Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিপর্যয় কাটার লক্ষণ নেই প্রবাসী আয়ে

িিনুেরেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়কে আখ্যায়িত করা হয় দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ হিসেবে। অথচ দুই অর্থবছর ধরে দেশে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছর এসে এ খাতে বিপর্যয় আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছর দেশে রেমিট্যান্স আয় কমেছিল আড়াই শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) প্রবাসী আয় হ্রাস পেয়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৮১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯৭৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে ১৬৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা প্রায় ১৭ শতাংশ।

chardike-ad

এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছর দেশে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ ডলার ও ২০১৪-১৫ অর্থবছর ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। সে হিসাবে গত বছর দেশে রেমিট্যান্স কমেছিল আড়াই শতাংশ।

বছরের প্রথম দুই মাসের ধারাবাহিকতায় চলতি মাসেও দেশে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমেছে।  মার্চের প্রথম ২৪ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৮৫ কোটি ৮২ লাখ ডলার। অথচ গত বছরের মার্চে রেমিট্যান্স এসেছিল ১২৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৫ সালের মার্চে এর পরিমাণ ছিল ১৩৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বণিক বার্তাকে বলেন, প্রবাসী আয় হলো আমাদের দেশের লাইফলাইন। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের আরো বহু বছর প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু দুুই বছর ধরে দেশে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমছে ধারাবাহিকভাবে। এটি দেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। কয়েক বছর ধরেই প্রবাসে আমাদের শ্রমিক সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তার পরও রেমিট্যান্স কমে যাওয়াটা মোটেই প্রত্যাশিত নয়। এছাড়া রেমিট্যান্সের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে প্রবেশ করায় অর্থ পাচারও বেড়েছে। এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ভবিষ্যতে আরো নিম্নগামী হবে।

চলতি অর্থবছর রেমিট্যান্সপ্রবাহ সবচেয়ে বেশি কমেছে বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৯০৭ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্র্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৪৬৫ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।

এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছর বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে মাসিক গড় রেমিট্যান্সপ্রবাহ ছিল ৭৬ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। তিন বছরের ব্যবধানে সেখান থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৮ কোটি ২০ লাখ ডলারে।

এ সময় সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স কমেছে সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে। ২০১২-১৩ অর্থবছর সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছিলেন ৩৮২ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমে গত অর্থবছর তা নেমে আসে ২৯৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এসে দাঁড়ায় মাত্র ১৪৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।

দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও রেমিট্যান্স কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত অর্থবছর দেশটি থেকে ২৭১ কোটি ১৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এলেও চলতি অর্থবছরের আট মাসে আমিরাত থেকে এসেছে ১৩২ কোটি ৮৭ লাখ ডলার।

তৃতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছর দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৪২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।

এছাড়া চার বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে কমেছে যুক্তরাজ্য থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণও। গত অর্থবছর দেশটি থেকে ৮৬ কোটি ৩২ লাখ ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এলেও চলতি অর্থবছরের আট মাসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪৭ কোটি ২৪ লাখ ডলারে। মূলত ব্রেক্সিটের প্রভাবে ব্রিটিশ পাউন্ডের অবমূল্যায়ন ঘটায় দেশটি থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো অন্য শ্রমবাজারগুলো থেকেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে।

প্রবাসী আয়ে বড় বিপর্যয়ের কারণে রাষ্ট্রের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ২৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। সেখান চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসে তা রূপান্তর হয়েছে ৭৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার ঘাটতিতে। মূলত রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয় চলতি হিসাবের ভারসাম্য নেতিবাচক স্তরে চলে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে দ্রুত উত্তরণ না ঘটলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

প্রবাসী আয়ে ভাটার টান সৃষ্টি হওয়ায় গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খাতের আয়কে ইতিবাচক ধারায় নিয়ে আসার জন্য এরই মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া, মানি লন্ডারিং বন্ধে বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা চাওয়াসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলও এরই মধ্যে দেশের প্রধান শ্রমবাজারগুলো ঘুরে এসেছে। এর পরও প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, প্রবাসী আয়কে ইতিবাচক ধারায় নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের পরিদর্শক দল এরই মধ্যে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বেশকিছু দেশ ঘুরে এসেছে। মূলত বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের আয় অনেক কমে গেছে। সেসঙ্গে খরচ বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকরাও দেশে অর্থ পাঠাতে পারছেন কম। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় দেশে টাকা আসার কিছু ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশে প্রবাসী আয় কমে যাওয়াটা আমাদের জন্য কষ্টের।

এ প্রসঙ্গে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ার অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, পাউন্ড, রিংগিতসহ বিভিন্ন মুদ্রার মূল্যমান কমে যাওয়াটা রেমিট্যান্সের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় বিদেশী মুদ্রার মূল্যমান কমেছিল। কিন্তু সে সময় আমাদের দেশের রেমিট্যান্সে এতটা বিপর্যয়  দেখা দেয়নি। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রধান শ্রমবাজারের দেশগুলোয় রেডশোর আয়োজন করে বৈধ পন্থায় রেমিট্যান্স পাঠাতে শ্রমিকদের উত্সাহিত করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বৈধ পন্থায় রেমিট্যান্স পাঠালে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, প্রতারক চক্রের হাতে পড়ে দেশে দেশে বাংলাদেশী শ্রমিকরা চাকরি হারাচ্ছেন, আর্থিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেশী প্রতারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সেসঙ্গে দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বিদেশে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পাশেও দাঁড়াতে হবে।