Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিলাসবহুল গাড়িতে মাদক বেচকেনা চালিয়ে যাচ্ছেন বদির ছোট ভাই

car
প্রতীকী ছবি

মাদক পাচারের জন্য ব্যবহূত অত্যাধুনিক কয়েকটি গাড়ির তালিকা আছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এর মধ্যে আছে ঢাকা মেট্রো-গ-১৪-০৬৩১ নম্বরধারী ল্যান্ডক্রুজার, চট্ট মেট্রো-ভ-০২-০৫১৭, চট্ট মেট্রো-ভ-০২-০৪৮৬, চট্ট মেট্রো-গ-১১-৩০৫৮ ও চট্ট মেট্রো-গ-১২-৫৬১৬ নম্বরের প্রাইভেট কার, চট্ট মেট্রো-চ-১১-৩৬০২ নম্বরের মাইক্রোবাস, খুলনা মেট্রো-উ-১১-০০১৯ ও ঢাকা মেট্রো-ট-১৮২০২৭ নম্বরধারী বিলাসবহুল গাড়ি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, সারাদেশে ইয়াবা পাচার করতে সাতটি গাড়ি ব্যবহূত হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসব গাড়ির তালিকাও দিয়েছে তারা।

তাদের তালিকা অনুযায়ী ইয়াবা পাচারে ব্যবহূত হওয়া গাড়ির মধ্যে আছে সাংসদ আবদুর রহমান বদির ছোট ভাই আবদুল আমিনের এফ প্রিমিও প্রাইভেট কার, আবদুল শুক্কুরের ল্যান্ডক্রুজার জিপ, জিয়াউর রহমানের নোয়া মাইক্রোবাস (চট্ট মেট্রো গ-১১-৪৫৬৭), সিদ্দিকের নোহা মাইক্রোবাস (চট্ট মেট্রো গ-১১-১১৬৯), জাফর আলমের হাইচ মাইক্রোবাস (চট্ট মেট্রো গ-১৩-২২৭৬) এবং বাহাদুর ও আবদুল্লাহ নামের দুই ব্যক্তির দুটি টাটা ট্রাক। এসব গাড়ি মাদক পাচারের প্রয়োজনে ব্যবহার করে একাধিক ভুয়া নম্বর প্লেটও।

chardike-ad

জাহিদুল ইসলাম ওরফে আলো। মোবাইল যন্ত্রাংশের ব্যবসা ছিল তার। সাধারণভাবে সবাই তাকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মনে করলেও আসলে সে ছিল ইয়াবার বড় কারবারি। চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ এ ইয়াবা ব্যবসায়ী ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট র‌্যাব ও বিজিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। মৃত্যুর পর তার ব্যাংক হিসাবে মিলেছে ১১১ কোটি টাকা। ১২টি ব্যাংকের মাধ্যমে এ টাকা জমা হয় আলোর অ্যাকাউন্টে। বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে টেকনাফ আসনের এমপি আবদুর রহমান বদির অ্যাকাউন্টেও। মাত্র পাঁচ বছরে তার আয় বেড়েছে ৩৫১ গুণ! ২০০৮ সালে নির্বাচনের সময় জমা দেওয়া হলফনামায় বদি তার বার্ষিক আয় উল্লেখ করেছিলেন দুই লাখ ১০ হাজার ৪৮০ টাকা। কিন্তু এর পরের পাঁচ বছরে তার আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪০ টাকা। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এমপি বদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় এরই মধ্যে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। দুদকের কাছে নিহত ব্যবসায়ী আলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টেরও তথ্য রয়েছে। এভাবে মাদকের ব্যবসা করে যারা বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন এখন সবার তথ্যই সংগ্রহ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। চলমান সাঁড়াশি অভিযানের ফাঁকে সংগ্রহ করা হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীদের বাড়ি-গাড়ি ও ব্যাংক ব্যালান্সের তথ্যও।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘দেশজুড়ে চলা মাদকবিরোধী যুদ্ধের রেশ আছে চট্টগ্রাম বিভাগেও। বিভাগের কক্সবাজার পয়েন্ট থেকেই চট্টগ্রাম হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা। বিষয়টি আমাদের জানা আছে। তাই শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকাও করেছি আমরা। যাদের কারণে যুব সমাজ ধ্বংস হচ্ছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চলমান অভিযান এখনও শেষ হয়নি। মাদক ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের কৌশলী হতে হচ্ছে। অপরাধী যত প্রভাবশালীই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তাদের বাড়ি-গাড়ি ও ব্যাংক ব্যালান্সের তথ্যও সংগ্রহ করছি। আমলে আনা হচ্ছে মাদক সংক্রান্ত পুরনো মামলাও।’

