
আনন্দের পেছনে দৌড় নয়—আনন্দের সঙ্গে থাকা
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু অদৃশ্য শক্তি আছে, যেগুলো আমাদের আচরণ, পছন্দ, মনোযোগ—সবকিছুকে নীরবে প্রভাবিত করে। তারই মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত এবং সবচেয়ে ভুল-বোঝাবুঝির শিকার একটি শব্দ হলো ডোপামিন। আমরা ডোপামিনকে সাধারণত “আনন্দের হরমোন” বলে জানি। কিন্তু আসলে এটি আনন্দ নয়, বরং আনন্দের প্রত্যাশা তৈরি করে। এই ‘প্রত্যাশা’ই আমাদের বারবার স্ক্রল করতে, ভিডিও দেখতে, নোটিফিকেশন চেক করতে অথবা নতুন কিছু খুঁজে পেতে বাধ্য করে। আর এভাবেই শুরু হয় ডোপামিন আসক্তির চক্র।
আজকের পৃথিবীতে আমরা সবাই যেন এক অদৃশ্য ম্যারাথনের দৌড়বিদ—যার লক্ষ্য আনন্দ, আর যে ট্র্যাকটা অসীম।
ডোপামিন আসলে কী?
ডোপামিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার—মস্তিষ্কের ভেতর বার্তা আদান—প্রদানের রাসায়নিক। এটা মূলত কাজ করে reward system-এ। আমরা যখন কিছু করি—যেমন একটি নোটিফিকেশন পাই, সুস্বাদু খাবার খাই, ভিডিও দেখি, নতুন কিছু শিখি—মস্তিষ্ক তখন ছোট্ট করে ডোপামিন ছুঁড়ে দেয়। যেন বলছে, “ভালো! আবারও করো।”
এটাই সমস্যা নয়। সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন আমরা এই “ছোট্ট ভালো লাগা”কে অতিরিক্ত খুঁজতে থাকি, বারবার। তখন ডোপামিন আর আনন্দ দিতে পারে না—বরং আনন্দ খুঁজতে বাধ্য করে। এক সময় দেখা যায়, আমরা আনন্দ পাচ্ছি না; শুধু পেতে চাইছি।
ফিডের দুনিয়া: আমাদের মনোযোগের বাজার
সোশ্যাল মিডিয়া আজ ঠিক সেই জায়গা, যেখানে কোম্পানিগুলো আমাদের ডোপামিনের ওপর নির্ভর করে তাদের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। অ্যালগরিদম জানে—আমরা কতক্ষণ স্ক্রল করি, কোন ভিডিওতে থেমে যাই, কী ধরনের পোস্টে প্রতিক্রিয়া দিই।
ফিডগুলো হঠাৎ হঠাৎ আমাদের সামনে এমন কিছু দেয় যা আমাদের চমকে দেয়—“ভাইরাল” ভিডিও, আকর্ষণীয় ছবি, নাটকীয় শিরোনাম। এগুলোকে বলা হয় random reward—অপ্রত্যাশিত পুরস্কার। ঠিক যেমন লটারি বা স্লট মেশিনে হয়।
এই অপেক্ষার খেলা আমাদের মস্তিষ্ককে খাইয়ে রাখে ডোপামিনে। আমরা জানি না, স্ক্রল করলে পরের পোস্টটা কেমন হবে—এটাই উত্তেজনার উৎস।

ছোট-বড় সব আনন্দ একাকার
আগে আনন্দ ছিল অনেক বড় জিনিস—বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানো, বই পড়া, ভ্রমণ, সিনেমা দেখা। এখন এক সেকেন্ডে ছোট ছোট আনন্দ পাওয়া যায়—একটা লাইক, একটা রিল, একটা নোটিফিকেশন, একটা মেমে।
সমস্যা হলো—এই ছোট আনন্দগুলো এত সহজে, এত ঘন ঘন পাওয়া যায় যে বড় আনন্দগুলো আর তেমন গুরুত্ব পায় না। ৩০ সেকেন্ডের ভিডিও যখন আমাদের মনকে উত্তেজিত করে, তখন ৩০ মিনিটের বই পড়া কঠিন হয়ে যায়।
এটাই ডোপামিন আসক্তির ভয়াবহ দিক—এটি আমাদের ধৈর্য, গভীর মনোযোগ, দীর্ঘ সময়ের আনন্দ সবকিছু কমিয়ে দিতে শুরু করে।
চটজলদি আনন্দের অভ্যাস: আমাদের ক্লান্তি বাড়াচ্ছে
আমরা ভাবি ডোপামিন মানে খুশি হওয়া। সত্যি হলো—ডোপামিন মানে কাজ করে যাওয়ার প্রেরণা। সেই প্রেরণা যখন অতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়। একসময় একই ভিডিও, একই স্ক্রল, একই গেম আগের মতো আনন্দ দেয় না।
যে জিনিসটি আগে ৫ মিনিট আমাদের মজা দিত, এখন সেটাই ৩০ মিনিট লাগে। এবং শেষ পর্যন্ত—আমরা শুধু ক্লান্ত বোধ করি, আনন্দ পাই না।
এটাকে বলা হয় desensitization—মস্তিষ্কের সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া।
যেভাবে চিনি বেশি খেলে তা শরীরকে দুর্বল করে, ঠিক তেমনি অতিরিক্ত ডোপামিন-চাহিদা মস্তিষ্ককে অসাড় করে দেয়।

