Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যে ঘটনাগুলো লজ্জা দেয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের

malayasia-arest
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশি মানুষ সভ্যতার কোন পর্যায়ে আছে তা নিয়ে আমার আর বিশেষ কোন সন্দেহ নাই। ভূমিকা না করে নিজের কয়েকটা অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরলাম

ঘটনা ১ : এক বাংলাদেশি ভদ্রলোক ফিনল্যান্ড এ আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেন। তিনি কর্ম সূত্রে ইউরোপে এসেছিলেন। দেশি বলে আমার বাবা মা খাতির যত্নের কমতি করলেন না। তিনি দেশে কিছু গিফট কিনে নিয়ে যাবেন বলে আমার বাবা মা কে একটা সুপার শপ এ নিয়ে যেতে বললেন এবং তাই করা হল। তিনি তার মতো করে কেনাকাটা করছেন আর আমরা তার জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ একটা অ্যালার্ম এর মত কী যেন বেজে উঠল পুরো মার্কেট জুড়ে! ব্যাপারখানা কি? ৩ জন পুলিশ সেই ভদ্রলোক কে ধরে নিয়ে এলো আমাদের কাছে! তিনি মনের সুখে ১ প্যাকেট ব্লেড তার পকেটে ভরেছিলেন বিনামূল্যে নিয়ে যাবেন বলে। শপ লিফটিং দণ্ডনীয় অপরাধ। বলা বাহুল্য, বাইরে আমাদের পরিবারের একটা সুনাম আছে বরাবর। এই ঘটনার পর লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা গেলো ৩ ফালি করে!

chardike-ad

ঘটনা ২ : জাপানের ওসাকা শহরের উমেদা ডাউন টাউন এর রাস্তা খুব ব্যস্ত। জেব্রা ক্রসিং এ সবুজ আলো জ্বলে প্রায় ৫ মিনিট পর পর। ৫ মিনিট তো অনেক বেশি সময় আমাদের অপেক্ষার জন্য, তাই না? তাই কতিপয় বাংলাদেশি সবুর না করে সবুজ আলো জ্বলার আগেই এক দৌড়ে রাস্তা পার হল। রাস্তার ওপাশে আমি সহ আরও ৩০-৪০ জন পথচারী অপেক্ষা করছি সবুজ আলোর আশায়। সবাই এই দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত! আমি স্তম্ভিত হলাম না অবশ্য। পরদিন পত্রিকায় সেই কতিপয় বাংলাদেশির ছবি সমেত খবর বেরুলো। যে দেশে অপরাধ হয়না তেমন, সেখানে দৌড়ে লাল বাতিতে রাস্তা পার হওয়াটা একটা বড় খবরই বটে, আর এহেন খবরে দেশের মান কমডে ফ্লাশ হয়ে যায় নিমেষে!

ঘটনা ৩ : আরেকটা রাস্তা পারাপারের গল্প। সিঙ্গাপুর এ ট্রাফিক আইন খুব কড়াকড়ি। একদল বাংলাদেশি টুরিস্ট এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে প্রচুর সেলফি তুলছে। আবার তাদের রাস্তা পার হতে হবে। ওহ বাবা জেব্রা ক্রসিং এ সবুজ আলো, আর এই আলো দেখে মানুষ রাস্তা পার হয় এত শৃঙ্খলা মেনে! সিমপ্লি অসাম! এ যেন এক অভাবনীয় দৃশ্য! এক বাঙ্গালির মাথা ভরা ডাস্টবিন থেকে কি বুদ্ধি বের হল জানিনা– সে তার বন্ধু সকলকে নিয়ে জেব্রা ক্রসিং এর ডোরাকাটা দাগগুলোতে শুয়ে পরলো আর সেলফি তোলা শুরু করলো। একজন আরেকজনকে আবার বলছে “দোস্ত ওই গাড়ির সামনে দাঁড়ায় তুলি, হেব্বি হবে”। রাস্তা ভরা লোকজন তখনো রাস্তা পার হচ্ছে। পেছনে গাড়ির সারি। যেকোনো মুহূর্তে ওগুলো আবার চলতে শুরু করবে। আমার মনে হতে লাগল এ যেন এক সাইকোপাথিক দুঃস্বপ্ন! সেই দুঃস্বপ্ন দূর করতে আবার সেই পুলিশ কে আসতে হল। সেলফি ওয়ালাদের গাড়িতে করে নিয়ে গেলো অন্য কোন “হেব্বি” লোকেশানে ছবি তোলার জন্য!

