Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

একজন কালজয়ী নায়ক সালমান শাহ

salman-shahএকজন কালজয়ী নায়ক সালমান শাহ। যিনি তার অভিনয় দক্ষতা ও স্টাইল দিয়ে জয় করে নেন সবার হৃদয়। মাত্র ৪ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে তিনি তৈরী করেছিলেন অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী। এই অল্প সময়ে চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে তিনি আমাদের উপহার দেন ২৭ ছবি। যার মধ্যে ১৪ টি ছবি জুটি বেঁধে করেন শাবনূরের সাথে। তার প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত দিয়ে শুরু করে জীবনের শেষ ছবি পর্যন্ত সকল ছবিই ছিলো ব্যবসা সফল।

১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন এই কালজয়ী নায়ক। তার পূর্ণ নাম শাহারিয়ার চৌধুরী ইমন। চলচ্চিত্রে তিনি সালমান শাহ নামে বেশ জনপ্রিয়। তার মা নীলা চৌধুরী। বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী। তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় খুলনার বয়রা মডেল হাইস্কুল থেকে। ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকার ধানমন্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। পরবর্তীতে তিনি বিকম পাস করে লেখা পড়ার ইতি টানেন।

chardike-ad

প্রথম জীবনে তিনি নাটকের মাধ্যে আত্মপ্রকাশ করেন নিজেকে। ১৯৮৫ সালে তার অভিনিত প্রথম নাটক আকাশ ছোঁয়া দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। এর পর তিনি আরও বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন। এগুলো হলো দেয়াল (১৯৮৫), সব পাখি ঘরে ফিরে (১৯৮৫), সৈকতে সারস (১৯৮৮), পাথর সময় (১৯৯০), ইতিকথা (১৯৯৪), নয়ন (১৯৯৫) এবং স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬)। এর মাঝে বেশ কয়েকটি নাটক ইউটউবেও পাওয়া যায়। এছাড়া বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেন তিনি।

সোহানুর রহমান সোহান এর কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির মাধ্য দিয়ে নিজেকে আত্মপ্রকাশক করেন বড় পর্দায়। এই ছবির প্রথম দিন তার সাথে মৌসুমি ও আগুনের অভিষেক হয়। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ মুক্তির পর সালমান শাহকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক ব্যবসা সফল সিনেমা উপহার দিয়ে চলেন তিনি। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত এই চার বছরে ২৭টি সিনেমায় অভিনয় করেন সালমান শাহ। এগুলো হলো- ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ (১৯৯৩), ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘সুজন সখী’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্নেহ’, ‘প্রেম যুদ্ধ’ (১৯৯৪), ‘কন্যাদান’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আঞ্জুমান’, ‘মহামিলন’, ‘আশা ভালোবাসা’ (১৯৯৫), ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘প্রিয়জন’, ‘তোমাকে চাই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’ (১৯৯৬), ‘প্রেমপিয়াসী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শুধু তুমি’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘বুকের ভেতর আগুন’ (১৯৯৭)। এর মধ্যে প্রিয়জন ছবিতে তাঁর সাথে ছিলেন পরবর্তী সময়ের জনপ্রিয় নায়ক রিয়াজ। সালমান শাহ ‘মন মানে না’ ছবিটির ৫০% কাজ শেষ করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে রিয়াজ কে দিয়ে ছবিটি করানো হয়।

২৭টি সিনেমার ১৪টিতেই সালমানের বিপরীতে অভিনয় করেন শাবনূর। এই সালমান-শাবনূর জুটি বোধহয় বাংলাদেশের সিনেমা জগতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি। তাদের প্রথম ছবি ছিলো ‘তুমি আমার’। এই ছবির পরিচালক জহিরুল হক সালমান শাবনুরকে দিয়ে আরও একটি ছবিতে হাত দিয়েছিলেন যা ছিল খান আতাউর রহমানের কালজয়ী ফোক ছবি ‘সুজন সখী’র রিমেক ‘রঙ্গিন সুজন সখী’। দুর্ভাগ্যবশত জহিরুল হক ছবিটি শেষ করতে পারেননি। শেষ হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরন করেছিলেন। জহিরুল হকের মৃত্যুর পর শাহ আলম কিরন ‘সুজন সখী’ ছবিটির কাজ শেষ করে ছবিটি মুক্তি দেন ১৯৯৪ সালের ১২ আগস্ট ।

