ঢাকাসহ সারা দেশের থানা ও ইউনিটগুলোতে কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না পুলিশের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। গত সাত বছরে প্রায় ৭৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপকর্মে জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। ঘটনা ঘটলেই তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বদলি, প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্তের মতো লঘু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ফৌজদারি আইনে তাঁদের সাজা হচ্ছে না। আবার মাঝেমধ্যে তদন্ত কমিটি কিছু সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলেও অভিযোগ আছে।
তবে এ তথ্য মানতে নারাজ পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক। তিনি জানিয়েছেন, কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসা মাত্রই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ জনগণের সেবক। আর সেবক হয়ে তারা অন্যায় করবে তা হতে পারে না। মিরপুরে একটি ঘটনায় তিন কর্মকর্তার শাস্তি হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়েছেন। এমনকি ডিসি ও এডিসি পর্যন্ত তিরস্কার থেকে বাদ পড়েননি।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ঘুষ বাণিজ্য, প্রতারণার মতো অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আর বড় ধরনের অপরাধ করার পর যাঁরা ধরা পড়ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও নেওয়া হচ্ছে না নজির গড়ার মতো আইনি ব্যবস্থা। যদিও গত সাত বছরে নানা অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে অন্তত ৭৫ হাজার পুলিশ সদস্যকে অর্থদণ্ড, তিরস্কার, বদলি, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আর ডিএমপি গত এক বছরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত চার শতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবু থামানো যাচ্ছে না তাঁদের অপকর্ম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠপর্যায়ের কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেলে যে কাউকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন। ডাকাতি, ছিনতাই থেকে শুরু করে সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে এক লাখ ৬০ হাজার সদস্য রয়েছেন। ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৩৪ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৭৮ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ওই বছর প্রায় ৩০ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। ২০১৬ সালে ১১ হাজার জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হলেও ফৌজদারি আইনে তেমন মামলা হয়নি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এক হাজার ৫১২ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নামকাওয়াস্তে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
গত ১৮ জুলাই ছিনতাইকারী সন্দেহে শাহজালাল নামে খুলনার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশ। তাঁর স্ত্রী রাহেলা বেগমের অভিযোগ, ছিনতাইকারী বানিয়ে পুলিশ তাঁর স্বামীর দুই চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। এ বিষয়ে তিনি কেএমপিতে অভিযোগ জানিয়েছেন। তবে পুলিশ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ১৮ মে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিনা কারণে লাঠিপেটা করে পুলিশ। ওই ঘটনায় এখনো কেউ শাস্তি পাননি। বরগুনায় ইউএনও গাজী তারিক সালমনকে অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যরা টেনেহিঁচড়ে হাজতখানায় নিয়ে যান। এ ঘটনায় মাঠপর্যায়ের কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হলেও ঊর্ধ্বতন কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০ জুলাই শাহবাগে বিক্ষোভের সময় তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ। এতে শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান আহত হন। তাঁর ডান চোখটি নষ্ট হয়ে গেছে। চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল কাফরুলের কচুক্ষেতের নিউ ওয়েভ ক্লাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ডিএমপির সহকারী কমিশনার রুহুল আমিনসহ ১১ সদস্যকে আটক করা হয়। পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আসার পর সবাইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছিল, তাঁদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাঁরা আর কোনো অপকর্ম করেছেন কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু ওই সুপারিশগুলো আমলে নেওয়া হয়নি।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর সোনারগাঁও হোটেল মোড়ে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবল। ওই কনস্টেবল জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। গত বছরের ১৩ নভেম্বর পুলিশ হেফাজত থেকে আসামি রুবেলকে পালাতে সহায়তা করার অভিযোগ ওঠে বাড্ডা থানার এসআই ইমরান উল হাসানসহ দুজনের বিরুদ্ধে। তাঁরা অর্থের বিনিময়ে আসামিকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন বলে তথ্য-প্রমাণ মিললেও তাঁদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নার্স আবুল ফজলকে পিটিয়ে আহত করে পুলিশ। ৬ ফেব্রুয়ারি টাকা না পেয়ে কল্যাণপুর পোড়া বস্তিতে পুলিশ নিরীহ রিকশাচালক সাজু মিয়াকে গুলি করে আহত করে। গত জুন মাসে চাঁদাবাজি ও চুরির অভিযোগে আদালতে বাড্ডা থানার ওসিসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নূরুন নাহার নাছিমা বেগম নামের এক নারী।
সূত্র জানায়, পুলিশের অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনতে পুলিশ সুপারদের কাছে বিশেষ চিঠি পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তা ছাড়া ডিএমপির ৪৯ থানায় চলছে গোপন নজরদারি। যেসব থানা পুলিশ সদস্যের অতীত রেকর্ড ভালো নয় সেসব থানায় বেশি নজরদারি চালানো হচ্ছে। যেসব এলাকায় পুলিশের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি তার ভিত্তিতে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান। কালের কণ্ঠ