Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শাহজালাল বিমানবন্দরে পদে পদে হয়রানি

shahjalal-airportনিরাপত্তা, যাত্রীসেবা, কার্গো হ্যান্ডলিং, মাদক ও অস্ত্রের চোরাচালান রোধ—সার্বিক বিষয়েই এক ধরনের ঢিলেমি চলছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আসা-যাওয়ার পথে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে দেশি-বিদেশি যাত্রীরা। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। এমনকি রাতে রানওয়েতে ঠিকমতো বাতি পর্যন্ত জ্বলে না। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদারে নানামুখী পদক্ষেপের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেসবের ফলপ্রসূ প্রয়োগ চোখে পড়ছে না।

ব্যবসায়ী আবদুল খালেক ভূঁইয়া কলকাতা নেতাজি বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন মাত্র ৪০ মিনিটে। আর এখানে ইমিগ্রেশনে তাঁকে ব্যয় করতে হয় এক ঘণ্টার বেশি সময়। পরপর বেল্টের কাছে গিয়ে দেখেন তখনো লাগেজ এসে পৌঁছেনি। সে জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরো প্রায় এক ঘণ্টা। বেল্ট থেকে লাগেজ সংগ্রহ করে গ্রিন চ্যানেলের দিকে এগোতেই কাস্টমস কর্তাদের তোপ। চেকিংয়ের নামে লাগেজ নিয়ে টানাহেঁচড়ায় হয়রানির চূড়ান্ত। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কনকর্স হল দিয়ে ক্যানোপিতে এসে গাড়িতে ওঠার আগে আরেক দফা এপিপিএন সদস্যদের জেরার মুখে পড়লেন তিনি।

chardike-ad

ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানির এটি একটি নমুনা মাত্র। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে শাহজালালে নেমেই যাত্রীদের এমন হয়রানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বৈধ পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকিট নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে কোথাও গিয়ে কোনো রকম অসুবিধা না হলেও শাহজালালে এসে প্রতিটি এজেন্সির হাতে নানামুখী নিগ্রহ আর হয়রানির শিকার হতে হয় তাঁদের। কেন বিদেশ গেছেন, সঙ্গে এত কিছু এনেছেন কেন, এত বড় লাগেজ যখন বহন করছেন তখন আমাদেরও কিছু দিয়ে যান—এমন সব হয়রানি মোকাবেলা করেই তাঁদের বিমানবন্দর থেকে বের হতে হয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের সবকটি বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হচ্ছে। নিরাপত্তার স্বার্থে দর্শনার্থী প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর ইমিগ্রেশন পুলিশকে আরো সতর্ক হতে বলা হয়েছে।

বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য যা যা দরকার সব কিছুই করা হচ্ছে। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। কার্গো সমস্যা নিরসনের চেষ্টা চলছে। রানওয়েতে প্রতিদিনই তল্লাশি করা হয়। আমার কাছে বাতি না জ্বলার অভিযোগ কেউ করেনি। বিষয়টি দেখা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশি-বিদেশি প্রায় ৩০টি বিমান সংস্থা বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করছে এবং ৪৭টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিমান চলাচল চুক্তি রয়েছে। প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করছে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে। কিন্তু বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার না থাকায় যাত্রীবেশী অপরাধীরা সহজেই বাইরে বের হয়ে আসছে।

বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দুর্বল আখ্যায়িত করে সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। তাতে বলা হয়েছে, লোডাররা বিমান থেকে মালামাল নামানোর সময় পাচারের ঘটনা ঘটাচ্ছে। লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শাখায়ও অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে। যাত্রী পরিবহনকে কেন্দ্র করে ট্যাক্সি কম্পানির চালক ও দালালদের হাতে প্রতিনিয়ত হয়রানি হচ্ছেন যাত্রীরা। বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। দর্শনার্থীদের দেহ তল্লাশি হয় না বললেই চলে। এ ছাড়া রানওয়েতেও অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে। রাতে রানওয়ের চারপাশে বাতি জ্বালানোর নিয়ম থাকলেও তা হচ্ছে না। অনেক বাতি ঠিকমতো জ্বলে না। কর্তৃপক্ষেরও সেদিকে নজরদারি নেই। এ অবস্থায় যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ইমিগ্রেশন পুলিশও ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। সম্প্রতি পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজধানীর লেকহেড স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে অভিযুক্ত রেজওয়ান হারুন লন্ডন থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ওই ঘটনার পর তোলপাড় চলছে।

এ প্রসঙ্গে সিএএবির এক কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন সংস্থার (আইকাও) পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে কম্প্রিহেনসিভ সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। আর রানওয়েতে মাঝেমধ্যে দুই-একটি লাইট নষ্ট হয়ে যায়। তবে তা দ্রুতই মেরামত করা হয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ব্রিজে কিছুদিন ধরে চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। মালামাল যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকায় বিমানে ওঠানামায় যাত্রীরা সমস্যায় পড়ছে। বিমান ভিড়তেও সমস্যা হচ্ছে। কার্গো বিমানের মালামালগুলো খোলা আকাশে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে। সময়মতো মালামাল হ্যান্ডলিং হচ্ছে না। একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস, বিমান ও নিরাপত্তাকর্মীদের কাজে সমন্বয়হীনতা এবং তাঁদের যথাযথভাবে মনিটরিং না করায় এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমদানি ও রপ্তানি শাখায় কয়েক হাজার কোটি টাকার মালামাল আটকা পড়ে আছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় আছে ব্যবসায়ীরা।

