Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

রাজধানীতে আওয়ামী লীগ নেতার ভয়ংকর শাসন

shamimঢাকা উত্তর সিটির ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ মাতবর। একই সঙ্গে তিনি ক্যান্টনমেন্ট থানা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটিরও সাধারণ সম্পাদক। এই দুই পদের প্রভাব খাটিয়ে মানিকদী এলাকায় ‘ভয়ংকর শাসন কায়েম’ করেছেন তিনি।

শামীমের বিরুদ্ধে এলাকায় বাড়ি দখলের চেষ্টা, জমি দখল, চাঁদাবাজির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেই ‘আদালত’ বসিয়ে বিচারকাজ করছেন। এর মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। যারাই তাঁর ‘আদালতের’ বিচার মানছে না, তাদের ওপর নেমে আসছে নানা ধরনের হয়রানির খড়্গ। বিএনপির নেতা বানিয়ে একাধিক মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে এলাকাছাড়া করেছেন বেশ কয়েকজনকে। সম্প্রতি অনুসন্ধানে আওয়ামী লীগ নেতা শামীম মাতবরের এমন ত্রাস সৃষ্টির তথ্য পাওয়া গেছে।

chardike-ad

শামীম নিজেই ‘আদালত’: সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব মানিকদীতে ৬২৫ নম্বরের বাড়িটির মালিক মৃত মোতাহার হোসেন। ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন জোয়ার সাহারা মৌজার আরএস ৬ নম্বর দাগে প্রায় ৫ শতাংশ জমির ওপর তিনতলা ভবন। মোতাহার হোসেনের মৃত্যুর পর ১৯৯৭ সালে তাঁর মেজ ছেলে মাকসুদ হোসেন টিপু বাড়িটি নির্মাণ করে মা ও ভাইবোনদের নিয়ে ২২ বছর ধরে ভোগদখল করে আসছেন। মোতাহার হোসেনের স্ত্রী রহিমা খানম জীবিত থাকতেই ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি পারিবারিকভাবে বণ্টননামা করে সন্তানদের মধ্যে জমিজমা সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে যান। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর এই বণ্টননামা মানতে চাচ্ছেন না বড় ছেলে মোয়াজ্জেম হোসেন বিপু। ২০১৬ সালের ৭ জুলাই ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে করা হয় একটি বণ্টননামা, সেটাও মানছেন না বিপু।

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতা শামীম আহমেদ মাতবরের সঙ্গে আঁতাত করে অন্য ভাই-বোনদের উচ্ছেদ করে পুরো বাড়িটি দখলে নিতে চান লন্ডনপ্রবাসী মোয়াজ্জেম হোসেন বিপু। তিনি বাংলাদেশে এসে এ বিষয়ে শামীম মাতবরের কাছে যান। শামীম মানিকদী বাজার এলাকায় তাঁর কার্যালয়ে পরিবারটির অন্যদের ডাকলেও তাঁরা যাননি। এরপর গত সেপ্টেম্বরে শামীম কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির প্যাডে একটি বণ্টননামা তৈরি করে দেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, শামীম মাতবরের রোষানলে পড়ে মাকসুদ হোসেন টিপু প্রায় তিন মাস ধরে এলাকাছাড়া। টিপুর ভাই বিপুর কাছ থেকে কম দামে বাড়িটি কিনে নিতেই টিপুকে মামলায় জড়িয়ে এলাকাছাড়া করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাকসুদ হোসেন টিপু এলাকার কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। কখনো বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ছিলেনও না। কিন্তু ওয়ার্ড বিএনপির কোষাধ্যক্ষ বানিয়ে তিনটি মামলায় আসামি করা হয়েছে তাঁকে। এর পেছনে ইন্ধন রয়েছে শামীম মাতবরের।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে মাকসুদ হোসেন টিপুকেও আসামি করা হয়েছে (৬১ নম্বর)। কিন্তু মামলার এজাহারে তাঁর নাম ছিল না। অভিযোগপত্রেও মাকসুদকে ওয়ার্ড বিএনপির কোষাধ্যক্ষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিপু বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।

