Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বেহাল শাহজালাল বিমানবন্দর

      বিমানবন্দরে কার্গোর বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে কোটি টাকার মালামাল। ইমিগ্রেশনের ভিতরে বিড়ালের দৌড়ঝাঁপ 

চরম বিশৃঙ্খলায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যত্রতত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইঁদুর-বিড়াল। বিমানবন্দরের ভিতরে যাত্রীরা নিয়মিতই দেখেন ইঁদুর-বিড়ালের খেলার দৃশ্য। মশা-মাছির উৎপাত তো আছেই। পণ্য খালাস না হওয়ায় কয়েক শ কোটি টাকার মালামাল বিমানবন্দরের কার্গো শাখায় খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে দিনের পর দিন। বিমান ভেড়াতেও সমস্যা হয়। লাগেজ পেতে বিড়ম্বনার শেষ নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যখন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিটের মধ্যে লাগেজ পাওয়া যায়, সেখানে শাহজালালে মিনিট পেরিয়ে চলে যায় ঘণ্টা। লাগেজ খোয়া যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া বিমানে ওঠার আগে দেহতল্লাশির নামে চলে যাত্রী হয়রানি। সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয় যাদের রেমিট্যান্সে চলে বাংলাদেশ, সেই শ্রমজীবীদের। বিমানের ইমিগ্রেশনের ভিতরও মানি এক্সচেঞ্জের নামে চলে আরেক বিড়ম্বনা। এ ব্যাপারে সিভিল অ্যাভিয়েশন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রায় অচল হয়ে পড়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরটি। এ প্রসঙ্গে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগেও বিমানের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসেছি। নিজেও ঘুরেফিরে নানা অভিযোগ খতিয়ে দেখেছি। কিছু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন ছিল। সেগুলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, দুই সপ্তাহের মধ্যেই অন্তত কার্গোর সমস্যা নিরসন হবে। ’ বিমানবন্দরে মশার বিড়াল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মশা তাড়ানো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তার পরও আমরা মশা মারার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছি। লাইটিং বাড়ানো হয়েছে। এর বাইরেও চেষ্টা অব্যাহত হয়েছে। ’ ইঁদুর-বিড়াল খেলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা পুরনো বিমানবন্দর। এগুলো তাড়ানো মুশকিল। কঠিন কাজ। ’ যাত্রীদের অভিযোগ, মাঝেমধ্যেই নষ্ট হয়ে যায় স্ক্যানিং মেশিন। পুরনো ধাঁচের মেশিন কখনো বসে যায়। বিদ্যুৎও চলে যায়। ট্রলি খুঁজে পেতেও হয়রান হতে হয়। তবে বকশিশ আদায়ের জন্য কেউ যেন পিছিয়ে থাকতে চান না। বিমানবন্দরে যাত্রী পরিবহনের যেসব ট্যাক্সি থাকে তারা আদায় করে কয়েক গুণ ভাড়া। বিমানবন্দরজুড়ে প্রতারকের ভিড়ও লেগেই আছে। বিমানবন্দরে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে বেশ কিছু দিন ধরেই হযরত শাহজাহাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ব্রিজে চরম বিশৃঙ্খলা। অব্যবস্থাপনা এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, উত্তর পাশে বোর্ডিং ব্রিজ পর্যন্ত মালামাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেখানে সেখানে পড়ে আছে। এতে বিমানে ওঠানামায় যাত্রীদেরও নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিমান ভিড়তেও সমস্যা হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে মালামাল কার্গো ব্রিজে বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে আছে। কার্গো বিমানের মালামালগুলো খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। সময়মতো মালামাল হ্যান্ডলিং হচ্ছে না। মামামাল বেড়ে যাওয়ায় বোর্ডিং ব্রিজের সামনেও এখন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানেও বিশৃঙ্খলভাবে কার্গোর মালামাল পড়ে থাকতে দেখা যায়। এতে যাত্রীদের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, সিভিল অ্যাভিয়েশন, কাস্টমস, বিমান এবং নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও তাদের যথাযথভাবে মনিটরিং না করায় এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। গত ১৫-২০ দিনে আমদানি ও রপ্তানি শাখায় কয়েক হাজার কোটি টাকার মালামাল আটক পড়ে আছে। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। এদিকে শাহজালালে লাগেজ হ্যান্ডলিং নিয়ে সেই পুরনো সমস্যার এখনো কোনো সমাধান হয়নি। এ নিয়ে যাত্রীদের নানা অভিযোগ থাকলেও নিয়ম-শৃঙ্খলায় আসতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সারা দুনিয়ায় বিজনেস ক্লাসের যাত্রীরা আগে লাগেজ পেলেও বাংলাদেশে এর উল্টো। বিজনেস ক্লাসের যাত্রীরা তাদের মালামাল পাচ্ছেন অনেক বিলম্বে। সে ক্ষেত্রেও ওই যাত্রীরা নানামুখী হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সাধারণ যাত্রীরা কর্মকর্তাদের নির্দয় আচরণে প্রতিদিনই নানাভাবে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন। সম্প্রতি মালয়েশিয়া থেকে আসা শামীম আহমেদ নামে বিজনেস ক্লাসের এক যাত্রী অভিযোগ করেন, তিনি আধঘণ্টা ধরে কনভেয়ার বেল্টে দাঁড়ানো। কিন্তু লাগেজ আসেনি। বাধ্য হয়েই ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বসতে হলো কাস্টমস লাগোয়া পাশের সারিবদ্ধ চেয়ারে। মুহূর্তেই ভন ভন করে মশার হানা। আবার চারপাশে তাকালেই দেখা যায় সাদা-কালো বিড়ালের দৌড়ঝাঁপ। এ নিয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘লাগেজ পেতে দেরি হয় এটা ঠিক নয়। আধঘন্টা লাগেজ পেতে সময় লাগবেই। কারণ, বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইমিগ্রেশন থেকে কনভেয়ার বেল্ট দূরে। তারা হেঁটে হেঁটে অনেক সময় পর গিয়েই লাগেজ পান। আমাদের ইমিগ্রেশন আর কনভেয়ার বেল্ট কাছাকাছি। সবাই দ্রুত চলে যান। এজন্যই মনে হয় সময় একটু বেশি লাগছে। তার পরও এটাকে আরও ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করছি। ’ সূত্রমতে, নানা অনিয়মের মধ্যে চলছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ শাখার কর্মকাণ্ড। ব্রিটিশ নিরাপত্তা সংস্থা রেডলাইনকে দায়িত্ব দেওয়ার পর অনিয়মের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। তাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পণ্য স্ক্যানিং করার নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করা হচ্ছে। এমনকি পণ্য পাঠানোতেও হয়রান হতে হচ্ছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা, দুর্নীতি-লুটপাট দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির গ্রেড উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল ছাড়াই কার্গো শাখার কাজ পরিচালনা নিয়ে নানা প্রশ্ন্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।

