
রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সালোনার খেলোয়াড়দের নিয়ে প্রতিকী ছবি। ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
আপনি ক্লাব ফুটবল দেখেন বা না দেখেন ‘এল ক্ল্যাসিকো’ এই শব্দযুগল আপনি অবশ্যই শুনেছেন। ধারনা করছি আপনার বেশ পরিচিতও বটে। এল ক্ল্যাসিকো কি, এল ক্ল্যাসিকোর মত ফুটবলের আরো বড় দুইটি দ্বৈরথ, কিভাবে এলো ক্ল্যাসিকো নাম, জয় পরাজয়ের হিসাব জানবো আজ।
ক্ল্যাসিকো শব্দটি আর্জেন্টিনার দুই ক্লাব বোকা জুনিয়রস এবং রিভার প্লেটের দ্বৈরথকে কেন্দ্র করে উৎপত্তি। ক্লাসিকো একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার ইংরেজি হলো Derby. অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে Derby হলো দুই দলের যেকোনো খেলার লড়াই।
ফুটবলের দুনিয়ায় চোখ রাখলে অসংখ্য ক্ল্যাসিকো বা ডার্বি দেখতে পাবেন। ম্যাঞ্চেস্টার ডার্বি, মাদ্রিদ ডার্বি, লন্ডন ডার্বি, এল ক্ল্যাসিকো, দ্য নর্থওয়েস্ট ডার্বি, সুপার ক্ল্যাসিকো, ডার ক্লাসিকার, ডার্বি দে মিলানো ইত্যাদি। এর মধ্যে আপনাদের মনে হতে পারে সব দিক বিবেচনায় এল ক্ল্যাসিকোই সবচেয়ে বড় ফুটবল দ্বৈরথ, যদি তাই ভেবে থাকেন তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। আসুন, জেনে নেয়া যাক ইতিহাসের সেরা ৩ ক্লাব ফুটবল দ্বৈরথ।

১. সুপার ক্ল্যাসিকো (বোকা জুনিয়রস বনাম রিভার প্লেট):
অনেকেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার দ্বৈরথকে সুপার ক্ল্যাসিকো বলে থাকে। তারা একদম পুরোপুরি ভুল না। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বৈরথকে আসলে সুপার ক্ল্যাসিকো দে আমেরিকানা বলা হয়।
ক্লাব দুইটির অবস্থান আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এইরিসে। বলা হয়ে থাকে আর্জেন্টিনার ৭০% মানুষ এই দুই ক্লাবের ফ্যান। এই দুই দলের ফ্যানরা প্রচন্ড প্যাশনেট, কিছু ক্ষেত্রে আগ্রাসী বা উগ্র বললেও ভুল হবে না। ২০১৮ এর কোপা লিবার্তোদেসের ফাইনালে গিয়েছিলো এই দুই দল। ফাইনালের প্রথম লেগেই মারামারি লেগে যায়, যার জন্য কনমেবেলকে সে ফাইনালের ২য় লেগ মাদ্রিদে আয়োজন করতে হয়৷
এই দুই দলের প্রথম দেখা হয় ২৪শে অগাস্ট ১৯২৩ সালে। এরপর আরো ২৬০ বার এই দুই দলের দেখা হয়, যার মধ্যে বোকা জুনিয়রস জয় পায় ৯১টি তে, রিভার প্লেট ৮৬টিতে এবং বাকি ৮৩ ম্যাচ ড্র হয়।
বোকা জুনিয়রস ভক্তরা রিভার প্লেট ভক্তদের ‘Gallians’ বা মুরগির বাচ্চা এবং রিভার প্লেট ভক্তরা বোকা জুনিয়রস ভক্তদের ‘Little Pig’ বা শুকোর ছানা বলে ডাকে।
মাঠের দ্বৈরথ ছাপিয়ে এই দুইদলের লড়াই প্রায়ই সমর্থকদের মাঝে সহিংসতা ছড়াই। যার খেসারত দিতে হয়েছে অনেকবার। ২৩শে জুন ১৯৬৮ সালে, এক সুপার ক্ল্যাসিকো ম্যাচের পরে এল মনুমেন্টালের (বোকা জুনিয়রসের মাঠ) ১২ নাম্বার গেইটে এক ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটে, যার ফলে ৭১ জন মারা যায় এবং দেড় শতাধিক আহত হয়, যদিও দূর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি কখনোই। এই দূর্ঘটনা Puerta 12 Tragedy নামে পরিচিত।
২. এল ক্ল্যাসিকো (রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বার্সালোনা): এল ক্ল্যাসিকো শব্দযুগল প্রথম দিকে শুধু মাত্র রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সালোনার মধ্যকার লিগ ম্যাচকে বুঝানো হতো। পরবর্তীতে সেটা চ্যাম্পিয়নশীপের ম্যাচের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। বর্তমানে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল ব্যতিত রিয়াল-বার্সার সব দ্বৈরথই এল ক্ল্যাসিকো।
রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সালোনা স্প্যানের দুই ভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে; একটি কাস্টিল অন্যটি কাতালোনিয়ার। কাতালোনিয়ার মানুষ সবসময় স্পেন থেকে স্বাধীন হওয়ার চিন্তা হৃদয়ে ধারন করে। ছয় বছর আগে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামী নেতা কার্লস পুইগদেমন্ত গণভোটের আয়োজন করে যেখানে ৯০% মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়। এই স্বাধীন হওয়ার মানসিকতাটা সেই স্পেন শুরুর সূচনা কাল থেকেই কাতালোনিয়ার মানুষদের মাঝে ছিল কিন্তু স্পেন সরকারের দমন-পীড়নের ভয়ে সরাসরি কখনোই তারা সেভাবে আওয়াজ তুলতে পারেনি। এজন্য তারা বেছে নেয় ফুটবলকে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে বার্সালোনাকে। এজন্যই বার্সালোনাকে বলা হয়, ‘একটা ক্লাবের চেয়েও বেশি কিছু’ (Més que un club)। একদিকে কমিউনিস্ট স্পেন সরকারের রাজধানীর ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ, অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী একটি রাজ্যের ক্লাব বার্সালোনা। তাই লড়াইটা ফুটবল ছাপিয়েও অনেক দূর। সে লড়াইয়ে কারা ঠিক বা জয়ী তা বলা যাচ্ছে না কিন্তু ফুটবলের লড়াইয়ে আপাত রিয়াল মাদ্রিদই চালকের আসনে।
দুই দলের প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে দেখা হয় ২৫৬ বার, যার ১০৪ টিতে জয় পায় রাজার ক্লাব বলে খ্যাত রিয়াল মাদ্রিদ, অন্যদিকে বার্সালোনার জয় ১০০টিতে, ৫২ টি ম্যাচ ড্র হয়। এই দুই দলের লড়াইয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা লিওনেল মেসি (২৬), তার ঠিক পিছেই আরো দুই গ্রেটের নাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও ডি স্টেফানো; দুইজনেরই গোল সংখ্যা ১৮ টি। সবচেয়ে বেশি এল-ক্ল্যাসিকো ম্যাচ খেলেছেন সার্হিও রামোস (৪৫)।

৩. দ্য নর্থ–ওয়েস্ট ডার্বি (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম লিভারপুল):
লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইংল্যান্ডের উত্তর পশ্চিমের দুই শহর। ম্যানচেস্টার-লিভারপুল লড়াইটা ফুটবলের আগে অর্থনীতিতে শুরু হয়েছিল। সে সময়ে একদিকে ম্যানচেস্টারে শিল্প-কারখানা কেন্দ্রিক নগরায়ণ হয়, অন্যদিকে লিভারপুল বন্দর কেন্দ্রিক। এমনিতে দুই শহরের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্ক ছিল। সেই আগুনের উত্তাপ বহুগুণ বেড়ে যায় যখন ম্যানচেস্টার শিপ ক্যানাল খুলে দেয়, যার ফলে লিভারপুল বন্দর বাইপাস হয়ে যায়। লিভারপুল-ম্যানচেস্টার এই দ্বৈরথ ধিরে খেলার দুনিয়াতেও এসে পড়ে, বিশেষ করে ফুটবলে। দ্বৈরথটা এতো বড় যে, আজ পর্যন্ত লিভারপুল এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মাঝে সরাসরি প্লেয়ার ট্রান্সফার হয়েছে মাত্র একজন।
খেলার মাঠের লড়াইয়ে অবশ্য ইউনাইটেডই এগিয়ে আছে৷ ২৮ এপ্রিল ১৮৯৪ এ প্রথম দেখা হওয়ার পর এই পর্যন্ত মোট দেখা হয়েছে ২১১ বার। ইউনাইটেডের ৮২ জয়ের বিপরীতে লিভারপুলের জয় ৭১ টিতে, ড্র হয়েছে ৫৮ টি ম্যাচ। ফার্গুসন পরবর্তী সময়ে ইউনাইটেড যখন ধুঁকছে, লিভারপুল উড়ে চলেছে ক্লপের হাত ধরে। ইউরোপ এবং ঘরোয়া লিগ দুই জায়গাতেই বেশ সাফল্য পাচ্ছে দলটি।