Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা: ৪০০০ একর পাহাড় কেটে রোহিঙ্গা বসতি

rohinga
পাহাড় ও সংরক্ষিত বন কেটে এভাবে বানানো হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বসতি।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড় ও সংরক্ষিত বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই এই দুই উপজেলায় বন বিভাগের হিসাবেই প্রায় চার হাজার একর পাহাড় কেটে তারা বসতি স্থাপন করেছে।

স্থানীয় পরিবেশবাদীদের হিসাব অনুসারে, পাহাড়ের আশপাশের জায়গা ধরলে রোহিঙ্গাদের বস্তির জায়গার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার একর। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য আরও নতুন করে দুই হাজার একর জায়গা চাওয়া হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণে পাহাড় কাটায় এলাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা। যেকোনো সময় বড় রকমের পাহাড়ধস ঘটার আশঙ্কায় তাঁরা উদ্বিগ্ন।

chardike-ad

কক্সবাজার থেকে টেকনাফের দিকে উখিয়া বাসস্ট্যান্ড পার হওয়ার পর পথের দুপাশের পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ির সারি চোখে পড়ে। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো-ছিটানো এসব বস্তি। তবে বালুখালী গিয়ে যে দৃশ্য চোখে পড়বে তা দেখে যেকোনো লোকই উদ্বিগ্ন না হয়ে পারবেন না। বিশাল বালুখালী পাহাড়ের গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত ধাপে ধাপে শুধু নীল-কালো প্লাস্টিক সিটের ছাউনি দেওয়া ঝুপড়িঘর। গত বছরই এই বিশাল রোহিঙ্গা বস্তিটি গড়ে তোলা হয়েছে। আগে এখানে রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ৫২৭ জন, এখন প্রায় ২ লাখ। পাহাড় ছাড়িয়ে আশপাশের সমতলভূমিতেও ছড়িয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের বস্তি। রাবারবাগান, সরকারি খাস, পতিত ও ফসলি জমি সব দখল করে ছোট-বড়-মাঝারি নানা রকমের বস্তি বানিয়েছে রোহিঙ্গারা।

উখিয়ার কুতুপালং পাহাড়ের ৭৭ একর জায়গায় ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য করা হয়েছিল সরকার-নিবন্ধিত আশ্রয়কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব রেজাউল করিম জানালেন, আশ্রয়কেন্দ্রের পাশেই টেলিভিশন উপকেন্দ্র। উপকেন্দ্রের কাছে একটি অনিবন্ধিত আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। এখন পুরো পাহাড়ই রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা এখানে বাস করছে। এখন থাইংখালী পাহাড়ে গাছপালা কেটে সেখানে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস শুরু করেছে।

টেকনাফ উপজেলায়ও একই অবস্থা। হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পুটিবুনিয়া পাহাড়টি প্রধান সড়ক থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার ভেতরে। সে কারণে সড়ক থেকে চোখে পড়ে না। কিন্তু সেখানে গেলে পাহাড় কাটার বিপর্যয়কর দৃশ্য চোখে পড়ে। পুরো পাহাড়ে গাছপালা কেটে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গা বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে। এবারের রোহিঙ্গা জনস্রোতকে আশ্রয় দিতে নতুন করে এটি করা হয়েছে।

পুটিবুনিয়ার এই পাহাড়ের চারপাশের অধিকাংশই খাসজমি। সেগুলো লিজ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা চাষাবাদ করে আসছেন বহুকাল থেকে। এখানে খুব ভালো সবজির আবাদ হয়। পাহাড় থেকে নেমে আসা খাঁড়ির পানি থেকেই সেচ দেওয়া যায়। মূলা, শিম, বরবটি প্রভৃতির চাষ হয়। এখন সেসব জমিতে উঠেছে হাজার হাজার ঝুপড়িঘর। সামান্য জমি এখন অবশিষ্ট আছে। আবদুস শুক্কুর এখানে প্রায় দেড় একর জমিতে শিম আর মূলা চাষ করেছিলেন। সরেজমিন দেখতে গেলে গত শনিবার বিকেলে খেতের পরিচর্যারত শুক্কুর বলছিলেন, শেষ পর্যন্ত মূলার খেতটুকুও থাকবে কি না, তা নিয়েই এখন সন্দেহ।

এ ছাড়া টেকনাফের সরকার-নিবন্ধিত নয়াপাড়া আশ্রয়কেন্দ্র ও অনিবন্ধিত লেদা আশ্রয়কেন্দ্রটিও তৈরি করা হয়েছে দুটি পাহাড় কেটে। মেরিন ড্রাইভের পাশে সংরক্ষিত গর্জনবনেও রয়েছে রোহিঙ্গাদের অবৈধ ২০৮টি পরিবার। এখানে নতুন করে রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করেছে। এই সংরক্ষিত গর্জনবনটি ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

কক্সবাজার জেলা বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, উখিয়া রেঞ্জে কুতুপালং, থাইংখালী ও আশপাশের পাহাড়ের প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। এ ছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, পুটিবুনিয়া রেঞ্জের ৫০ একর এবং শিলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে রোহিঙ্গা বসতি করা হয়েছে। মোট পাহাড়ি জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৮৭৫ একর। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা টেকনাফের নেচার পার্ক, বাহারছড়া, শাহপরীর দ্বীপ, মোচনী, দমদমিয়া, জাদিমুরা, মেরিন ড্রাইভ এলাকা এবং উখিয়ার জামতলী, বাগগোনসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়ার পাশে ঝুপড়িঘর তুলে ছোট বড়-মাঝারি আকারের বসতি স্থাপন করছে।

কক্সবাজার জেলার পরিবেশবাদী সংগঠন ‘বন ও বন সংরক্ষণ পরিষদ’-এর সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, মাঠপর্যায়ে তাদের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তৈরি হিসাব অনুসারে শুধু এই দুই উপজেলায়ই সব মিলিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রায় দশ হাজার একর জায়গায় এখন রোহিঙ্গারা বসতি গড়ে তুলেছে। এতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। যেকোনো সময়ে বড় রকম পাহাড়ধসের ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, যদি মানবিক দিকের কথা বিবেচনা করেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়, তবে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী শূন্যরেখা বরাবর সরকারি খাসজমিতে তাদের একত্র করে বসতি করে দেওয়া হোক।

টেকনাফের সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন বলেন, দ্রুত পরিবেশ বিপর্যয়কারী এই প্রক্রিয়া বন্ধ না করলে বড় রকমের প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটবে। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও পাহাড় বা সংরক্ষিত বন ধ্বংস করা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মমিনুল ইসলাম। প্রথম আলো