chardike-ad

যাত্রীসাধারণের অভিযোগ, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালালে যাত্রীসেবার মান ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে। যাত্রীদের সেবা দেওয়ার দায়িত্ব যাদের, তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই উল্টো হয়রানি করছেন যাত্রীদের। দায়িত্ব পালন আর সেবার নামে হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকাকড়িসহ মূল্যবান সামগ্রী। রক্ষকরাই এখন ভক্ষকে রূপ নিয়েছেন। যত বেশি হয়রানি তত বেশি টাকা, এটা এখন এই বিমানবন্দরে পরিচিত স্লোগান। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানি বাদেও রয়েছে ভিন্ন ধরনের হয়রানি। একসঙ্গে কয়েকটি ফ্লাইট ওঠানামা করলে যেন ভেঙে পড়তে চায় পুরো বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় সর্বত্রই। সূত্রমতে, ইমিগ্রেশনের কম্পিউটার ও এর সার্ভার আধুনিক নয়। বিদ্যুতের ভোল্টেজের ওঠানামায় সার্ভার বসে যায়। কাস্টমস-ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যথেষ্ট দক্ষ নন। সব মিলিয়ে কাজ চলে মন্থর গতিতে। যাত্রীদের প্রতীক্ষার প্রহর হয় দীর্ঘ। মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) রিডারের অভাবে পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাজগপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সময় লাগে প্রচুর। সম্প্রতি দিল্লিফেরত এক যাত্রী বলেন, দিল্লির কাস্টমস-ইমিগ্রেশন কাগজপত্র ঠিক করতে জনপ্রতি সময় নেয় মাত্র এক থেকে পাঁচ মিনিট। আর একই কাজ করতে এখানে লাগল কমপক্ষে এক ঘণ্টা। এখানে কেউই যাত্রীসেবার জন্য নেই। ট্রলিও খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই অপেক্ষায় থাকেন বকশিশ আদায়ের জন্য। সিভিল অ্যাভিয়েশনের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে স্বীকার করেন নানা বিশৃঙ্খলার কথা। তবে তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দরের স্ক্যানিং তল্লাশির সক্ষমতা বাড়ানোসহ যাত্রী ও কার্গোর নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশের স্ক্যানিং টেকনোলজির আলোকে আমরা সেদিকে যাচ্ছি। কার্গো হাউসে অনিয়ম হচ্ছে তাও সত্য। এর পরও আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। ’