
এই নতুন ন্যারেটিভ কি নতুন তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে, নাকি পুরনো তথ্যকে নতুনভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা?
ইতিহাস শুধু অতীতের বর্ণনা নয়, ইতিহাস ক্ষমতার সঙ্গে চলমান এক ন্যারেটিভ যুদ্ধ। যে সময় যে শক্তি প্রভাবশালী হয়, সেই সময় ইতিহাসের ভাষা, ব্যাখ্যা ও গুরুত্ববোধও বদলে যেতে থাকে। ২০২৫ সালে এসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালের ভূমিকা নিয়ে যে নতুন ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তা এই ন্যারেটিভ যুদ্ধেরই সর্বশেষ অধ্যায়।
এই নতুন বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামী কোনোভাবেই গণহত্যা, নৃশংসতা বা মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল না। আরও জোর দিয়ে বলা হচ্ছে—জামায়াতের কোনো নেতা বা কর্মী রাজাকার, আলবদর বা আলশামস বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি নথিতে যাদের রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, আজ তাদের কেউ কেউ দাবি করছেন—তারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না, আবার রাজাকারও ছিলেন না। এই দ্বৈত অবস্থান থেকেই ইতিহাসের এক গভীর গড়মিলের জন্ম হচ্ছে।
এখানেই প্রশ্ন ওঠে—এই নতুন ন্যারেটিভ কি নতুন তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে, নাকি পুরনো তথ্যকে নতুনভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা?
১৯৭১: নথিভিত্তিক বাস্তবতা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনের তথ্য কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য নয়, বরং সমকালীন সরকারি গেজেট, পাকিস্তান সরকারের ঘোষণা, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং যুদ্ধোত্তর তদন্ত প্রতিবেদন দ্বারা প্রমাণিত।
১৯৭১ সালের ২২ মে পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকার বাহিনী গঠনের ঘোষণা দেয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মালিক নিজামুদ্দিনের অধীনে এই বাহিনী সংগঠিত হয়। আলবদর ও আলশামস ছিল মূলত ইসলামী ছাত্রসংঘের (যা পরবর্তীতে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে পরিচিত) সংগঠিত ক্যাডারভিত্তিক বাহিনী—এ তথ্য উঠে এসেছে একাধিক দেশি-বিদেশি গবেষণায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গঠিত দালাল আইন, ১৯৭২ সালের কলাবরেটরস অর্ডার, এবং পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোতে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সাক্ষ্য ও নথি উপস্থাপিত হয়েছে। এসব মামলার রায় রাজনৈতিক বক্তব্য নয়; এগুলো বিচারিক প্রক্রিয়ার ফল।
ন্যারেটিভ বনাম প্রমাণ
ইতিহাসের পুনর্লিখন তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যখন নতুন ন্যারেটিভের পেছনে নতুন আর্কাইভ, নতুন দলিল, নতুন সাক্ষ্য বা নতুন গবেষণা থাকে। ২০২৫ সালে এসে জামায়াতের যে বক্তব্য সামনে আসছে, সেখানে নতুন কোনো প্রামাণ্য দলিল দেখা যাচ্ছে না। বরং দেখা যাচ্ছে পুরনো ঘটনাকে ভাষাগতভাবে পুনর্গঠন করার চেষ্টা।
উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে—“জামায়াত প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি।” কিন্তু ইতিহাসে রাজনৈতিক দল শুধু আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে নয়, তাদের নেতাকর্মীদের সংগঠিত ভূমিকার মাধ্যমেই মূল্যায়িত হয়। একটি দলের শীর্ষ নেতা যদি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে সহযোগিতা করেন, যুদ্ধকালীন প্রশাসনে ভূমিকা রাখেন, বা দমনমূলক বাহিনীর আদর্শিক ভিত্তি সরবরাহ করেন, তাহলে সেটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকে না।
রাজাকার না, কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী?
সবচেয়ে বড় গড়মিলটি এখানেই। এক পক্ষ এখন বলছে—তারা স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু রাজাকার ছিলেন না। এই যুক্তি ইতিহাসের ভাষায় টেকে না।
রাজাকার শব্দটি কোনো গালাগালি নয়; এটি একটি নির্দিষ্ট ভূমিকাগত পরিচয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে কাজ করা, তথ্য দেওয়া, অপারেশনে সহায়তা করা—এসবই রাজাকারি কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কেউ যদি বলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়েছেন, কিন্তু যুদ্ধকালীন দমননীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না—তাহলে তার সেই দাবি যাচাইযোগ্য প্রমাণের মুখোমুখি হতে হবে।
ইতিহাস ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা নয়; এটি দলিলের জায়গা।
কেন এই নতুন ন্যারেটিভ?
এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ২০২৫ সালের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াতে ইসলামী নতুন প্রজন্মের ভোটার, আন্তর্জাতিক পরিসর এবং ভবিষ্যৎ ক্ষমতার সমীকরণে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চায়। সেক্ষেত্রে ১৯৭১ একটি বড় রাজনৈতিক বোঝা। সেই বোঝা নামাতেই ইতিহাসকে “নতুনভাবে বলার” চেষ্টা।
কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে সমঝোতা না করে ইতিহাসকে অস্বীকার করলে সমাজে বিভ্রান্তি বাড়ে। নতুন প্রজন্ম সত্য-মিথ্যার পার্থক্য হারায়। রাষ্ট্রের ভিত্তিগত নৈতিক চুক্তি দুর্বল হয়।
সামনে কী প্রয়োজন
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো—আবেগ নয়, গবেষণা। রাষ্ট্রীয় আর্কাইভ, আন্তর্জাতিক দলিল, যুদ্ধকালীন পত্রিকা, সামরিক নথি, বিচারিক রায়—সবকিছু নতুন করে একাডেমিক পর্যালোচনার আওতায় আনতে হবে। ইতিহাস কোনো একক দলের সম্পত্তি নয়।
একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোরও দায় আছে। যারা নতুন ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে চান, তাদের দায়িত্ব প্রমাণ হাজির করা। আর যারা পুরনো ন্যারেটিভে বিশ্বাস করেন, তাদের দায়িত্ব তথ্য সংরক্ষণ ও উপস্থাপন আরও শক্ত করা।
কারণ ইতিহাসের সঙ্গে প্রতারণা করলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র নিজেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়; এটি একটি নৈতিক অর্জন। সেই অর্জনের হিসাব গড়মিল হলে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও ঝাপসা হয়ে যায়। ইতিহাসের সঙ্গে সৎ থাকাই তাই সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম।
ড. শরিফুল ইসলাম দুলু: বিপণন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, নীতি পরামর্শক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মার্কেটার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর সেক্রেটারি জেনারেল এবং মার্কটেল কনসাল্টিং গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা