Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যেমন দেখলাম জাপান

japanবছরখানেকের ওপর হয়ে গেল জাপান এসেছি। কিছুটা হলেও জাপানিজ কালচার সম্পর্কে একটা আইডিয়া তৈরি হয়েছে। কিছুটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়, কিছুটা বা পারিপার্শ্বিক লোকজনের সঙ্গে আলোচনায় পরোক্ষ লব্ধ অভিজ্ঞতায়। তবে যেভাবেই বলি না কেন, একটা বিষয় আমি মোটামুটি নিশ্চিত, জাপানিদের মতো শৃঙ্খলিত আর পরিশ্রমী জাতি হয়তো আরও পাওয়া যাবে কিন্তু এতটা বিনয়ী আর অমায়িক অন্য কোনো জাতি আছে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান।

আমার একটা বিষয় ভেবে আসলেই কষ্ট হয়, এরা যখন নিজ দেশের বাইরে অন্য কোনো বিশৃঙ্খলিত পরিবেশে যায়, শারীরিক কষ্টটা হয়তো এরা খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে কিন্তু মানসিকভাবে যে ধাক্কাটা খায় তা এরা কন্ট্রোল করে কীভাবে? কী জানি, হয়তো এটাও তারা জীবনের একটা লেসন হিসবে ধরে নেয়! যা হোক, নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।

chardike-ad

কাস্টমার সার্ভিস ডেলিভারি, এককথায় অসাধারণ বললেও কম হবে! যেকোনো সার্ভিস দেওয়ার জন্য যে সময় চাইবে আপনার কাছে, নিশ্চিত থাকতে পারেন তার চেয়ে আগেই সেটি পেয়ে যাবেন। যেমন তিন ঘণ্টা বললে দুই ঘণ্টায় বা পাঁচ দিন বললে তিন দিনেই হাতে পাবেন। কিছুটা সময় এরা হাতে রেখে এক্সট্রা হিসেবে রেখে দেয় রিস্ক এড়াতে, যাতে কোনোভাবেই কাস্টমারকে ওয়েট না করতে হয়।

কোনো একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে যদি কারও কাছে কোনো মেন্যুর ইনগ্রেডিয়েন্ট নিয়ে জানতে চাই এবং কোনো কারণে যদি তিনি শতভাগ নিশ্চিত না থাকেন, তাহলে এটার পিছেই হয়তো তিনি ১০-১৫ মিনিট ব্যয় করে ফেলবেন। প্রথমে গুগল সার্চ, না হলে অন্য ২–৩ জন ওয়েটারকে নিয়ে একটা ছোটখাটো গবেষণা, তারপরও না হলে দরকারে হেড অফিসে ফোন পর্যন্ত দিতে দেখেছি। দেখা গেছে, পরে আমার নিজের কাছেই এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করায় বিব্রত লাগতে থাকে কিন্তু তিনি ঠিকই সিরিয়াসলি সবকিছু করে এসে আমাকে হাসিমুখে উত্তর জানিয়ে যান এবং কালক্ষেপণ করায় আমাকে ২–৩ বার ‘গোমেন্নাসাই’ মানে ‘সরি সরি’ বলে দুঃখ প্রকাশ করতে থাকেন।

ম্যাকডোনাল্ডসে মাঝে মাঝেই যাওয়া হয়। ওখানে এক ধরনের ‘কোন’ আইসক্রিম পাওয়া যায়। অর্ডার করলে ইনস্ট্যান্টলি রেডি করে দেয়। মানে আমাদের দেশের মতোই, বিস্কুটের অংশটা নিয়ে মেশিন প্রেস করে আইসক্রিমটা বসিয়ে দেয় আরকি। কিন্তু কোন–এর যে স্পেসিফিক একটা সেপ থাকে, ওটা যদি সামান্য একটু এদিক-ওদিক হয়, সঙ্গে সঙ্গে ওটা ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরি করে, অথচ ওটা আমার কাছে হয়তো ঠিক চোখেই ধরা পড়ত না, কিন্তু তারা কনসার্ন, ওই যে কাস্টমার সার্ভিস বলে কথা, যদি মাইন্ড করি!

আরেকটা বিষয় খেয়াল করলাম, রেস্টুরেন্টে যদি কোনো ওয়েটার কোনো ভুল করেন যেমন হাত থেকে কিছু ফেলে দেন বা একটা করতে আরেকটা করেন, তাহলে বাকি ওয়েটাররা বিরক্ত হওয়া তো দূরের কথা, সবাই মিলে এটা নিয়ে মজা করা শুরু করে পরিস্থিতি নরমাল করে ফেলেন। হয়তো এটাও একটা স্ট্র্যাটেজি!
জাপানের সকাল ৮-৯টার ট্রেন, বাংলাদেশে ইদ-কোরবানিতে ঠিক দুই–তিন দিন আগে যে ভিড় হয়, অনেকটা তেমন। আমি পারতপক্ষে এই টাইমটা এড়িয়ে যাই। কিন্তু তাও যে কয়দিন বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে, নিজেকে অনেকটা স্যান্ডউইচের মতন মনে হয়েছে। সামনে পিছে ডানে বামে সবার মাঝে চিরে চ্যাপ্টা হওয়ার অবস্থা, ছেলেমেয়ে সবাই একসঙ্গে। কখনো কারও শরীরে ধাক্কা লেগে যাচ্ছে কিংবা কারও জুতোয় চাপ। কিন্তু কারও একবিন্দু ধৈর্যচ্যুতি হতে দেখিনি। শুধু এক বগি না, পুরো ট্রেনেই বলতে গেলে সুনসান নীরবতা। ভাবলেও অবাক হতে হয়, হাজার হাজার মানুষ গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন, কিন্তু কোনো কোলাহল তো দূরের কথা, কোনো সাউন্ডই নেই, শুধু ট্রেন চলার শব্দ। কী করে এটা সম্ভব?

আরেকটা বিড়ম্বনায় প্রায়ই পড়তে হয়, ট্রেনে বসতে যাব, সিট একটা কিন্তু মানুষ দুজন হয়ে গেল। কে কাকে বসতে দেবে এটা নিয়ে কয়েক দফা অনুরোধের আদান-প্রদান করতে হয়। শুধু ট্রেনেই না, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমন একটা কম্প্রোমাইজ করার প্র্যাকটিস করে এরা। যেন যে ছাড় দিতে পারল সেই জিতে গেল এই টাইপ।
এবার ব্যক্তি মানুষের কথায় আসি। জাপানে আসার পর আমাকে ভালো একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে দিতে স্কলারশিপ অথোরিটি থেকে একজন গাইড দেওয়া হলো, মানে অনেকটা আমাদের দেশের দালালের মতন। আমার গাইড একজন নারী, বয়স ৪০–এর মতন, আমাকে নিয়ে দুই–তিন দিন ঘুরে সবকিছু ঠিক করে দিলেন। নিজের অফিশিয়াল কাজ হিসেবে ফোন করে গ্যাস, কারেন্ট, পানি, ইন্টারনেটসহ সবাইকে ডেকে এনে সবকিছু ঠিকমতো ফিক্সড তো করলেনই, ফাঁকে ফাঁকে আমাকে ফ্ল্যাট গোছাতে যাবতীয় সাহায্য যেমন—পর্দা টানানো, জিনিসপত্র সেট করা, এমনকি আমার বালিশের কাভার, বেড কাভার সব নিজ হাতে সেট করলেন। আমি জিম করি শুনে আমার জন্য পরদিন আশপাশে কোথায় কোথায় ভালো জিম আছে তার ম্যাপ ডাউনলোড করেও নিয়ে আসলেন আর বিদায়বেলায় তার হাতে থাকা বিশাল ব্যাগটি রেখে বললেন, এখানে কিছু জিনিস আছে, আশা করি তোমার কাজে আসবে।

খুলে দেখলাম, একটি ঝাড়বাতি টাইপ লাইটিং সিস্টেম, কিছু কিচেন আর বাথ আইটেম এবং সঙ্গে টুকটাক আরও অনেক কিছু, আমি একটু কনফিউজড হয়ে যখন তাঁকে এর মূল্য দিতে চাইলাম, তিনি বললেন, না না, এটা বিক্রির জন্য না! তোমার জন্য নিয়ে এসেছি, জাপানে তোমার নিউ লাইফ শুরু করার জন্য আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার! আমি তাঁকে লাঞ্চে ইনভাইট করলে তিনি বললেন, এখন না, জাপান থেকে যাওয়ার আগে বোলো, এখন করলে মনে থাকবে না পরে, যাওয়ার আগে করলে মনে থাকবে অনেক দিন। আর তোমার ফ্যামিলি মেম্বারদের কেউ যদি তখন থাকে তাহলে তাদের সঙ্গেও দেখা হলো। আমি তখন মনে মনে ছোটবেলা থেকে দেখে আসা দালালদের কথা ভাবছি, আর পাশাপাশি তাঁকেও দেখতে লাগলাম।

আসলে এমন যে আরও কত ঘটনা! তাই জাপান থেকে এক বছরে একাডেমিক সেশনের বাইরে যে কী কী শিখলাম তা যদি এক বাক্যে বলি তা হলো প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করা আর নিজের কমিটমেন্টের প্রতি ডেডিকেটেড ও স্ট্রং থাকা। আর কিছু কমন টপিক যেমন—নারী-পুরুষের সমতার কথা যদি বলি, তাহলে বলব জেন্ডার ভেদে যেকোনো বৈষম্য করা যায়, এদের ইয়ং জেনারেশন মনে হয় এটা জানেও না যে, এমন কিছু করা যায়! শুধু এটা না, অনেক নেগেটিভ টার্মের সঙ্গেই এদের আদৌ পরিচয় আছে কিনা সন্দেহ হয়। থাকলেও হয়তো গল্প বা ইতিহাসের পাতার মাধ্যমে আছে, বাস্তব জীবনে হয়তো তেমন নেই। মাঝে মধ্যে আসলেই মনে হয়, স্বর্গের খুব কাছাকাছি আছে হয়তো এরা চলে এসেছে। এ জন্যই তো বলে—‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!’

নিহাদ আদনান তাইয়ান: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সদর দপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ। বর্তমানে জাপানের মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসি বিষয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।

সৌজন্যে: প্রথম আলো