু, পশ্চিমা বিশ্ব শিক্ষাকে জাতিগঠন ও গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে দেখে, কাজেই শিক্ষাকে তারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলো। যদিও মার্কিন নিয়ন্ত্রিত সরকারের এসকল অবদান বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হয়েছে। তথাপিও আমেরিকার প্রগতিশীল শিক্ষার ধারণা দক্ষিণ কোরিয়ায় কোরিয়ান ভাষা নির্ভর এবং কোরিয়ান সংস্কৃতি (তথা জাতিগত পরিচয়মুখী) শিক্ষার প্রচলন ঘটিয়েছে। তবে এ সময়ের অন্যতম বড় অর্জন হলো, জাপানি শাসনের অবসানের পরপরই শিক্ষার যে প্রবল চাহিদা সৃষ্টি হয় তা এই সরকার অনেকাংশেই মেটাতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি, দক্ষতামূখী শিক্ষার ব্যবস্থা (প্রাথমিক শিক্ষা পরবর্তী পর্যায়ে) এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষাধারা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভিত্তিক উচ্চশিক্ষায় ফেরার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এসময়ের অন্যতম বড় পরিবর্তন হলো – শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমেরিকান শিক্ষা কাঠামো অনুযায়ী সাজানো (যেমন, ৬-৩-৩-৪ বছর মেয়াদী যথাক্রমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা চালু করা) এবং বিদ্যালয়সমূহের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি আমেরিকার মত রূপ দেওয়া। কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক সরকার আমেরিকান প্রগতিবাদী শিক্ষাবিদ জন ডিউই শিক্ষাদর্শনের (আত্মনির্ভরতা অর্জন ও দায়িত্বশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সকলের জন্য সমতাভিত্তিক শিক্ষা) ভিত্তিতে যে ‘নিউ এডুকেশন মুভমেন্ট’ (সা খিইয়ুক উনদং) এর পত্তন ঘটায়, দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার পরবর্তী বিকাশে এর অবদান অপরিসীম। যদিও সে অতি স্বল্প সময়ে (তিন বছরে) কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক সরকার এর উদ্যোগে কোরিয়ান ন্যাশনাল কমিটি অন এডুকেশনাল প্ল্যানিং এর প্রস্তাবিত শিক্ষা সংস্কার পরিকল্পনার স্বল্পই বাস্তবায়িত হয়েছে এবং জাপানি আমলের কেন্দ্রীভূত ও স্বেচ্ছাচারী প্রশাসনিক অনুশীলনের তেমন পরিবর্তন সাধিত হয় নি তথাপিও এই শিক্ষাদর্শনগত ও ভাবনা বিকশিত হয়েছে পরবর্তী সময়ের কোরিয়ার বিভিন্ন শিক্ষা সংস্কারে।

আমেরিকার প্রগতিশীল ধারণা অনুযায়ী আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা হবে পুরোপুরি বিকেন্দ্রীভূত এবং স্থানীয় জনসাধারণ এর চাহিদা ও ভাবনা নির্ভর করে পরিচালিত হবে বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। দক্ষিণ কোরিয়ায় পূর্বে প্রচলিত পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত ও কঠোর প্রশাসনিক নিয়মতান্ত্রিক জাপানি ব্যবস্থায় অভ্যস্ত কোরিয়ানদের জন্য এ ধারণা অসম্ভব আধুনিক ছিলো। ফলে তৈরি হয় মতভেদ; সৃষ্টি হয় নানা পর্যায়ে বিরোধিতা ও আন্দোলনের। যদিও জাপানি শাসনের সময়ই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দাবীতে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলো বারবার; আমেরিকান সামরিক সরকারের সময়কালে তা অদম্যভাবে বেড়ে যায়। তবে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এসব বেশিরভাগ আন্দোলন শিক্ষা কে কেন্দ্র করে ছিলো না; বরং ছিলো দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীনতা, বাম ও ডান পন্থী এবং জাপানপন্থীদের মধ্যে মতভেদ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর কোরিয়াতে অবস্থান করা নিয়েও ছিলো অসন্তোষ। এসব সংঘাত ও আন্দোলনের কারণে ১৯৪৭ এর প্রথম দিকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ৫৭ টি উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাস। আমেরিকার তিন বছরের শাসনামলে দেশের সে সময়ের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি দারুণ ক্রান্তিকাল পার করে। ছাত্রদের বিক্ষোভ আর প্রতিবাদে মুখর ছিলো তখন ক্যাম্পাস। আর এসবের শুরু সেসময়ের অন্যতম সুপরিচিত শিক্ষাব্যক্তিত্ব চ্যাং ই-উক, যিনি জাপানি অটোমোবাইল কোম্পানিতে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন জাপানি শাসনামলে, কে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান করার কারণে। আমেরিকার যে কোন মূল্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় সমাজতন্ত্রের বিকাশ রুদ্ধ করে দেশটিকে গণতান্ত্রিক করার প্রচেষ্টা এবং সে কারণে অনেক অতীতে জাপানের সুদৃষ্টি পাওয়া ব্যক্তিকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো থেকেই এই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের উৎপত্তি। যদিও সেসময়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রয়োজনমাফিক যোগ্য লোকের অভাব প্রকট ছিলো এবং আমেরিকা জাপানের হঠাৎ আত্মসমর্পণে খানিকটা বিপদেই পড়ে গিয়েছিলো এমন এক দেশের দায়িত্ব নিয়ে যে সমাজ-সংস্কৃতিকে তারা ভালোমতো বোঝে না। এ কারণেই আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ কোরিয়ায় যতটা পরিকল্পনা হয়েছিলো তার সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছিলো; স্বল্পই পরিবর্তিত হয়েছিলো জাপানের রেখে যাওয়া প্রশাসনিক কাঠামো।

