
জাতিসংঘ-সমর্থিত বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে গাজায় দুর্ভিক্ষের “সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি” নিশ্চিত করার ঘোষণা এই সপ্তাহে এসেছে। কিন্তু গাজার মানুষদের জন্য এই ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না। তারা বহু মাস ধরে দেখছে, কীভাবে তাদের সন্তানরা ক্ষুধায় হাড় জিরজিরে হয়ে যাচ্ছে।
৩৮ বছর বয়সী জামিল মুগারি, গাজার মাঝখানের মাঘাজি এলাকার বাসিন্দা, বলেন, “আমার সব সন্তানই তাদের শরীরের প্রায় অর্ধেক ওজন হারিয়েছে। আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়েটি এখন মাত্র ১১ কেজি ওজনের। আমার ছেলে মোহাম্মদ পুরো হাড়সর্বস্ব হয়ে গেছে। আমার সব সন্তান একইরকম।”
“আমি নিজে আগে ৮৫ কেজি ছিলাম, এখন ৫৫ কেজিতে নেমে গেছি,” বলেন তিনি। তিনি জানান, পরিবারের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েই তার শরীরিক শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে। “অনেক সময় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়, কিন্তু নিজেকে জোর করে টিকিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে কাঁপুনিও হয়।”
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা ৬০,০০০ ছাড়িয়েছে—যদিও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়াদের নিয়ে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ক্ষুধা এখন বোমা ও গুলির মতোই নির্মমভাবে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। মঙ্গলবার ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) জাতিসংঘ ও বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার বিশেষজ্ঞদের গঠিত প্যানেল—জানায়, গাজায় এখন দুর্ভিক্ষ “বাস্তবে ঘটছে” এবং এই মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়।

গাজার ২২ লাখ মানুষ বহুদিন ধরেই ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। ইসরায়েলের কঠোর অবরোধে সাহায্য পৌঁছাতে না পারায় প্রতিদিন খাদ্যের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
মুগারি বলেন, “খাবার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কখনও এক-দুই সপ্তাহ কোনো ময়দা ছাড়া থাকতে হয়। অনেক দিন একবেলা খাবার খাই—তা-ও কেবল ডাল। কোনো দিন কিছুই পাই না—তখন শুধু পানি খেয়ে দিন পার করি।”
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তার পরিবারকে সাতবার স্থানান্তরিত হতে হয়েছে। কিন্তু খাদ্যসংকট থেকে বাঁচার কোনো পথ নেই।
“কখনও দানবাক্স বা কোন দয়ালু মানুষের মাধ্যমে ডাল পাই। কোনো কোনো সময় ধার করে কিনি। কিন্তু যে সব লোকে ত্রাণ আসে বলছে, তার বেশির ভাগই অস্ত্রধারীরা জোর করে ট্রাক দখল করে নেয় এবং সেই খাবার প্রচণ্ড দামে বিক্রি করে। গরিব মানুষ এত দাম দিয়ে কীভাবে কিনবে?”
গাজায় গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন এর পরিচালিত চারটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র প্রতিদিন মাত্র কিছু মিনিটের জন্য খোলা থাকে। সেই সময় অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়, যার ফলে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনা বারবার ঘটেছে।
৫৮ বছর বয়সী বিধবা মনসুরা ফাদল আল-হেলু এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে, তিনি নিজে যেতে পারেন না এবং একমাত্র ছেলেকেও পাঠাতে চান না—ভয়ে যে সে হয়তো আর ফিরে আসবে না।
তিনি বলেন, “ওখানকার অবস্থা ভয়ঙ্কর, বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও বিশৃঙ্খলা। আমি আমার ছেলেকে কখনও সাহায্যের ট্রাকের ধারে যেতে দিই না, কারণ সেখানে সেনাবাহিনীর গুলি যে কোনো সময় আসতে পারে। আমি আমার ছেলেকে শহীদের মরদেহ হয়ে ফিরতে দেখতে পারব না।”
মুগারির ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে, আর তার সব সন্তান ১২ বছরের নিচে। তাদের পক্ষেও খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা অসম্ভব।

“আমি চেষ্টা করি শক্ত থাকি, যেন সন্তানদের কিছু খাওয়াতে পারি,” বলেন তিনি। “আমরা বহুবার বিশ্বকে বার্তা দিয়েছি, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। এখন আমরা জানি না, আর কী বলব। শুধু বলতে পারি—আমরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছি। আমাদের এই ট্র্যাজেডি থেকে বাঁচান।”
ডেইর আল-বালাহর বাসিন্দা আবু আল-আবেদ বলেন, “আমার ছোট মেয়ে ১৪ বছর বয়সী, তার পাঁজরের হাড়গুলো এখন স্পষ্ট দেখা যায়, অপুষ্টিতে এত দুর্বল হয়েছে।” তিনি আরও জানান, “আমার চার মেয়ে ও তিন ছেলে রয়েছে। খাদ্যের অভাবে তারা মাথা ঘোরা ও ক্লান্তিতে ভুগছে। আমি যখন নিজেই এমন অনুভব করি, তখন ভাবুন, ওদের কী অবস্থা!”
তিনি জানান, কোনো সাহায্য পান না তারা, বাজারেও খাবারের দাম এত বেশি যে সামান্যই কিনতে পারেন।
“দামের এমন ঊর্ধ্বগতি ইউরোপের দেশগুলোতেও নেই। অথচ এখানে কোনো আয়ের উৎস নেই। একসময় আমাদের এলাকায় স্যুপ রান্নার কেন্দ্র ছিল, এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো ফ্রি খাবার আর নেই।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বছরের পর বছর বিশ্ব মানবাধিকারের কথা বলেছে, মানুষের জীবন রক্ষার কথা বলেছে। এখন আমি বুঝেছি, সবটাই ছিল মিথ্যা। আমরা প্রতারিত হয়েছি ওই সব শ্লোগানে। যদি আমরা বলতাম, গাজার পশুদের অধিকার রক্ষা করো—তবুও ওরা কিছু করত। কিন্তু যখন কথা আসে ফিলিস্তিনিদের জীবনের, তখন কেউ আমাদের কথা ভাবে না— না আরব, না মুসলিম, না খ্রিস্টান—কেউ না।”
আইপিসির ঘোষণায় গাজার মানুষ যে কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিক মনোযোগের আশা করছে, সেটাও খুব দুর্বল আশাবাদ।

মনসুরা ফাদল আল-হেলু বলেন, “আমরা বহুদিন ধরে এই দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, কেউ এগিয়ে আসেনি। আশা করি এই বার্তার মাধ্যমে অন্তত বিশ্ব কিছু করবে, আমাদের এই ধীরে ধীরে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবে।”
যুক্তরাজ্যের সেপ্টেম্বর মাসে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তাকে আশাবাদী করতে পারেনি।
তিনি বলেন, “ব্রিটিশ সরকার যদি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ও, কী হবে? এমন একটা রাষ্ট্র যার নিজস্ব সার্বভৌমত্ব নেই, আত্মরক্ষার অধিকার নেই, তাকে স্বীকৃতি দিয়ে কী লাভ? স্বীকৃতি যদি বাস্তব হয়—আসল সার্বভৌমত্ব ও অধিকার সহকারে—তাহলে তা স্বাগত। আমরা চাই এমন একটি রাষ্ট্র, যার মানুষদের অন্য দেশের মানুষের মতোই অধিকার থাকবে।”
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান