Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আলী হোসেন

ali-hossenএক ক্লাশে তিন বছর থাকার অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে। কিন্তু এক বছরে তিন ক্লাশ পার করার কথা হয়তো আমরা ভাবতেই পারি না। যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য, অসম্ভবও বটে। এমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আলী হোসেন (২৭)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে পড়ুয়া আলী হোসেনের জীবনে যেমন কম সময়ে অনেক পথ টপকানোর যেমন গল্প আছে, সাফল্য আছে। ঠিক তেমন দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে যাওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতারও গল্প আছে।

chardike-ad

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আলী হোসেন জীবনের শুরুটা অন্য দশটি শিশুর মতো ছিল না। জীবনের শুরুটা ছিল পুরোপুরি ব্যতিক্রম। অনেকটা চোখ ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোট ছোট চোখ, মিন মিন করে তাকাতেন। দূর থেকে বোঝাই যেত না যে চোখ আছে। প্রথমদিকে একটু একটু দেখতে পেতেন, পরে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান।

যখন তার সাত-আট বছর বয়স, তখন তিনি বুঝতে পারেন, তিনি সমাজের অন্য দশ জনের চেয়ে আলাদা। বাল্যবন্ধুরা মক্তবে যাচ্ছেন, স্কুলে যাচ্ছেন, ফিরে এসে খেলছে। তাকে কেউ খেলায় না নেওয়ায়, খুব নিসঙ্গ অনুভব করতেন।

পরিবারের আপন মানুষেরাও তার সঙ্গে অন্য রকম আচরণ করতেন। বাড়িতে মেহমান এলে তাকে লুকিয়ে রাখতেন। যেতে দেওয়া হয়নি বড় ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানেও। সিঙ্গাপুর প্রবাসী বড় ভাই যখন দেশে ফিরতেন, সবার জন্য পোশাক আনতেন নানা রকম জিনিস আনতেন। বঞ্চিত হতেন কেবল আলী হোসেন। যেন পরিবারের একমাত্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুটি পরিবারের জন্য লজ্জার।

আলী হোসেন বলেন, পরিবারের এমন আচরণে খুব রাগ হতো, একা একা বসে কাদঁতাম। কারো সঙ্গে মিশতাম না। কথায় কথায় বাড়ির জিনিস-পত্র ভাঙচুর করতাম। খারাপ মানুষের সঙ্গে খুব মিশতাম, কথায় কথায় মানুষদের গাল-মন্দ করতাম, মারামারি করতাম। এমন আচরণ করতাম যাতে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে খুন করে। কারণ আমি জেনে গেছি আমার জীবন অভিশপ্ত। জীবনের চেয়ে মৃত্যু অনেক ভালো।

একদিন এক অপরিচিত লোক পরামর্শ দিলেন, তুমি যে জীবনে আছো, এটা জীবন নয়। তুমি চাইলে পড়ালেখা করতে পারো, জীবন পাল্টাতে পারো। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখার সুযোগ আছে।

কথাগুলো বেশ মনে ধরলো তার। অন্ধকার আচ্ছন্ন জীবনে আলী যেন আলোর নিশানা খুঁজে ফেলেন। খুঁজতে থাকেন কোথায় আছে ব্রেইল পদ্ধতির স্কুল। পেয়েও গেলেন নিজ এলাকা গাজীপুর জয়দেবপুরের একটি ব্রেইল স্কুলের সন্ধান। নীলয় পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল, ওই স্কুলে কোনো সিট খালি নেই। অনেক অনুরোধের পরে তার অতি আগ্রহ দেখে শিক্ষকেরাও আগ্রহ দেখালেন।

প্রথম তিন মাসে স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ শিখলেন। এবার ব্রেইল শেখার পালা। অন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যেখানে ব্রেইল শিখতে দুই তিন মাস সময় নেয়, সেখানে আলী হোসেন এক রাতে শিখে ফেলেন ব্রেইল। ১৪ বছর বয়সে ভর্তি হলেন ২য় শ্রেণীতে। তখন আরেক সমস্যা দেখা দিল, ক্লাশের সব বাচ্চারা তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তখন জিদ চাপলো যত দ্রুত সম্ভব ওপরের ক্লাশে উঠার।

আলী হোসেন জানান, ২০০৩ সালে নয় মাসেই ২য় ও ৩য় শ্রেণীর ক্লাশের সব পড়া শেষ করেন। ২০০৪ সালে শিক্ষক ভর্তি করিয়ে দেন ৪র্থ শ্রেণীতে। ৪র্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি নিজে নিজেই শেষ করে ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পড়ালেখা। ২০০৫ সালে ৫ম শ্রেণীতে পড়াকালীন শেষ করলেন ৭ম ও ৮ম শ্রেণীতে পড়াশুনা। এ সময় তিনি ইংলিশে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ বেতারের ইংরেজি শিক্ষা কোর্স ‘স্কুল ফাইনাল’ ও ‘ইংলিশ ফর টুডে’ রেকর্ড করে নিয়মিত শুনতেন।

২০০৬ সালে তিনি শিক্ষকদের কাছে বয়না ধরলেন নবম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার। শিক্ষকেরা কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন অন্য স্কুলে ভর্তি হবেন। শিক্ষকেরা পরে তার নবম শ্রেণীতে পড়ার যোগ্যতা যাচাই করে পরীক্ষা নিলেন এবং নবম শ্রেণীতে ভর্তি করালেন। এক বছরেই টপকে গেলেন তিন ক্লাশ। ফলে আলীর একাডেমিক ভাবে পড়া হয়নি ১ম, ৩য়, ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণী।

২০০৮ সালে দিলেন এসএসসি পরীক্ষা বেশ সাফল্যের সঙ্গে পাশও করলেন। পড়া শুরু করেন মিরপুর বাঙলা কলেজে। আলী হোসেন ২০১০ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএইচসি পাশ করেন। এই প্রথম বাংলাদেশে কোনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এসএইচসিতে জিপিএ-৫ পেল।

এই সাফল্য পাল্টে দেয় আলী হোসেনের জীবনের মোড়। যে পরিবারের ও সমাজের মানুষ তাকে অবহেলা করতো, অবাঞ্চিত ভাবতো, তারা সবাই এবার এগিয়ে এলেন আলী হোসেনকে সহযোগিতা করার জন্য।

ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ। এতদিনেও জয়দেবপুরের খুন্দিয়া গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি। আলী হোসেনের দারুন সাফল্যে দল বেঁধে দেখতে আসতে লাগলো গ্রামের মানুষজন। পরিবারও বেশ সাপোর্ট দেন।

২০১৫ সালে তিনি বেশ সাফল্যের সঙ্গেই শেষ করেন অনার্স কোর্স। তবে আলী হোসেন অভিযোগ করেন, শিক্ষকদের গাফলতির কারণে তার প্রথম বছরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বর্তমানে আলী হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত রয়েছেন। থাকেন সূর্যসেন হলের ২৬৬ নম্বর রুমে। ইতিমধ্যে তিনি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় গড়ে তুলেছেন ছাত্র সংগঠন ড্যাসকো।

আলী হোসেন বলেন, আমি যে সমস্যায় পড়েছি অন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যাতে এমন সমস্যায় না পড়েন, তার জন্য কাজ করতে চাই। তিনি বলেন, আমরা পৃথিবী দেখি না, তবে স্বপ্ন দেখি একদিন প্রতিবন্ধীবান্ধব বাংলাদেশ গড়ে তোলার।

৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতির কথাও জানালেন, মেধাবী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আলী হোসেন।

সৌজন্যেঃ রাইজিংবিডি