পরবর্তীতে মোহাম্মদ হান্নান তার ‘বিক্ষোভ’ ছবিতে রোমান্টিক গল্পের বাহিরে তারুণ্যদীপ্ত প্রতিবাদী চরিত্রে দর্শকদের সামনে নতুন এক সালমানকে হাজির করেন। ‘বিক্ষোভ’ ছবিটি ছিল রোমান্টিক ইমেজের বাহিরে সালমানের ভিন্নধর্মী শ্রেষ্ঠ একটা ছবি যা তাঁর ক্যারিয়ারে আর একটাও নেই । তুমি আমার’ ও ‘বিক্ষোভ’ ছবির সাফল্যের পর সালমান শাবনুর জুটি তখনকার ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।

এছাড়া সালমান শাহের জুটি হয়ে অভিনয় করেছিলেন শাবনাজ, শাহনাজ, লিমা, শিল্পী, শ্যামা, সোনিয়া, বৃষ্টি, সাবরিনা ও কাঞ্চি। কিন্তু এই জুটিগুলো তেমনভাবে দর্শকদের নজর কাড়তে পারেনি। যার ফলে পরিচালকরা সালমান-শাবনূর জুটির উপরেই নির্ভর করতে থাকেন।

ফ্লপ শব্দটি কখনো এই মহানায়ককে স্পর্শও পর্যন্ত করতে পারেনি। তাঁর প্রতিটি সিনেমা দেখার জন্য সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়তো দর্শকরা। তখন অসংখ্য তরুণীর স্বপ্নের পুরুষ এই সালমান শাহ, বলিউডের কোনো নায়ক নয়। সুন্দর চেহারার সাথে অভিনয় ক্ষমতা, ফ্যাশন সচেতনতা, ব্যক্তিত্ব সবকিছু মিলিয়ে এমন উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, যার কাছাকাছি পৌছাতে পারেনি পরবর্তী সময়ের আর কোনো নায়ক।

সালমান যতক্ষণ এফডিসিতে থাকতেন, গেটের বাইরে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় থাকতো তাঁকে একবার দেখার জন্য। বাংলাদেশে এরকম জনপ্রিয়তা আর কোনো নায়কের ভাগ্যে জোটেনি। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস এত এত মানুষের ভালোবাসাও তাঁকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি আমাদের মাঝে।

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। সেদিন ছিলো শুক্রবার। এদেশের সিনেমাপ্রেমীদের জন্য সবচেয়ে দুঃখের দিন। কী এক অভিমানে এইদিনই সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে বিদায় নেন এই মহাতারকা।

মৃত্যুর কয়েকমাস আগে একদিন সালমান শাহ পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলেন। সালমান তাকে বললেন তারা আবার একসাথে কাজ করবেন। সোহান সালমানকে শিডিউল ঠিক করতে বললেন এবং বললেন তিনি একটি গল্প প্রস্তুত করছেন সিনেমার জন্য। সালমান তাঁর শিডিউল ঠিক করেও রেখেছিলেন। কিন্তু সালমানের অকাল প্রয়াণ তা আর হতে দিল না। সোহানুর রহমান সোহানের সাথে সালমান শাহের আর কাজ করা হল না।

মাত্র চার বছরের অভিনয় জীবন তাঁর। এই অল্প সময়ে তৈরী করেছিলেন অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী। তাঁর মৃত্যু লন্ডভন্ড করে দিয়েছিলো তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোর জীবনও। সালমানের দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁর বাবা বলেছিলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী জিনিস বোধহয় পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। পুত্রের মৃত্যুশোক বেশিদিন সইতে পারেননি তিনি। কয়েক বছর পর মারা যান ছেলে হারানোর দুঃখ বুকে নিয়ে।

শোনা যায় প্রায় ২২-২৩ জনের মতো তরুণী আত্মহত্যা পর্যন্ত করে তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে। নজরুল নামে তাঁর একজন বন্ধু ছিলো। সালমান মারা যাওয়ার পর যে শুধু পাগলের মতো এফডিসির সামনে ঘুরে বেড়াতো। ফারুক নামে আরেকজন বন্ধু ছিলো তাঁর। সে-ও কোথাও যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

তাঁর মৃত্যুতে এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে তা আজও পূরণ হয় নি। মরে গিয়েছেন অনেক আগে কিন্তু তিনি এখন বেচে আছেন আমাদের সবার মাঝে । আমাদের ভালবাসার মাঝে ।

সালমান শাহ এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে স্বপ্নের নায়ক হয়ে, ভালোবাসার রাজপুত্র হয়ে। এত বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এদেশের মানুষ সালমানকে ভুলতে পারেনি। মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। আজ ও কানে ভেসে আছে তুমি আমার জান গো বন্ধু অন্তরের অন্তর । আসলেই সালমান শাহ তুমি আছো আমাদের অন্তরে । থাকবে চিরকাল ।