দেশজুড়ে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চললেও প্রধান মাদক ইয়াবার উৎসমুখ কক্সবাজার এখনও ‘সুরক্ষিত’। এখানকার তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদেরও কেউ গ্রেফতার হয়নি গত এক সপ্তাহে। চট্টগ্রাম বিভাগে র‌্যাবের সঙ্গে পাঁচ মাদক ব্যবসায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেলেও তারা কেউ শীর্ষ তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ছিল না। অথচ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ব্যবসায়ীদের ৬০ শতাংশই চট্টগ্রাম বিভাগের। কক্সবাজারের সাংসদ আবদুর রহমান বদির ভাই, মামা, ভাগিনাসহ পরিবারের অন্তত ২০ জন আছেন এই সন্দেহ তালিকায়। সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলীর দুই ছেলেও আছেন তালিকায়। আছেন কক্সবাজারের আরও অন্তত ২০ জন বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধি। কক্সবাজারের আরেক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নুরুল হুদার চার ভাইসহ তাদের পরিবারের অন্তত ১৫ জন আছেন তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে। তালিকায় এদেরকে ‘গডফাদার’ হিসেবে অভিহিত করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন সবাই।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইতিপূর্বে করা তালিকায় নাম আছে এমপি বদির ভাই আবদুল শুক্কুর, মজিবুর রহমান ওরফে মুজিব কমিশনার, শফিকুল

ইসলাম, আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান, ভাগিনা নিপু, মামা হায়দার আলী, মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল এবং এমপির দুই বেয়াই আকতার কামাল ও শাহেদ কামালের।

এমপি বদির পরিবার ছাড়াও তালিকায় নাম আছে ডা. হানিফের ছেলে হাজী সাইফুল করিম, তার দুই ভাই জিয়া ওরফে জেড করিম ও জাবেদ ইকবাল, ছাত্রনেতা আলী আহমদ, আমীর আহমদ, আলী হোসেন, মঞ্জুর আলম ও নুরুল বশরের। চার সহোদর নুরুল কবির, শামসুল হুদা, সরোয়ার কামাল ও নুরুল আবসারও আছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায়। আছে সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলীর বড় ছেলে মোর্শেদ ও মেজ ছেলে রাশেদের নামও। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এক থেকে সর্বোচ্চ ১৫টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এমপি আবদুর রহমান বদির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে মাদকবিরোধী এক সভায় ইতিপূর্বে ইয়াবা ব্যবসায় নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন তিনি। মাদকের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা কেউ প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন বদি। কিন্তু সরকারি সংস্থার তালিকাতেই খোদ এমপি বদি ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম রয়েছে। এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। সে বদি হোক আর যেই হোক। বদির ব্যাপারে আপনাদের কাছে তথ্য থাকলে আমাদের দেবেন।’

এদিকে টেকনাফের সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এমপি আবদুর রহমান বদির প্রত্যক্ষ ইন্ধনেই কক্সবাজার থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে মাদক। বিশেষ অভিযানের মধ্যেও কৌশল পাল্টে মাদক পাচার করছেন এমপির পরিবারের সদস্যরা। মূল হোতাদের না ধরে চুনোপুঁটিদের ধরে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’ তালিকায় তার দুই ছেলের নাম থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে প্রভাবিত হয়েই কেউ তাদের নাম তালিকায় ঢুকিয়েছে।’

এদিকে বিশেষ অভিযান চলমান থাকলেও কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ ও পটিয়া হয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হচ্ছে ইয়াবা। মাছের ট্রলারেও আসছে ভয়ঙ্কর এ মাদক। আগে ছোট ছোট যানে করে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক এলেও এখন সড়কপথে মাদক আনতে ব্যবহার করা হচ্ছে ল্যান্ডক্রুজার, প্রাডোর মতো বিলাসবহুল গাড়ি। গোয়েন্দারা বলছেন, ইয়াবা পাচার করতে ব্যবহার হচ্ছে বিমানও। কক্সবাজার থেকে সরাসরি ঢাকায় ইয়াবা নিতেই ব্যবহার হচ্ছে আকাশপথ।

এ প্রসঙ্গে র‌্যাব-৭ চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকা আমরা পর্যবেক্ষণ করি। আমাদের নিজস্ব উইংয়ের অনুসন্ধান বিবেচনায় রেখেও অভিযান পরিচালনা করছি। কক্সবাজারে আমাদের বিশেষ টিম কাজ করছে। চট্টগ্রামে মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত বরিশাল কলোনিতে এরই মধ্যে অভিযান চালিয়েছি আমরা। অপরাধীরা কৌশল পাল্টালেও এতটুকু ছাড় পাবে না।’ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিতে বিলাসবহুল যেসব গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোও নজরদারিতে আছে বলে জানান তিনি।