কমিউনিটি পুলিশিং সার্ভিসেসের প্যাডে বণ্টননামা দলিল প্রসঙ্গে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে মাকসুদ হোসেন টিপু বলেন, ‘বড় ভাই বিপুর পক্ষ নিয়ে অন্যায়ভাবে শামীম মাতবর ও তাঁর লোকজন বাড়িটি দখল নিতে চায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশ যেখানে জমির মালিকানা নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, এটার কোনো বিধান নেই। সেখানে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সেক্রেটারি হয়ে তাদের প্যাডেই বণ্টননামা দলিল করায় আমরা বিস্মিত এবং হতবাক।’

পরিবারের বড় বোন লুৎফুন নাহার বেলা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার ভাই বিপু খুব বেশি অন্যায় করছেন, পুলিশ যেখানে জমি নিয়ে কথা বলে না, সেখানে কমিউনিটি পুলিশের লোকজন দলিলও করে দেয়, এটা কিভাবে সম্ভব?’

স্থানীয় বাসিন্দা রহিম উদ্দিন আহমদ ও বেলাল উদ্দিন বলছিলেন, দলীয় পদের সঙ্গে শামীম এখন কমিউনিটি পুলিশিংয়েরও নেতা। এ পদের প্রভাব খাটিয়ে নিজেই আদালত বসিয়ে বিচার করছেন। ভয়ে এ ব্যাপারে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চায় না।

শামীমের এক চাচাতো ভাই নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়ে মানুষকে তাঁর কার্যালয়ে নোটিশ করে ডেকে বিচার-সালিস করছেন। কেউ তাঁর অন্যায় বিচার না মানলে নির্যাতন এবং হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।’

পূর্ব মানিকদী কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির প্যাডে জমির বণ্টননামা দলিল তাঁরা কিভাবে করলেন, সেটা তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। বিষয়টি নিয়ে আমি থানায়ও গিয়েছিলাম; কিন্তু তারাও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থানা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘শামীম মাতবর ক্ষমতার জোরেই এটা করেছেন। বিপুর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে পুলিশিং কমিটির ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তিনি।’

ক্যান্টনমেন্ট থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সভাপতি সামসুল হক খান বলেন, ‘আমি আসলে জানতাম এটা করা যায় না। তবে ইচ্ছা করলে সেটা তারা না মানলেও হবে কিংবা ছিঁড়ে ফেলে দিতেও পারবে। আর টিপু আমার কাছে এলে আমি সমাধান করে দেব।’

এ ব্যাপারে শামীম মাতবর বলেন, ‘বণ্টননামা নিয়ে বিপুরা আমার কাছে এসেছিল। তাই করে দিয়েছি।’ টিপুকে বিএনপির নেতা বানানো বিষয়ে বলেন, ‘তারা তো নিজেরা নিজেরা কমিটি করে।’ টিপুকে বিএনপির কোনো কর্মসূচিতে দেখেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাঁরা তো প্রকাশ্যে কর্মসূচিতে থাকে না।’

বিধবা ও প্রবাসীর জমি দখল: শামীম মাতবরের অপকর্মের বিষয়ে অনুসন্ধানকালে মানিকদী বাজার, পূর্ব মানিকদী ও পশ্চিম মানিকদী ঘুরে পাওয়া গেছে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য। এর মধ্যে একজন বিধবার জমি দখল অন্যতম। শামীম মাতবরের দখলবাজির শিকার ঢাকা উত্তরের ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন মানিকদি বাজার এলাকার মৃত মো. হানিফ মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম আঙ্গুর।

জানা গেছে, আনোয়ারার স্বামীর কেনা তিন শতাংশ নিচু জমি জোরপূর্বক বালু ভরাট করে দখলে নিয়েছেন শামীম। সেখানে ছাপরা তুলে নিজের নামে সাইনবোর্ডও টানিয়ে দিয়েছেন। একপ্রকার বাধ্য হয়ে প্রায় কোটি টাকার জমিটি বিক্রি করার জন্য বারবার ক্রেতা আনলেও শামীম মাতবর ও তাঁর লোকজন ভয়ভীতি দেখাচ্ছে এই বিধবাকে।

আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী নেভিতে সার্জেন্ট হিসেবে চাকরি করতেন। স্বামী জীবিত থাকতেই ডোবা জায়গায় তিন শতাংশ জমি কেনেন। সেই জমিটি সাত-আট বছর আগে শামীম মাতবর ও তার লোকজন বালু দিয়ে ভরাট করে এবং বিনিময়ে ৭০ হাজার টাকা দাবি করে। পরে ঘর তুলে নিজের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়।’ তিনি বলছিলেন, মেয়েকে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেও টাকার জন্য পারছেন না।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আনোয়ারা বলেন, ‘আমার মতো একজন বিধবার জমিটি দখলে রাখছে শামীম। জমিটি বিক্রির জন্য অনেক চেষ্টা করছি, কিন্তু শামীমের জন্য বিক্রি করতে পারছি না।’

লোকমান খান ২৫ বছর ছিলেন সৌদি আরবে। প্রবাসে থেকে কষ্টের টাকায় দুই কাঠা জমি কিনেছিলেন পশ্চিম মানিকদি এলাকায়। সেখানে নিচু জমি ভরাট করে বাড়ি বানানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। তিন বছর আগে শামীম মাতবর ও তাঁর ক্যাডার বাহিনী এসে বাড়ি তৈরির কাজ বন্ধ করে দেয়। জমিটি নিজের দাবি করে আধাকাঠা জোর করে দখলে নিয়ে যান শামীম। শুধু তা-ই নয়, লোকমান খানের বাড়ি করার জন্য কেনা ইট-বালু-সিমেন্ট দিয়েই দেয়াল তুলে প্রায় ২৫ লাখ মূল্যের জমি দখল করেন।

জানতে চাইলে লোকমান খানের চোখে-মুখে আতঙ্ক ভর করে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাই সেই জমি দখলের কথা আর কী বলব? শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখছি। আমার অনেক পরিশ্রমের টাকায় কেনা জমি দখলে নিয়েছে। আমি আর বেশি কিছু বলতে পারব না। একই এলাকার আরো অনেকের জমি দখলে নিয়েছে কিংবা জমির পরিবর্তে টাকা নিয়েছে শামীম সিন্ডিকেটের লোকজন।’

বিধবার জমি দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে শামীম মাতবর কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে লোকমানের জমি দখল করে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সেটা তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির অংশ। সে কারণে দখলে নিয়েছেন তিনি।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তা দখল করে চাঁদাবাজি: মানিকদি বাজারের মানিক ফার্মেসির মালিক ও পল্লী চিকিৎসক সিদ্দিকুর রহমানের বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তা নিজের জমি দাবি করে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে শামীম মাতবর ও তাঁর লোকজন। শেষ পর্যন্ত নিরীহ সিদ্দিকুর রহমান ধারদেনা করে পাঁচ লাখ টাকা শামীমকে দিয়ে রাস্তায় চলাচলের সুযোগ পান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়েছি রাস্তার জন্য, সেই বিষয়ে এখন কিছু বলে বিপদে পড়তে চাই না।’ এ বিষয়ে শামীম বলেন, ‘আমাদের জমিতে রাস্তা করেছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। সে জন্য টাকা নিয়েছি।’

মানিকদি বাজারের ষাটোর্ধ্ব সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এলাকায় ঘুরলে শামীম মাতবরের অনেক দখলবাজি আর চাঁদাবাজির ঘটনা পাবেন, তবে কেউ মুখ খুলতে চায় না।’

এলাকাবাসী বলছে, শামীম মাতবরের বাবা মমতাজ মাতবর ছিলেন খুবই ভালো মনের মানুষ। উনি মানুষের বিপদ-আপদে এগিয়ে যেতেন। অথচ তাঁর ছেলে হয়ে শামীম এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছেন। আওয়ামী লীগের সুনাম নষ্ট হচ্ছে এই শামীমদের কারণে। দলের ওপর মহলের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত।

মামলায় আসামি করে হয়রানি: শুধু মাকসুদ হোসেন টিপুই নন, মানিকদি বাজারের সিঙ্গার শোরুমের ম্যানেজার ও স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমানও শামীম মাতবরের রোষানলের শিকার হয়ে মিথ্যা নাশকতা মামলার আসামি হয়েছেন। একইভাবে এলাকার ২০ জনের বেশি নিরীহ বাসিন্দাকে মামলায় জড়িয়ে দিয়েছেন। আরো কয়েকজনের কাছ থেকে মামলার ভয় দেখিয়ে আদায় করছেন টাকা।

সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