১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের আত্মসমর্পণের পরপরই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় চারশত শিক্ষক একত্র হয় দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতান্ত্রিক শিক্ষাধারা চালু করার লক্ষ্য নিয়ে। ১৯৪৬ এর ফেব্রুয়ারিতে এই দল ও অন্যান্য দল মিলে সৃষ্টি করেন কোরিয়ান টিচার্স ফেডারেশন যা পরবর্তী সময়ে উত্তর কোরিয়া ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক সরকার শিক্ষকদের সব ধরণের দল সৃষ্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এধরণের উদ্যোগ কোরিয়ার মার্কিন শাসনের বিরুদ্ধে দারুণ জনমত তৈরি করে। ফলস্বরূপ আলাদা দক্ষিণ কোরিয়ান সরকার সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়। এরই মধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায় শিক্ষাক্ষেত্রে। ১৯৪৬ এর শুরুর দিকে আমেরিকান শিক্ষা ব্যুরো, আমেরিকান সেনা অফিসার এবং কোরিয়ান শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের গঠিত হয় কোরিয়ান কাউন্সিল অন এডুকেশনাল এইড ফ্রম আমেরিকা। এই কাউন্সিল সুপারিশ করে ১০০ জন আমেরিকান শিক্ষককে কোরিয়ায় পাঠানোর জন্য যারা কোরিয়ান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবে, ১০০ জন কোরিয়ান শিক্ষক এবং ৩০০ শিক্ষার্থী কে আমেরিকায় পাঠানোর জন্য যারা প্রশিক্ষিত হয়ে কোরিয়ায় ফিরে শিক্ষক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিতে সক্ষম হবে। এর ফলস্বরূপ ১৯৪৮ সালে সউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় টিচার ট্রেনিং সেন্টার। জাপানি উপনিবেশ থেকে মুক্ত হবার পর দক্ষিণ কোরিয়ায় যে শিক্ষার জোয়ার শুরু হয় তাতে করে বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ে প্রায় পাঁচগুণ।