জানা যায়, নিরাপত্তার নামে বিমানবন্দর সড়কের গোলচত্বরে তল্লাশি শেষে যাত্রীদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। তবে দর্শনার্থীদের প্রবেশে বাধা দিচ্ছে আর্মড পুলিশ। আর্চওয়ে মেশিন স্থাপন করা হলেও সামান্য টাকা হাতে গুঁজে দিলেই ভেতরে যাওয়ার সুযোগ মিলে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ১০০ টাকা দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চেপে ভেতরে চলে যাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশের যোগসাজশেই অটোরিকশার চালকরা এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে বিনা বাধায়। আবার ফুটপাতে ছোট ছোট দোকান বসিয়ে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডও চলছে। আর এসবই চলছে দায়িত্বরত পুলিশকে বিশেষ কায়দায় ম্যানেজ করে।

সূত্র জানায়, বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা চরমে। হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা, দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে বিমানবন্দর কাঙ্ক্ষিত গ্রেডে উন্নীত হতে পারছে না। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, গাড়ি ও দক্ষ জনবল ছাড়াই বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ পরিচালনা নিয়ে নানা প্রশ্ন আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোর। যাত্রী ও বাহকের লাগেজ গায়েবের ঘটনা বিমানকে সবচেয়ে বেশি লজ্জায় ফেলছে। ওই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোডাররা শুধু লাগেজ চুরিই করছে না, অনেক সময় বড় বড় লাগেজ গায়েব করে দিচ্ছে।

বিমানের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নানামুখী অব্যবস্থাপনার কারণে এয়ার কার্গো সিকিউরিটি (এসিসি)-৩ ও রেগুলেশন এজেন্ট (আরএ)-৩ সনদ নবায়নের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এ দুটি সনদ পেতে তিনটি শর্ত বেঁধে দিয়েছে। শর্তগুলো হলো কার্গো কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা জোরদার, নিজস্ব জনবল নিয়োগ ও দক্ষ স্ক্যানিং মেশিন অপারেটর নিয়োগ। কিন্তু এখন পর্যন্ত শর্তগুলো পূরণ হয়নি। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া আন্তর্জাতিক এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) দুটি সনদ নবায়ন হচ্ছে না। অথচ এসিসি-৩ এবং আরএ-৩ সনদবিহীন কোনো বিমানবন্দর থেকে রপ্তানি করা পণ্যসামগ্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে গ্রহণ করা হয় না। ফলে গোটা দেশের রপ্তানি খাতের জন্য তা চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। সনদ দুটি নবায়ন না হলে বিমান বছরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে। অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি।

সূত্র জানায়, অবৈধ পণ্য, অস্ত্র কিংবা মাদকদ্রব্য শনাক্ত করতে শাহজালালে একাধিক স্ক্যানিং মেশিন রয়েছে। কিন্তু সেগুলো ঠিকমতো কাজ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৩ সালে দুটি স্ক্যানিং মেশিন ব্রিটিশ সরকার বিনা মূল্যে দিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, নানামুখী অপতত্পরতা চালানোর সুবিধার্থে মেশিন দুটি অচল করে রাখা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কাস্টমস ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিপিএন সদস্যদের ম্যানেজ করে প্রতিদিন বড় বড় লাগেজ বিনা স্ক্যানিংয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ যাত্রী যারা ওদের চাহিদামতো ঘুষ দিতে রাজি হয় না কেবল তাদের লাগেজ মাঝেমধ্যে স্ক্যান করা হয়। বিমানবন্দরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তা পাস ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই পাস নিয়েও চলছে নানা অনিয়ম-জালিয়াতি। চোলাচালানের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এসব পাস ব্যবহার করছে।

অভিযোগ উঠেছে, শাহজালালে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত নাহিদ ট্রেডার্স গাড়ি দিয়ে সোনা পাচার করছে। পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত এ কে ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে চোরাকারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মচারী ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি ৩৫০ জন কর্মচারীর বিপরীতে নিরাপত্তা পাস নিলেও সেখানে কাজ করছেন মাত্র ১৫০ জন কর্মচারী। অবশিষ্ট পাস বিভিন্ন চোরাচালানি ও দালাল-টাউটদের নামে ইস্যু করে মাসিক ভিত্তিতে মোটা টাকায় ভাড়া দিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।

এ কে ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল খালেক অবশ্য চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, তিনি কোনো চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নন। প্রয়োজনের বেশি নিরাপত্তা পাসও নেননি। তবে বিভিন্ন সময়ে তাঁর কয়েকজন কর্মচারী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সিএএবির নিরাপত্তা শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বন্ধ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন বেসরকারি বিমান সংস্থা থেকে শুরু করে টাকা আত্মসাত্কারী বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নামে শত শত নিরাপত্তা পাস ইস্যু করা হয়েছে। অথচ শাহজালালে তাদের কার্যক্রম অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে তাদের পাস ফেরত নেওয়ার নিয়ম থাকলেও নিরাপত্তা শাখা এ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়।

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