হাজার বছরের ইতিহাস আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ উজবেকিস্তান পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় দেশ। ইতিহাসখ্যাত যোদ্ধা ও শাসক তৈমুর লং, হজরত ইমাম বুখারি, হজরত বাহাউদ্দিন নকশাবন্দীসহ অনেক জ্ঞানী ও গুণিজনের মাজার রয়েছে দেশটিতে। অসংখ্য প্রচীন মসজিদ, মাদ্রাসা, দুর্গ ও বৌদ্ধ ধর্মের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে দেশজুড়ে। পুরো দেশ ঘুরে বেড়ানোর পর মনে হবে এ যেন এক ঐশ্বর্যমণ্ডিত ঐতিহ্যের দেশ। উদাহরণ টানলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। তাজমহলের কথাই ধরুন। আপনি যদি আগ্রার তাজমহল দেখে থাকেন তবে উজবেকিস্তানের হাজার বছরের পুরনো মিনার, প্রাসাদ ও মসজিদের সঙ্গে এর নির্মাণশৈলীর মিল খুঁজে পাবেন। চোখ জুড়িয়ে যাবে উজবেকিস্তানের হাজার বছরের ইতিহাস আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেখে।
শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর অধীনে থেকে অবশেষে ১৯৯১ সালে স্বধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে উজবেকিস্তান। এরপর কর্তৃপক্ষ মনোযোগী হন দেশগড়ার কাজে। পর্যটন খাতকে দেয়া হয় অগ্রাধিকার। ধীরে ধীরে সেজে ওঠে পুরো দেশ। উজবেকিস্তানের উষ্ণ মরুভূমির তপ্ত বালির ছোঁয়া আর বরাফাচ্ছাদিত পর্বতের চূড়ায় আরোহণের যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি এখানে রয়েছে বিশ্বমানের পাঁচতারা হোটেল ও অসংখ্য রিসোর্ট। কয়েক বছর ধরে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার লাখ লাখ পর্যটক ভিড় করছেন উজবেকিস্তানে। চলুন জেনে নেই সেখানের কয়েকটি বিখ্যাত শহর ও নিদর্শনের কথা।
তাসখন্দ: উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল বেরুনি এবং মকসুদ কাসগরির মতে, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে তাসখন্দ হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। আধুনিক মেট্রোপলিটন শহর তাসখন্দ। প্রাচীন ঐতিহ্য আর আধুনিকতা এবং পূর্ব-পশ্চিমের সেতুবন্ধ হিসেবে তাসখন্দ গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রাচীন সভ্যতার নির্দশন হিসেবে এখানে রয়েছে অসংখ্য মাজার, মসজিদ আর সমাধি।
এখানে রয়েছে পৃথিবীর প্রথম দিকের চারটি হাতে লেখা কোরান শরিফের একটি। যা দেখে অবশ্যই আপনি অভিভূত হনে। নগরীজুড়ে রয়েছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট, যেখানে মিলবে এতিহ্যবাহী উজবেক রুটি আর জিভে পানি আনা বিভিন্ন স্বাদের কাবাব। দিনের ভ্রমণ শেষে বসে পড়ুন যে কোনো একটি সরাইখানায়, উপভোগ করুন উজবেক খাবার আর সেইসঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ব্যালে নৃত্য।
বিশ্ব চলচ্চিত্রেও পিছিয়ে ছিল না উজবেকিস্তান। নব্বই দশক পর্যন্ত তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসব ছিল মর্যাদাপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান।
সমরখন্দ: এটি উজবেকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। ঐতিহাসিকদের মতে সমরখন্দ রোম, এথেন্স আর ব্যাবিলনের মতোই দুই থেকে আড়াই হাজার বছরের পুরনো সমৃদ্ধ জনপদ। এ নগরীর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত আছে দার্শনিক, কবি, বিজ্ঞানী আর যোদ্ধার নাম। নগরীর সৌন্দর্য আর ঐতিহাসিক নিদর্শন পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। আলেকজেন্ডার দ্য গ্রেট সমরখন্দে এসে বলেছিলেন, ‘এ নগরী সম্পর্কে আগে যা শুনেছিলাম বাস্তবে এ নগরী তার চেয়েও সুন্দর ও রাজকীয়’।
ইবনে সিনা, আবু রায়হান, ওমর খৈয়াম, আল বেরুনি, আলজামিদের মতো জ্ঞানীগুণি ব্যক্তি এক সময় সমরখন্দকে সমৃদ্ধ করেছে। দুই হাজার বছর আগে বিজ্ঞান, প্রকৌশলী আর নির্মাণশৈলীর যে উন্নতি সমরখন্দে হয়েছিল একুশ শতকের পর্যটকরা এখনও তা অনুধাবনে বিস্মিত হন। এ নগরীর ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শাহী জিন্দা মাজার, সম্রাট তৈমুর লং নির্মিত সমাধি এবং ইমাম বোখারির মাজার।
বুখারা: খ্রিস্টপূর্ব ৪ শতকে বুখারার সবচেয়ে প্রাচীন প্রাসাদ ‘গ্রান্ড প্যালেন অফ আর্ক’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা এখনও পর্যটকদের বিস্মিত করে। বিশাল আর উঁচু প্রাচীরগুলো ঘিরে রয়েছে ১১টি গেট। ইতিহাসখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম আল বুখারি এই নগরীতেই জন্মলাভ করেছিলেন। ইতিহাস, মুসলিম আইন, আইনের অনুশাসন নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা পরিচালনা করেন। তিনি রচনা করেন ‘বুখারি শরিফ’। ইমাম বুখারির মাজারের ওপর নির্মিত হয়েছে বিশাল এক কমপ্লেক্স যা পর্যটকের কাছে এখনও এক দর্শনীয় স্থান। এখানকার সুস্বাদু রুটি ও ফল পর্যটকদের রসনা মেটায়।