ঘটনা ৪ : হিরোশিমা তে এক ইন্ডিয়ান রেসটুরেন্ট এ খাচ্ছি। রেসটুরেন্ট এর প্রতিটা টেবিল আর দেয়ালে লিখা “ধূমপান নিষেধ”– নো স্মোকিং! দুজন বাংলাদেশি আমার সামনের টেবিলে বসলেন। এদের একজন গুলশান এর বিরাট আলিশান বাড়িতে থাকেন এবং তার ১২ টা গাড়ি আছে সেটা আমি কেন, রেসটুরেন্ট এর সবাই জেনে গেলো! ১২ গাড়ির মালিক দেখলাম পকেট থেকে তার মারলবোরো বের করলেন। এবং বিনা দ্বিধায় ফুঁকতে শুরু করলেন। ১ সেকেন্ড এর মাথায় হোটেল কর্ত্রীপক্ষ চলে এলো। তারা ধূমপান নিষেধ লিখাটা ইশারা করে বললেন যে এখানে এটা করা যাবেনা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১২ গাড়ির মালিক সেই জাপানি লোকের কলার চেপে ধরে বলল “ডু ইয়ু নো হু আই এম?!?!” বুঝলাম তিনি শুধু ১২ গাড়ির মালিকই নন, তিনি আরও অন্য কিছু। লোকটার এহেন অভব্যতায় পুরা রেসটুরেন্ট খালি হয়ে গেলো মুহূর্তে। আমি কোন রকম আহার সেরে বের হলাম। বাইরে দেখি পুলিশের গাড়ি অপেক্ষা করছে অধীর আগ্রহে।

ঘটনা ৫ : থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরছি। থাই এয়ারওয়েজে আমার ফ্লাইট। যথারীতি বাংলাদেশিরা প্লেন এর ভেতর চরম হই হট্টগোল করছে। কারও কারও সিট মনের মতো হয়নাই, কারও ব্যাগ এর ফিতা ছিঁড়ে গেছে, কারো বাচ্চার দুধের বোতল এয়ারপোর্টে রয়ে গেছে– এইসব নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি। এ যেন সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে পটুয়াখালী যাওয়া! আমি আগেই শুনেছি বাংলাদেশ রুটে যেসব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট গুলো কাজ করে সেখানে সবচেয়ে ধৈর্যশীল বা রুষ্ট আচরণে সক্ষম এমন কেবিন ক্রু দের নিয়োগ দেয়া হয়। কারণটা অসঙ্গত নয়। এক কেবিন ক্রু হুংকার দিয়ে সব যাত্রীদের বসতে বললেন। প্লেন ওড়া এবং ল্যান্ড করার সময় সিট বেল্ট বেধে রাখা জরুরী। যেই না ঘোষণা এলো প্লেন আর ১০ মিনিটের মধ্যে ল্যান্ড করবে, আমাদের লঞ্চ যাত্রী ভাইয়েরা অমনি তাদের বাক্স পেঁটরা বের করে প্লেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো নামবে বলে। প্লেন তখনও মধ্য আকাশে!

ঘটনা ৬ : চীনের ঘুয়াংজু বিমানবন্দরে আমার ট্রানসিট মোটামুটি ৯ ঘণ্টার। আমি এদিক ওদিক ঘুরছি আর সময় কাটানোর চেষ্টা করছি। একটা বেঞ্চে বসে আছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ৪/৫ জন বাংলাদেশির হল্লা। বাংলাদেশি বুঝলাম তাদের কথা আর ব্যাগের ওপর ঠিকানা দেখে। এদের একজনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া! তবে ওদের একটা জটিল অসুখ আছে– পাশ দিয়ে যে নারী যায় তাকে নিয়ে ওদের একটা অশ্লীল কৌতুক করতেই হবে! এ যেন এক অদ্ভুত অসুস্থ খেলা! দেশি বিদেশি সব নারীদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করার জন্যই যেন তারা সাত সমুদ্র পার করে এই এয়ারপোর্টে এসেছে। ভিনদেশী মহিলা গুলো তাদের কথা বুঝতে না পারলেও এটা বুঝতে পারছিল যে ওদেরকে নিয়েই হাসাহাসি হচ্ছে, এবং প্রসঙ্গটা মোটেও শ্লীল নয়। আমি ওই দৃশ্য আর সহ্য করতে না পেরে বললাম “ভাই আপনাদের সমস্যা কি?” ওরা কুৎসিত একটা হাসি হেঁসে আমাকে বলল “নিজের চরকায় তেল দেন মিয়া! এরা কি আপনের বউ লাগে?” বুঝলাম এরা সোজা কথার মানুষ না। আমি আর এহেন নোংরামিতে আক্রান্ত হতে চাইলাম না বলে নিজেকে সরিয়ে অন্য দিকে চলে গেলাম। কিন্তু প্লেনে উঠে দেখি ওই ছোকরা গুলো আমার আসে পাশের সিটে বসে আছে। আমার মাথা চক্কর দিল! ৮ ঘণ্টার প্লেন জার্নি আমাকে ক্রমাগত বমি করে কাটাতে হবে, বুঝতে পারলাম! সব প্যাসেঞ্জার বসেছে। একজন রূপসী কেবিন ক্রু হেড কাউন্ট করছেন। রূপসীকে দেখে সেই ছোকরাদের কী আনন্দ! প্লেন তখন ছাড়ি ছাড়ি করছে। রূপসী কেবিন ক্রু তার কাজ করছেন। হঠাৎ তিনি আমার ২ সারি পেছনে পার হতেই এক ছোকরা মন্তব্য করল “মা() তোমার দু() তো বেশ খাসা!” আমার কান গরম হয়ে গেলো! সেই রূপসী কেবিন ক্রু পিছনে ফিরে এলেন এবং সেই ছোকরা কে বললেন “হুয়াট ডিড ইউ জাস্ট সে?” ছেলেটা দেখলাম নির্লজ্জের মতো হাসছে! কেবিন ক্রু সামনে ককপিটে চলে গেলেন! এর পরও ছোকরাদের রসের কমতি নাই। একটু পর পোশাকধারী আরও কিছু লোক আর সেই কেবিন ক্রু ফিরে এলেন। সেই ছোকরাকে লাগেজ সহ প্লেন থেকে নামতে বললেন। ছোকরা কিছু বোঝার আগেই তার লাগেজ প্লেন থেকে নেমে গেলো। ছোকরা ভাঙ্গা ইংলিশ এ “সরি সরি” করতে লাগল। ততক্ষণে প্লেন তাকে চীনে রেখে রানওয়ে ছেড়ে আকাশে! ছোকরার বন্ধু অন্য ছোকরারা ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই স্তব্ধ যে তারা কোথায় যাচ্ছে বোধ করি তাও বলতে পারবেনা। সেই অসাধারণ কেবিন ক্রু হাসিমুখে আমাকে এক ক্যান কোক দিয়ে গেলেন। তার নেম ট্যাগ এ নাম দেখলাম “বীণা ব্যানার্জী।”

পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই, বাংলাদেশিদের একটা অদ্ভুত চরিত্র লক্ষ্য করি। শৃঙ্খলা ভঙ্গ আর নোংরা আচরণ করে আমরা দেশে পার পেয়ে যাই বটে, কিন্তু দেশের বাইরে এসব দেশের সুনাম নষ্ট করে। হয়ত নিজের সম্মান নষ্টতে ওদের কিছু যায় আসেনা, কিন্তু দেশের সম্মান নষ্ট করার অধিকার বোধ করি কারও নেই, থাকা উচিতও না। আমার মতো অনেকেই এসব অস্বাভাবিকতায় “ধরণি তুমি দিধা হও” বলে ধরণি তলে হারিয়ে যেতে চায়। আমাদের সবুজ পাসপোর্ট কে তাই সবার এত অবজ্ঞা! আর হবেই বা না কেনো!

ফেসবুক ওয়াল থেকে পাওয়া