Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

‘দেশে ফোন দিলে মা বলে কিস্তির টাকা শোধ কর’

kuwait‘দেশ থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ আসায় মাসিক কিস্তি কিভাবে শোধ করব সেই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না। দেশে ফোন দিলে মা বলে, বাবা তাড়াতাড়ি কিস্তির টাকাগুলো পরিশোধ করে ফেল। আমাদের কথা চিন্তা করিস না।’

বেদনা ভারাক্রান্ত মনে কথাগুলো বলছিলেন কুয়েত প্রবাসী শ্রমিক মানিকগঞ্জের বাসিন্দা আলাউদ্দিন। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে ধারদেনা করে কুয়েতে এলেও কোনো কাজ পাননি আলাউদ্দিন। প্রায় বেকার অবস্থায় তিন মাস ধরে ভাইয়ের কাছে রয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ না জানায়, কোথাও নির্দিষ্ট কাজ পাচ্ছেন না তিনি। একেকদিন একেকজনের সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, তাতে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকমে থাকা-খাওয়া চলে যাচ্ছে তার।

chardike-ad

আলাউদ্দিনের মতোই আরেক অদক্ষ শ্রমিক বরিশালের বাসিন্দা মানিক। কোনো কাজের দক্ষতা না থাকায় ভালো কোনো কাজ পাচ্ছেন না। ফলে কাজের সময় শেষে বাড়তি রোজগারের আশায় বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে সুপার মার্কেটের লিফলেট বিলি করেন এখন।

কোন ভিসায় কুয়েত এসেছেন জানতে চাইলে মানিক জানান, দেড় বছর আগে লামানা ভিসায় (বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশিদের জন্য দেয়া কুয়েত সরকারের ভিসা) সাড়ে ৭ লাখ টাকা দিয়ে একটি ক্লিনিং কোম্পানিতে আসেন তিনি। সেখানে ১২ ঘণ্টা কাজ শেষে বাকি সময় পার্টটাইম জব বা যখন যেটা পান সে কাজ করেন।

মানিক বলেন, কোম্পানি বলে দিয়েছে ডিউটির বাইরে কেউ অন্যত্র কাজ করে পুলিশ বা সিআইডির কাছে ধরা পড়লে তার দায় কোম্পানি নেবে না।

আক্ষেপ করে বলেন, কি করব ভাই, এতো টাকা দিয়ে এসেছি; টাকাগুলো পরিশোধ করতে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। ভিসার টাকা পরিশোধ হয়ে গেলে, ঝুঁকি নিয়ে বাইরে কাজ করব না।

শুধু আলাউদ্দিন বা মানিক নন, কুয়েতে আসা তাদের মতো শত শত বাংলাদেশি শ্রমিকের একই অবস্থা। কোনো কাজে দক্ষতা না থাকায় কুয়েতে এসে তার ভালো কাজ পাচ্ছেন না। কাজ পেলেও সে উপার্জন যৎসামান্য। ফলে নানা রকম সমস্যার আবর্তে আছেন কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

বেশ কয়েক বছর কুয়েতের ভিসা বন্ধ থাকার পর দু্-তিন বছর আগে লামানা ভিসা চালু। যদিও কুয়েতে এখনও সরকারিভাবে বাংলাদেশিদের জন্য কোনো ভিসা চালু নেই। তবে লামানা ভিসায় এরই মধ্যে কুয়েতে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক এসেছেন। লামানা ভিসাগুলো ইজারার মতো দালালরা একে অন্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে নিয়ে থাকেন। এছাড়া কুয়েতি মালিকদের অর্থ বা বিভিন্ন দামি উপহার দিয়ে ভিসা বের করে নেন। পরে সেই ভিসা বিক্রি হয় ৬-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত।

কুয়েতে বিভিন্ন কোম্পানির ভিসা আসা শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা ডিউটি ও বেতন ৬০ দিনার। ওভার টাইমের কথা বলা হলেও সবাইকে ওভার টাইম ডিউটি দেয়া হয় না। ফলে শ্রমিকরা কোম্পানির ডিউটির পর বাড়িতে উপার্জনের জন্য বাইরে মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন।

আবার কিছু শ্রমিক খাদেম ভিসায় (ফ্রি ভিসা) ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করে আসেন, যারা বাইরে কাজ করেন। এটা স্থানীয় শ্রমিক আইনে অবৈধ। ফলে পুলিশ বা সিআইডির হাতে ধরা পড়লে জেল অথবা দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু নামমাত্র সুবিধা ও বেতনে এবং ফ্রি ভিসায় কুয়েত আসছেন বাংলাদেশিরা। সুখের আশায় ও পরিবারের সুদিন ফেরাতে ভিটে-মাটি বিক্রি এবং ধারদেনা করে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে আসা বাংলাদেশিরা শুরু থেকেই সমস্যায় পড়েন। লাখ লাখ টাকা খরচ করে এলেও কাজ খুঁজে পান না। ফলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত ধারদেনা পরিশোধ ও পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবার চিন্তা।

কুয়েতের বিশিষ্টজনরা জানান, সরকারিভাবে কুয়েতের ভিসা চালু হলে ভিসার দাম কমে যাবে। যেখানে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনসহ অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা মাত্র ১ থেকে দেড় লাখ টাকা খরচায় কুয়েত আসেন, সেখানে বাংলাদেশিদের ৭-৮ লাখ টাকা লাগে। সরকারিভাবে ভিসা হলে ভিসার খরচ সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।

কুয়েতের বাংলাদেশ কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ কামাল বলেন, অদক্ষ শ্রমিক না পাঠিয়ে, যে শ্রমিক যে কাজে আসেন; দেশ থেকে তাকে সে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠালে এখানে এসে কষ্ট করতে হয় না। লামানা ভিসায় এসে নানা সমস্যার মধ্যে পড়েন তারা। যেমন- মালিকের কাজ নেই, কাজ করলেও ঠিক মতো বেতন পান না। সঙ্গে থাকা-খাওয়ায় কষ্ট। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে লামানা ভিসায় আসা শ্রমিকদের অনেক কোম্পানিতে কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সে সময় অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন।

কুয়েতে শ্রমিক পাঠানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও দালালদের বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ এবং সরকারিভাবে ভিসা চালু করতে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, দালাল সিন্ডিকেটের কারণে ভিসার দাম ৬-৭ লাখ টাকা। তবে সরকারিভাবে ভিসা চালু হলে কম খরচে শ্রমিকরা কুয়েতে আসতে পারবেন।