১৯৪৫ এ সমগ্র কোরিয়ার মোট ১৯ টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কেবল ১ টি ছিলো দক্ষিণ কোরিয়ায় যেখানে ৩০০০ এর এর মত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতো। ১৯৪৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ২৯ টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ২০৫৪৫ এ। তবে শিক্ষার এই জোয়ার একদিকে যেমন পুরো জাতিকে উন্নতির পথে হাঁটার নতুন প্রেরণা যোগায়, দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষা সামগ্রীর অভাব সেই অবস্থাকে করে তোলে ভীষণ কঠিন। আগের প্রায় সব টেক্সট বইই ছিলো জাপানি ভাষায়; কাজেই একদিকে যেমন কোরিয়ান ভাষায় টেক্সট বই লেখার জন্য শুরু হয় সংগ্রাম অন্যদিকে সেসব বই ছাপানোর কাগজের অভাব দেখা দেয় প্রকটভাবে। জাপানিরা আত্মসমর্পণের পর বেশিরভাগ কলকারখানাই অচল হয়ে পড়ে। কোরিয়ানরা এসব কারখানায় কেবল শ্রমিক হিসেবে ছিলো; মধ্য ও উচ্চ পদে ছিলো জাপানিরা। আবার বেশিরভাগ কারখানাও ছিলো নতুন হওয়া উত্তর কোরিয়া অংশে; বিশেষত প্রায় সব কাগজ তৈরির কারখানা ছিলো উত্তরভাগে। এমতাবস্থায়, সেই স্বল্প সম্পদ ব্যবহার করে আকাশচুম্বী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কোরিয়ানরা আমেরিকান সাহায্যে ভর করে ১৯৪৫ এর সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রায় এক কোটি ত্রিশ লক্ষ বই ছাপা ও বিতরণে সক্ষম হয়। এসব বই যদিও খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে লেখা এবং বেশিরভাগই পূর্বের জাপানি বই এবং আমেরিকান বই সমূহ থেকে লেখা হয়। এই সফলতায় দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকান সামরিক সরকারের যতটা না ভূমিকা ছিলো; তার হাজারগুণ ভূমিকা ছিলো তৎকালীন কোরিয়ান শিক্ষিত সমাজের। আর এরকম কিছু ঘটনাই সাহস যোগায় কোরিয়ানদের মধ্যে – নিজেদের মত করে শিক্ষা ব্যবস্থা সাজাতে।

আমেরিকার সামরিক শাসনের অবসানের পর, ১৯৪৮ সালে ১০ ই মে দক্ষিণ কোরিয়ায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে এবং ১৯৪৮ সালের ১৫ অগাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় রিপাবলিক অব কোরিয়া যাকে আমরা দক্ষিণ কোরিয়া নামে চিনি। নতুন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী হন আন হো-সাং এবং তার প্রথম মিশন ছিল ১৯৪৯ এর মধ্যে শরতকালের (অটাম/জুন) পূর্বেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি প্রস্তুত করা। নতুন শিক্ষা সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১৯৪৮ – ১৯৪৯ এর মধ্যে অনেকগুলো মিটিং হয়েছিলো যার ফলস্বরূপ পাক নাক-চুন এবং ও’ছন সক এর মত প্রথিতযশা শিক্ষাবিদের নিয়ে শিক্ষা আইন প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি আমেরিকান অনেক প্রস্তাবনা (যেমন – শিক্ষা বছর ৬-৩-৩-৪, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত এক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা) এবং প্রগতিশীল শিক্ষাভাবনা যেমন রাখে, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের বদলে কেন্দ্রীভূত এবং কঠোর নিয়মে নিয়ন্ত্রিত করে গড়ে তোলে। এর ফলে, দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা পরিকল্পনায় একদিকে ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য এবং প্রগতিশীল শিক্ষাভাবনার সংমিশ্রণ যেমন ঘটে, তেমনি সংমিশ্রণ ঘটে কনফুসিয়ানিজম এবং জন ডিউয়ি এর শিক্ষা দর্শনের। তবে সেই পরিকল্পনা সহজেই গৃহীত হয় নি। পূর্বে প্রচলিত জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রস্তাবিত আমেরিকান মডেল, কনফুসিয়ান শিক্ষা ধারনা, প্রাচীন কোরিয়ান শিক্ষা ঐতিহ্য, প্রগতিশীল শিক্ষা ভাবনা – সব মিলিয়ে জট পাকিয়ে যায়। মন্ত্রীসভা, শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ নিয়ে বারংবার তর্ক-বিতর্ক চলে এবং খসড়া শিক্ষা আইন সংশোধিত হয় বেশ ক’বার। অবশেষে প্রায় উনিশ মাস পর, প্রাথমিক খসড়ার বেশিরভাগ ভাবনাই টিকে যায়। আর সেই শিক্ষা আইনের বাস্তবায়ন শুরু হতে হতে ১৯৫০ সালের ২৫ শে জুনে শুরু হয় দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ।

দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা এর অন্যান্য পর্ব:
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (প্রথম পর্ব)
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (দ্বিতীয় পর্ব)
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (চতুর্থ পর্ব)
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (শেষ পর্ব)

redowan