কেন আমরা বের হতে পারছি না?
ডোপামিন আসক্তি আসলে মস্তিষ্কের একদম সহজ এবং প্রাচীন কাঠামোর ভুল ব্যবহার। আমাদের মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছিল—খাবার খুঁজতে, বিপদ চিনতে, নতুন কিছু আবিষ্কার করতে।
এখন সেই একই প্রক্রিয়া আমরা ব্যবহার করছি—
• স্ক্রল করার জন্য।
• লাইক পাওয়ার জন্য।
• নোটিফিকেশন চেক করার জন্য।
• ছোট ছোট ভিডিওর জন্য।
আমরা বের হতে চাই, কিন্তু পারি না। কারণ মস্তিষ্ক আমাদের পুরস্কৃত করে ছোট ছোট সাফল্যে—একটা নতুন পোস্ট, একটা নতুন ভিডিও, এক টুকরো খবর।
বেদনার বিষয়—এই সাফল্যগুলো বাস্তব নয়। এগুলো ক্ষণস্থায়ী, এতে গভীরতা নেই, স্থায়ী সুখ দেয় না।
মানসিক স্বাস্থ্যে ডোপামিনের প্রভাব
ডোপামিন আসক্তির কিছু সাধারণ লক্ষণ—
• মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
• কাজ করতে করতে হঠাৎ ফোন চেক করা।
• বই পড়া বা দীর্ঘ কিছু দেখা কঠিন লাগা।
• সব কিছুতেই দ্রুত বিরক্তি আসা।
• ছোট ছোট আনন্দে তাড়াহুড়ো, বড় কাজে অলসতা।
• মেজাজের ওঠানামা।
• একাকীত্ব বা শূন্যতা অনুভব।
এসবের পেছনে মূল কারণ হলো—মস্তিষ্ক ছোট পুরস্কারের এত অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যে বড় কাজগুলো আর ‘উত্তেজনাময়’ লাগে না।
ফলাফল হলো—আমরা কাজ ফেলে রাখি, মনোযোগ হারাই, আর নিজের ওপর রাগ হয়। নিজেদের অপারগ মনে হয়।

ডোপামিন ফাস্ট: বিষয়টি কী?
ইদানীং একটি ধারণা খুব জনপ্রিয়—ডোপামিন ফাস্ট। মানে, কিছু সময়ের জন্য সব উত্তেজনামূলক কাজ বাদ। যেমন—সোশ্যাল মিডিয়া , ভিডিও, জাঙ্ক ফুড, গেম, টানা স্ক্রল, অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন। এর উদ্দেশ্য—মস্তিষ্ককে আবার আগের সংবেদনশীলতা ফিরিয়ে দেওয়া।
যদিও পুরোপুরি “ডোপামিন বন্ধ” করা সম্ভব নয় (এটা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি), কিন্তু উত্তেজনামূলক জিনিস কমিয়ে দিলে মস্তিষ্ক আবার স্বাভাবিকভাবে আনন্দ পেতে শুরু করে।
কীভাবে বের হবেন এই চক্র থেকে?
এটা কঠিন—কিন্তু অসম্ভব নয়। কিছু ছোট পদক্ষেপ আমাদের ধীরে ধীরে মুক্ত করতে পারে:
১. নোটিফিকেশন কমিয়ে দিন
শুধু জরুরি অ্যাপের নোটিফিকেশন চালু রাখুন। বাকি সব বন্ধ।
২. ফোনে ‘ফাস্ট ফুড কন্টেন্ট’ কমান
টিকটক-রিলস দেখার বদলে লম্বা ভিডিও বা আর্টিকেল পড়ার অভ্যাস করুন।
৩. ডোপামিনের উৎস বদলান
জাঙ্ক খাবার নয়—হাঁটা। স্ক্রল নয়—বই পড়া। ফাঁকা সময় নয়—গুছিয়ে লেখা বা নতুন কিছু শেখা।

৪. দৈনন্দিন ছোট রুটিন
১০ মিনিট হাঁটা, ১০ মিনিট পড়া, ১০ মিনিট গুছানো। এগুলো মস্তিষ্ককে স্থির করে।
৫. নির্দিষ্ট ‘ফোন টাইম’ ঠিক করে নিন
সারাদিন ফোন নয়—দিনে কিছু নির্দিষ্ট সময়।
৬. নিজেকে ধীরে ধীরে পুরস্কৃত করুন
এক পাতা পড়লে একটু বিশ্রাম, একটি কাজ শেষ করলে মিউজিক শোনা— এগুলো স্বাস্থ্যকর ডোপামিন দেয়।
অবিরাম আনন্দের দৌড় আমাদের ক্লান্ত করছে। আমরা ভাবি আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি—কিন্তু আসলে আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে আছি হাজারটা ছোট ছোট উদ্দীপনায়। ডোপামিনের এই নীরব দাসত্ব চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মনকে ছিঁড়ে ফেলে।
সমাধান হলো—আনন্দ ত্যাগ নয়, বরং আনন্দের গতি কমানো। আবার ধীরে ধীরে অনুভব করা—এক কাপ চা, একটা বই, হাঁটার সময় বাতাসের গন্ধ, প্রিয়জনের সঙ্গে কথার উষ্ণতা।
আনন্দের পেছনে দৌড় নয়—আনন্দের সঙ্গে থাকা।